হারাতে বসেছে চবি শাটলের ঐতিহ্য!
১৭ অক্টোবর ২০১৯ ০৭:৫৮
চট্টগ্রাম ব্যুরো: শাটলের বগি চাপড়িয়ে গানের আসরে মেতে উঠা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) শিক্ষার্থীদের চিরায়ত রুপ। একসময় শাটল ট্রেনের প্রতিটি বগিতে শিক্ষার্থীদের গানে মুখরিত হতো শাটল ট্রেন। প্রতিটি বগিতে গানের প্রচলন থাকলেও বর্তমানে তা বিলুপ্ত হওয়ার পথে। মাঝে মধ্যে শাটলের বগিতে গানের সুর পাওয়া গেলেও তা এখন দুষ্কর হয়ে উঠেছে। তবে বগিভিত্তি রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পর শাটল থেকে গান হারিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেছেন শিক্ষার্থীরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শাটল ট্রেনের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮০ সালে। এরপর থেকেই এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম। প্রতিদিন সকালে শহরের বটতলী স্টেশন থেকে এক জোড়া শাটল ক্যাম্পাসে উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। শাটল ট্রেনের প্রতিটি বগির রয়েছে আলাদা আলাদা নাম। তবে এগুলো কোনো রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ দেওয়া সোনার বাংলা, সুবর্ণ এক্সপ্রেস, মহানগর গোধূলী, উদয়ন এক্সপ্রেস, মেঘনা এক্সপ্রেস, তূর্ণা এক্সপ্রেস নয়।
এগুলো চবির বগিবাজ শিক্ষার্থীদের দেওয়া দোস্ত, ককপিট, অলওয়েজ, অক্টোপাস, সিক্সটি নাইন, একাকার, ফাইট ক্লাব, ফাটাফাটি, ভিএক্স, সিএফসি, উল্কা, এফিটাফ, বিজয় নামে একসময় পরিচিতি লাভ করেছিল। আর এই বগিগুলো ছিল শিল্পের কারুকাজে রঙচঙা। এখন আর রঙচঙা বগিগুলোও, নেই হারিয়ে গেছে। এসব বগিভিত্তিক সংগঠন থেকেই উঠে আসতো ছাত্র রাজনীতি নতুন মুখ। ২০১৫ সালের দিকে চবিতে বগিভিত্তিক সংগঠনের রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার পরপরই এসব সংগঠন ক্যাম্পাসে থাকলেও শাটলের বগি থেকে এখন প্রায় বিচ্ছিন্ন।
তবুও এই শাটলে যাতায়াতের মাধ্যমে এখানকার শিক্ষার্থীদের মাঝে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। কখনো এটি গড়ায় প্রণয়ে। এখানেই ভাগাভাগি হয় জীবনের সংকটের কথা, হয় আড্ডা, খুনসুটি। তবে শাটল ট্রেনের অন্যতম আকর্ষণ হলো শাটলের গান। ক্যাম্পাসে আসা যাওয়ার পথে অনেকেই গান করেন। এই ট্রেন ভ্রমণে তৈরি হয় মৌলিক অনেক গান। প্রতিদিন ক্যাম্পাসে শাটলে করে আসা-যাওয়ার পথে গানে গানে মাতিয়ে রাখে প্রতিটি বগির শিল্পীরা। কখনো সুরের তালে আবার কখনো ছন্দহীন সুরের আঁকাবাঁকা তালে। সুর-বেসুরের এই গানের ভেলায় মেতে উঠে শিক্ষার্থীরাও।
শাটল ট্রেনের বগির পাটাতন শিক্ষার্থীদের বাদ্যযন্ত্র। বগির পাটাতন পিটিয়ে, শিষ বাজিয়ে গানের সুর তুলেন শিক্ষার্থীরা। দেশের বেশ কয়েকজন তারকা শিল্পী গড়ে উঠেছেন এই শাটলকে ঘিরে। নকিব খান, পার্থ বড়ুয়া, এস আই টুটুলের মতো শিল্পীরা এই শাটলের হাত ধরেই উঠে এসেছেন।
একটা সময় শাটলের গান শিক্ষার্থীদের যাতায়াতকে করতো মধুময়। ওসব গানের কথা, সুরে খুঁজে পাওয়া যেত প্রাণ। আবেগ জড়ানো সুরে ভাওয়াইয়া, দেশাত্ববোধক, বাউল, নজরুল, রবীন্দ্র, হিন্দি, ইংরেজি গানে শাটলের বগিগুলো যেন একেকটা শিল্পীর মঞ্চ।
বর্তমানে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে শাটলের গানে। এখন আর আগের মতো ট্রেনের বগির পাটাতন পিটিয়ে গানের সুর পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠেছে। শাটলের গানের মধ্যে প্রাণই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
শাটল ট্রেনের গান হারিয়ে যাওয়ার বিষয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। প্রতিদিন শাটলে আসা যাওয়া করেন ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আসাদুজ্জামান নূর সারাবাংলাকে বলেন, আগে বগিভিত্তিক সুবিধার কারনে সবাই এক হয়ে গান করার সুবিধা পেতো। এখন সবাই এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাই আমি মনে করি অন্তত পক্ষে বগির শেষ দিকটা গানের জন্য (যারা গান গায়) তাদের জন্য উন্মুক্ত করা উচিত। আমি চাই শাটলের যে পুরনো ঐতিহ্য রয়েছে সেটা ফিরে আসুক।
একই কথা বললেন অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র প্রদীপ পাল। তিনি বগিতে অনেকবার গান করেছেন। তিনি বলেন, আসলে মূল ব্যাপার হলো যে শাটলে কেউ সিঙ্গেল গান করতে চায় না। তাই গ্রুপ সং-ই বেশি জনপ্রিয়। বগি রাজনীতি থাকার সময়ে গ্রুপ মেম্বাররা একসঙ্গে যাতায়াত করতো। ফলে তারা গান করতো। তাদের দেখায় অন্যরাও সুর মেলাতো। বগি রাজনীতি উঠে যাওয়ার ফলে শাটলে গানের ট্রেন্ড কমে গেছে। গান এখনো হয় তবে আগের তুলনায় কম।
রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী শ্রাবনী রুদ্র বলেন, আগে গ্রপ ভিত্তিক একসঙ্গে সুর মিলিয়ে গান হতো। এখন আর হয় না। কেউ কেউ একলা গান করতে চাই না। শাটলের গান না থাকায় শিক্ষার্থীরা এখন কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আমি চাই শাটলের গান ফিরে আসুক।