বাংলাদেশে আমদানিই হয় ‘মাঝারি ও নিম্নমানের’ মসলাপণ্য!
১৮ মে ২০১৯ ০৮:১৩
চট্টগ্রাম ব্যুরো: বাংলাদেশে রান্না ও ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয় কমপক্ষে ৪৪ ধরনের মসলাপণ্য। ব্যবসায়ীদের মতে, বছরে চাহিদা আছে প্রায় দুই থেকে আড়াইলাখ মেট্রিকটন। অথচ বিশাল চাহিদার বিপরীতে বিদেশ থেকে মাঝারি ও নিম্নমানের মসলাপণ্য আমদানি করেন ব্যবসায়ীরা।
সবচেয়ে ভালোমানের মসলার ক্রেতা বাংলাদেশের বাজারে নেই। এই মাঝারি ও নিম্ন মানের মসলাপণ্যের মধ্যেও আবার একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী বিভিন্ন ভেজালের মিশ্রণ ঘটায়। মাঝারি ও নিম্নমানের এবং ক্ষেত্রবিশেষে ভেজালমিশ্রিত এসব মসলাপণ্যই যাচ্ছে নামিদামি বিভিন্ন কারখানায়। নামিদামি ব্র্যান্ডের সিল লাগিয়ে বিক্রি হচ্ছে পাইকারি বাজারে।
আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, রান্না ও ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত ৪৪ ধরনের মসলাপণ্যের মধ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয় অন্তত ১২ ধরনের মসলাপণ্য। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে প্রতিবছর গড়ে প্রায় দেড় লাখ মেট্রিকটন মসলাপণ্য আমদানি হয়। আমদানিকারকদের সিংহভাগই দেশের বৃহত্তম ভোগপণ্যের পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী।
সম্প্রতি হাইকোর্ট বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) পরীক্ষায় নিম্নমান প্রমাণিত হওয়ায় ৫২টি খাদ্যপণ্য অবিলম্বে বাজার থেকে প্রত্যাহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। এই ৫২টি পণ্যের মধ্যে নামিদামি কোম্পানির গুঁড়ো মসলাও আছে। হাইকোর্টের এ আদেশের পর মাঝারি ও নিম্নমানের মসলা আমদানির বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।
বাংলাদেশ মসলা আমদানিকারক সমিতির সহ-সভাপতি অমর দাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ, বি, সি, ডি থেকে মাঝারি ও নিম্নমানের মসলা আছে বিশ্ববাজারে। এ, বি, সি, ডি মানের মসলাপণ্য সৌদিআরবসহ উন্নত দেশগুলো, যাদের জনসংখ্যা বেশি, ধনি দেশ তারা নিয়ে যায়। ভারত-বাংলাদেশে মাঝারি ও নিম্নমানের মসলা আসে। যেমন-এলাচ আসে মাঝারি মানের। জিরা ওষুধ তৈরিতে লাগে। সেটা কিছুটা ভালোমানের আমদানি হয়। কারণ বাজারে ভালো জিরার চাহিদা আছে। এছাড়া আমরা তো স্থলপথে ভারত থেকেও অনেক মসলা আনি। ভারত যেখানে নিজেরাই মাঝারি ও নিম্নমানের মসলা আমদানি করে, সেখানে আমরা কীভাবে ভালো মানের পাব?’
খাতুনগঞ্জের মসলা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স অনুকূল ট্রেডার্সের মালিক সজীব কুমার সিনহা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা তিন ক্যাটাগরির মসলা আমদানি করি। কিছুটা ভালো, মাঝারি এবং নিম্নমানের। তবে নিম্নমানের বলতে সেগুলো যে খাওয়ার অনুপযোগী সেটা নয়। একেবারে সবচেয়ে ভালো যে মসলাটা, সেটার চাহিদা বাংলাদেশে নেই।’
দেশে যেসব মসলার বহুল ব্যবহার আছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- আদা, হলুদ, মরিচ, রসুন, পেঁয়াজ, কালোজিরা, গোলমরিচ, দারচিনি, জাফরান, তেজপাতা, জিরা, জাউন, শলুক, আলুবোখারা, বিলাতি ধনিয়া, ধনিয়া, চিপস, সাদা এলাচ, কালো এলাচ, মেথি, শাহি জিরা, পার্সলে, কাজুবাদাম, পানবিলাস, দইং, কারিপাতা, পাতা পেঁয়াজ, পেস্তাবাদাম, জায়ফল, জয়ত্রি, লবঙ্গ।
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে দেশে রসুন, আদা, হলুদ, এলাচ, জিরাসহ ১২টি মসলাপণ্য আমদানি হয়। কাস্টমস সূত্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে প্রায় ১ লাখ ৯৮ হাজার মেট্রিকটন মসলাপণ্য আমদানি হয়েছে। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে মোট ১ লাখ ৮২ হাজার টন মসলাপণ্য। চাহিদার বাকি মসলাপণ্য ভারত থেকে স্থলপথে আসে বলে জানিয়েছেন আমদানিকারকেরা।
সমুদ্রপথে সাধারণত সিঙ্গাপুর, চীন, ভিয়েতনাম, গুয়াতেমালা, ইন্দোনেশিয়া থেকে বিভিন্ন ধরনের অধিকাংশ মসলাপণ্য আসে। এছাড়া পাকিস্তান, সিরিয়া, আফগানিস্তান, কলম্বিয়া, মাদাগাসকার, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা থেকেও আসে কিছু মসলাপণ্য। মোট ২৪টি দেশ থেকে মসলা ঢোকে বাংলাদেশে।
মসলা আমদানিকারক অমর দাশ সারাবাংলাকে জানান, গোলমরিচ, জিরা, এলাচ ও দারুচিনি, লবঙ্গ সবচেয়ে বেশি আমদানি ও বিক্রি হয়। ভালো মানের জিরা আসে তুরস্ক থেকে। গত সপ্তাহে খাতুনগঞ্জে এই জিরার দাম ছিল কেজিপ্রতি ৩৫০ টাকা থেকে ৩৫৫ টাকা। ভারত থেকে আসে মাঝারি মানের জিরা, যার দাম ৩০০ টাকা থেকে ৩০৫ টাকা। গোলমরিচ গত সপ্তাহে খাতুনগঞ্জের বাজারে বিক্রি হয়েছে ৩৫৫ টাকায়। এলাচ কেজিপ্রতি ১৬০০ টাকা থেকে ২০৫০ টাকা, লবঙ্গ কেজিপ্রতি ৭৬০ থেকে ৭৭৫ টাকা এবং দারুচিনি বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ২৯০ টাকা থেকে ৩০০ টাকায়।
আমদানিকারক সজীব কুমার সিনহা সারাবাংলাকে বলেন, ‘খাতুনগঞ্জে আমরা যেসব মসলাপণ্য আড়ত থেকে পাইকারদের কাছে বিক্রি করছি, সেটা যদি অবিকৃতভাবে কারখানাগুলোতে যেত, তাহলে মান নিয়ে প্রশ্ন উঠত না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ থেকে বের হলেই তো মসলা ডুপ্লিকেট হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন রাসায়নিক, ইটের গুঁড়া, পাথর, রঙ মেশানো হচ্ছে। মানটা নিম্নমুখী হয়ে যাচ্ছে। প্রাণ, স্কয়ারের মতো কারখানাও তো আমাদের পাইকারি বিক্রেতাদের কাছ থেকেই কিন্তু মসলা কিনে প্যাকেটে ভরে বিক্রি করছে।’
বিএসটিআই’র প্রতিবেদন অনুাযায়ী- নিম্নমানের মসলাপণ্যের মধ্যে ড্যানিশের হলুদগুঁড়া, প্রাণের হলুদগুঁড়া, ফ্রেশের হলুদগুঁড়া, এসিআইর ধনিয়াগুঁড়া, প্রাণের কারি পাউডার, ড্যানিশের কারি পাউডার, পিওর হাটহাজারী মরিচগুঁড়া, মঞ্জিলের হলুদগুঁড়া, সান ফুডের হলুদগুঁড়া, ডলফিনের মরিচগুঁড়া, ডলফিনের হলুদগুঁড়া, সূর্যের মরিচগুঁড়া আছে।
সজীব কুমার সিনহা সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুধু আমদানিকারকদের ওপর দোষ দিলে হবে না। মাঝারি ও নিম্নমানের মসলা কিন্তু এখন নতুন আমদানি হচ্ছে না। আমদানি করা মসলা যে বাজারে গিয়ে ভেজাল হয়ে যাচ্ছে, সেটা রোধ করা বেশি জরুরি।’
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের আশপাশের এলাকা বাকলিয়ার রাজাখালী, ফুলতলী, কোরবানিগঞ্জ, চরচাক্তাই এলাকায় ভেজাল মরিচ-মসলার গুঁড়ার কারখানায় প্রতিবছর অভিযান পরিচালনা করে জেলা প্রশাসন।
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ছগির আহমদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘একসময় চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের কিছু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ভেজাল মসলা গুঁড়া তৈরির অভিযোগ উঠেছিল। পরে আমরা কঠোর অবস্থান নিই। এখন চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে এই ধরনের কাজ হচ্ছে না। তবে শহরের বিভিন্নস্থানে ভেজাল মসলা প্যাকেটজাত করা হচ্ছে। এটা নিশ্চয় প্রশাসনও জানে। এই বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।’
সারাবাংলা/আরডি/একে