ঘোষণা ছাড়া মদ-বিয়ার আনার দায় স্বীকার চীনা ঠিকাদারের
৫ আগস্ট ২০১৯ ২০:০০
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম বন্দরে যন্ত্রপাতির চালানের সঙ্গে ঘোষণা ছাড়া মদ-বিয়ার আনার ঘটনায় দায় স্বীকার করে নিয়েছে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে ওই সব পণ্যে যথাযথ শুল্ক পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে ‘নমনীয়’ হওয়ার অনুরোধ করেছে সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। এ সংক্রান্ত জটিলতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নিরবচ্ছিন্ন কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তারা।
অন্যদিকে চালান খালাসে নিয়োজিত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, ঘোষণা বর্হিভূত পণ্য আমদানির সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। বিপাশা ইন্টারন্যাশনাল নামের প্রতিষ্ঠানটির সত্ত্বাধিকারী সারাবাংলাকে বলেছেন, চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দায় স্বীকার করে নেওয়ার পর এখন এটা স্পষ্ট হলো এজেন্ট হিসেবে তাদের কোনই ভূমিকা এখানে ছিলো না। সংবাদমাধ্যমে এরই মধ্যে বিষয়টিতে তাদের জড়িয়ে প্রতিবেদন করায় সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, প্রায় তিন দশক ধরে এই ব্যবসা করে আসছি। স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করার কারণে কখনোই কোনও অভিযোগের মুখে পড়তে হয়নি। তার সঙ্গে যা কিছু হয়েছে সেটি অন্যায্য ছিলো বলেও দাবি এই ব্যবসায়ীর।
এদিকে, কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, যন্ত্রপাতির চালানের সঙ্গে মদ-বিয়ার আনার সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্র সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশের প্রমাণ তারা পেয়েছেন। তবে অনুরোধ করলেও এক্ষেত্রে নমনীয় হওয়ার সুযোগ তাদের নেই।
গত ২৩ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দরের ৩ নম্বর জেটিতে পানামার পতাকাবাহী এমভি কিজিয়া শান জাহাজে পটুয়াখালীর পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আনা যন্ত্রপাতির চালান খালাসের সময় একটি বাক্সে মদ-বিয়ার ধরা পড়ে। বড় জাহাজ থেকে ছোট তিনটি বার্জে পণ্য নামানোর সময় তা ধরা পড়ে। পরবর্তীতে বার্জ তিনটিও জব্দ করা হয়।
মোট আটটি চালানে ৬৬৯ কার্টনে যন্ত্রপাতির সঙ্গে চীনা প্রতিষ্ঠানটি কোনও কোনও কার্টনে ঘোষণা বহির্ভূত কিছু পণ্য আনে। এর মধ্যে রয়েছে মদ, বিয়ার, মাশরুম, নুডলসহ বিভিন্ন চীনা খাবার। রোববার (০৪ আগস্ট) চট্টগ্রাম বন্দরের ৫ নম্বর শেডে জব্দ করা কার্টনগুলোর পণ্য পরীক্ষা করা হয়।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের সহকারী কমিশনার মিজানুর রহমান সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, কার্টনগুলো পরীক্ষা করে ঘোষণা বর্হিভূতভাবে আনা প্রায় ১৪ হাজার ক্যান বিয়ার (প্রতিটি ক্যান ৩৩০ মিলি.), এক হাজার বোতল মদ (প্রতি বোতল ৫০০ মিলি.), ১০০ কার্টন সিগারেট এবং মাশরুম, চীনের চাউল, ব্রাউন সুগার, ভিনেগারসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য মিলিয়ে প্রায় ১০ মেট্রিকটন পণ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া ২ কনটেইনার টাইলস পাওয়া গেছে, যার কোনো ঘোষণা ছিল না। ৬৬৯টি কার্টনের মধ্যে ২৭টি কার্টনে পণ্যগুলো ছিলো বলেও জানায় সংশ্লিষ্টরা।
পরীক্ষার আগেই গত ৩১ জুলাই চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার বরাবরে দাপ্তরিক একটি চিঠি দেন বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের প্রধান প্রকৌশলী ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালক শাহ আবদুল মাওলা।
এতে উল্লেখ আছে, বাংলাদেশ সরকারের নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড এবং চীন সরকারের মালিকানাধীন চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট এন্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন লিমিটেড যৌথভাবে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের আওতায় এই বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়ন করছে। ২০১৬ সালের ২৯ মার্চ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চীনের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কনসোর্টিয়াম অব এনইপিসি এন্ড সিইসিসি নিয়োগ পায়। প্রকল্পের ৫০ শতাংশের মালিক বাংলাদেশ সরকার হওয়ায় বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড একটি সরকারি কোম্পানি বলে দাবি করা হয়েছে চিঠিতে।
কৌশলগত কারণে এটিকে প্রাইভেট লিমিটেড হিসেবে নিবন্ধিত করা হয়েছে বলেও এতে দাবি করা হয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কোম্পানির নামে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করে। প্রতিটি পণ্যচালানের বিপরীতে ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট এবং শিপিং ডকুমেন্ট তারা কোম্পানিতে দাখিল করে এবং কোম্পানি যাচাইবাছাইয়ের পর আমদানির অনুমতি দেয়। কাস্টমস থেকে আমদানি পণ্য খালাসের বিষয়টি ঠিকাদারের নিযুক্ত ক্লিয়ারিং এন্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্ট দেখভাল করে। তবে কোম্পানি আমদানি করা পণ্যের কায়িক পরীক্ষা বা প্রাক-জাহাজীকরণ পরিদর্শন করে না।
ঘোষণা বর্হিভূত পণ্য আমদানির বিষয়ে চিঠিতে বলা হয়, গত ২৪ জুলাই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে কোম্পানি বিষয়টি অবগত হয়। তারা এ বিষয়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাখা তলব করে। ব্যাখায় তারা জানায়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে বিরামহীনভাবে ২৪ ঘন্টা কর্মরত কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে তারা চীনের ঐতিহ্যগত কিছু খাবার ও পানীয় এনেছে। ভুলবশত সেগুলোর ঘোষণা দেওয়া হয়নি। এই পণ্যগুলো যথাযথ ঘোষণার মাধ্যমে পরবর্তী চালানে আমদানির কথা ছিল। এসব খাদ্য ও পানীয় শুধু প্রকল্প এলাকায় কর্মরত তিন হাজার চীনের নাগরিকের জন্য, কোনোভাবেই বাণিজ্যিক উদ্দেশে ব্যবহারের জন্য নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, অঘোষিত খাদ্যদ্রব্য আমদানির অভিযোগে কাস্টম কোম্পানির মূসক নিবন্ধন নম্বর বন্ধ করে রেখেছে। এতে যন্ত্রপাতি খালাস করা যাচ্ছে না। প্রকল্পের কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে এবং যথাসময়ে শেষ হবে কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
বিষয়টি নমনীয়ভাবে বিবেচনার জন্য কাস্টমকে অনুরোধ করেন প্রকল্প পরিচালক শাহ আবদুল মাওলা।
প্রকল্প পরিচালকের চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার ফখরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘নমনীয় হওয়া কিংবা না হওয়া এটা সম্পূর্ণ কাস্টমসের বিধিবিধানের ওপর নির্ভর করছে। আমরা আইনের বাইরে যাব না। নমনীয় বলতে বিভিন্ন অর্থ আছে। আমরা ডিক্লারেশন ছাড়া পণ্য ধরার পরও কিছু করলাম না, এটা এক ধরনের নমনীয়তা। আবার অল্প কিছু জরিমানা করে পণ্যগুলো ছেড়ে দিলাম, এটা এক ধরনের নমনীয়তা। যা-ই করি, কাস্টমস আইন মোতাবেক করা হবে।’
এদিকে গত ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনারকে আরেকটি চিঠি দিয়েছে পণ্য খালাসে নিয়োজিত সিএন্ডএফ প্রতিষ্ঠান মেসার্স বিপাশা ইন্টারন্যাশনাল ও পরিবহন এজেন্ট এএমএমএস লজিস্টিকস।
চিঠিতে বলা হয়েছে- জাহাজে আমদানি কনটেইনারের কার্টনে করে ঘোষণা বর্হিভূত পণ্য আনার বিষয়টি তারা কোনোভাবেই অবগত ছিল না। এর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততাও নেই। এরপর তাদের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের অনুমতি সাপেক্ষে তারা এ সংক্রান্ত সব ধরনের শুল্ক পরিশোধে প্রস্তুত আছে। ভবিষ্যতে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান যাতে সঠিক ঘোষণা দিয়ে পণ্য আনে, সেই বিষয়ে খালাসের আগে তারা সতর্ক থাকবে। কাস্টমসের বিধিবিধান মেনে চলার বিষয়েও তারা সতর্ক থাকবে।
এ বিষয়ে বিপাশা ইন্টারন্যাশনালের সত্ত্বাধিকারী শফিকুল আলম জুয়েল সারাবাংলাকে বলেন, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট হিসেবে কোনও প্যাকেট খোলার অধিকার আমাদের নেই। ফলে আমরা জানতেও পারি না, কোনটাতে কি রয়েছে। আমাদের কাজ হচ্ছে, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স পেলে পণ্য যথাস্থানে পৌঁছে দেওয়া। তিনি বলেন, ২৮ বছর ধরে এই ব্যবসা করে আসছি, তাছাড়া আমি এখন বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছি। এই খাতে ব্যবসায়ীদের নেতা হিসেবেও দায়িত্বশীলতার সাথে ব্যবসা করতে চাই।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের সেভাবে দায় নেই। আর বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ যেহেতু ঠিকাদারের দায় স্বীকার করে নিয়েছে, সেখানে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে দোষ দেওয়া যাবে না। তবে তাদের আরও সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।’
কাস্টমস ঘোষণা ছাড়া মদ-বিয়ার চট্টগ্রাম বন্দর চীনা কোম্পানি পায়রা পাওয়ার