আবৃত্তি চর্চার ৩০ বছরে প্রমা, উৎসবে একমঞ্চে সংস্কৃতিজনেরা
২৯ নভেম্বর ২০১৯ ০০:৩৫
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ত্রিশ বছর পূর্তিতে বর্ণাঢ্য আয়োজনে তিনদিনের উৎসব শুরু করেছে চট্টগ্রামের সামনের সারির আবৃত্তি সংগঠন ‘প্রমা’। তিনদিনের প্রমা আবৃত্তি উৎসব-২০১৯ উপলক্ষে একমঞ্চে হাজির হয়েছিলেন দেশের সংস্কৃতি জগতের পুরোধা কয়েকজন ব্যক্তিত্বসহ বিশিষ্টজনেরা। তারা বলেছেন, ঐক্যবদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে সংস্কৃতিকর্মীরা সোনার মানুষ গড়বে আর রাজনীতিবিদদের সোনার বাংলাদেশ গড়তে হবে।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং চট্টগ্রামের ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনের সহযোগিতায় বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) বিকেল থেকে চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির অনিরুদ্ধ মুক্তমঞ্চে শুরু হয়েছে এই উৎসব। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাসান ইমাম।
হাসান ইমাম বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধসহ নানা অন্দোলনে সাংস্কৃতিক কর্মীরা যুক্ত হয়েছেন। আমরা সংস্কৃতিকর্মীরা সবসময় দেশের মানুষের পাশে থেকেছি। আশা করি আগামী প্রজন্মও দেশের মানুষের পাশে থাকবেন। কোনো প্রলোভনে বা ভয়ে প্রভাবিত হবেন না। দেশ, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদদের কথা ভেবে নবীনরা নি:স্বার্থভাবে কাজ করবেন। শিক্ষা ও সংস্কৃতি পারে সোনার মানুষ গড়তে। রাজনীতিবিদদের বলবো- আমরা সোনার মানুষ গড়ায় থাকবো, আপনারা সোনার দেশ গড়ুন।‘
অনুষ্ঠানে শহীদ জায়া বেগম মুশতারী শফী বলেন, ‘অনেক রক্ত ঢেলে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু দেশের ভেতর মানুষ নানাভাবে নিপীড়িত হচ্ছেন। সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে এসব থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে হবে। আমরা তরুণদের দিকে তাকিয়ে আছি। তরুণদের উজ্জীবিত করে অনাচার দূর করলে দেশ সোনার বাংলা হবে।‘
একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, ‘দেশে বিভিন্নসময় স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতার উত্থান আমাদের সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগকে সংকুচিত করেছে। একশ্রেণীর মানুষ গণতন্ত্র, সংস্কৃতি, নারী, শিশু ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে তাদের আস্ফালন দেখিয়েছে। সমাজ তার পশ্চাৎপদতা, অহমিকা দেখিয়েছে। কিছুতেই আমরা শুধু শিল্পকলার সাধনায় নিয়োজিত থাকতে পারিনি। নানা কাজে ভূমিকা রাখতে হয়েছে। এখন আমাদের একটি সাংস্কৃতিক বাতাবরণ দরকার। অধিক সংখ্যক মানুষ ও সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর উপায় নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।‘
দৈনিক আজাদী’র সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, ‘বাংলাদেশ যেন বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে ওঠে। কিভাবে হবে? সব ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম মানে গ্রাম, সে গ্রামই আছে। যদি বেরিয়ে আসতে পারি তাহলে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে পারব। নেতানেত্রীরা ট্রেনে উঠলেই আর চট্টগ্রামের কথা মনে থাকে না। যখন পুরো দেশকে দেশ হিসেবে দেখবেন তখন দেশ গড়ে উঠবে। পরমতসহিষ্ণু হতে হবে। আবরারের মতো আর কোনো ঘটনা দেখতে চাই না।‘
বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহকাম উল্লাহ বলেন, ‘আমাদের ঐক্যের বাংলাদেশ গড়তে হবে। সব মানুষের ঐক্যই পারে আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশে পৌঁছে দিতে।‘
বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শিমুল মোস্তফা শিমুল মুস্তফা বলেন, ‘এদেশে স্বদেশ বিদ্বেষী মানুষ আছে। যারা স্বাধীনতাকে, জাতীয় সঙ্গীতকে, জাতীয় পতাকাকে স্বীকার করে না। তাদের ধিক্কার জানানো উচিত, একঘরে করা উচিত। এদেশে যারা পাকপন্থী তাদের বিতাড়িত করতে হবে। নতুন প্রজন্মের কাছে অনুরোধ ঐক্যবদ্ধ থাকুন। এদেশের ভাষায়, পতাকায়, অস্তিত্বে রক্ত।‘
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ হাসান আরিফ বলেন, ‘এখন এমন অবস্থা যেন সবকিছু রাজনীতির মানুষের কাছ থেকে শিখতে হবে। তারা কারো কাছ থেকে শিখবে না। সেটা বাংলাদেশ না। কবিতার কথা রাজনীতিবিদরা শুনেছেন সেটাই ছিল বাংলাদেশ। স্বাধীনতা যদি কৃষকের হাসি হয়, কৃষক যদি হাসি হারায় তাহলে বিশ্বাস করতে হবে স্বাধীনতা ম্লান হচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম পালন যদি উদারতার জায়গা থেকে না হয় তাহলে স্বাধীনতা ম্লান হয়। রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব কবিতার মতো বাংলাদেশ করে দেয়া। সবকিছু গান কবিতা দিয়েই তাদের বুঝতে হবে।‘
সভাপতির বক্তব্যে প্রমার সভাপতি রাশেদ হাসান বলেন, ‘নব্বইয়ের উত্তাল সময়ে যাত্রা শুরু। এ পথচলায় অনেক মানুষ যুক্ত হয়েছেন। সকলের প্রয়াসে প্রমা আজ এখানে। তাদের সকলের প্রতি আমাদের ভালোবাসা। সংস্কৃতিকর্মীরা যদি সামষ্টিক শুভবোধ জাগ্রত করতে পারি, সমাজকে নাড়া দিতে পারি তাহলে মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণ সম্ভব। লক্ষ্যে অটুট থাকলে শিল্পের, মানুষের, শুভবোধের জয় হবে।‘
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রমার সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ পালের সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন প্রমার সহ-সভাপতি কঙ্কন দাশ। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক মুনতাসিম বিল্লাহ। উপস্থিত ছিলেন প্রমার সহ-সভাপতি স্বপন দাশ ও জেরিন মিলি।
এরপর শতকণ্ঠে আবৃত্তি দিয়ে আবৃত্তি পর্বের উদ্বোধন হয়। একক আবৃত্তি করেন আমন্ত্রিত আবৃত্তি শিল্পী মোকাদ্দেস বাবুল, দুলাল দাশগুপ্ত, কাজী মাহতাব সুমন, শামস উল আলম মিঠু, শাহাদাত হোসেন লিটন, আয়শা হক শিমু, ফয়জুল্লাহ সাঈদ, জি এম মোরশেদ, জালাল উদ্দিন হীরা, সাইমুম আনজুম ইভান।
কবিকন্ঠে কবিতাপাঠ করেন স্বপন দত্ত, ফাউজুল কবির, ওমর কায়সার, এজাজ ইউসুফী, বিজন মুজমদার,হোসাইন কবির, কামরুল হাসান বাদল এবং নাজিম উদ্দিন শ্যামল। প্রথমেই সংগঠনের শিশু বিভাগের শিল্পীরা বৃন্দ আবৃত্তি শুনিয়ে মুগ্ধ করে দর্শকদের।
অনুষ্ঠানে দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করে চট্টগ্রাম আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র ও প্রমা আবৃত্তি সংগঠন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন কিশোয়ার জাহান চৌধুরী তুলি ও পার্থ প্রতিম মহাজন।
নৃত্যশিল্পী প্রমা অবন্তীর পরিচালনায় নৃত্য পরিবেশন করেন ওডিসি এন্ড টেগোর ডান্স মুভমেন্ট সেন্টারের শিল্পীরা। এবারের উৎসবের প্রথম দিনের অনুষ্ঠান উৎসর্গ করা হয়েছে আবৃত্তি শিল্পী ও সংগঠক নিখিল সেন এবং কামরুল হাসান মনজুর স্মৃতিতে।
উৎসবের দ্বিতীয় দিন শুক্রবার সকালে চট্টগ্রামের শিল্পকলা একাডেমি থেকে র্যালি বের করবেন প্রমার শিল্পীরা। এছাড়া আবৃত্তি ও আলোচনা অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছে।