বসন্তের রঙে রঙিন চট্টগ্রাম
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৪:১৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ঋতুরাজ বসন্ত এসে গেছে। শীতের রুক্ষ ভাব কাটিয়ে প্রকৃতিতে নতুনের আবাহন। গাছে গাছে নতুন শাখা, নতুন পাতা, নতুন ফুল হাতছানি দিচ্ছে নতুন প্রাণের উচ্ছ্বাসের। বিভক্তির বেড়াজাল কাটিয়ে বসন্ত বাঙালির জীবনে আসে সম্মিলনের আবাহন নিয়ে। ফাগুনের প্রথম দিনটি চট্টগ্রামের নগরজীবনে প্রতিবারের মতো এবারও এসেছে উৎসবের রঙ নিয়ে। সেই রঙ ছুঁয়ে গেছে নানা বয়সী মানুষের মধ্যে।
চট্টগ্রাম নগরীতে বসন্ত উৎসবের প্রতিটি স্থানে শুক্রবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকেই বসেছিল মানুষের সম্মিলন। বাংলার চিরায়ত গান, নাচ, আবৃত্তি, কথামালাসহ নানা আয়োজনে শুরু থেকেই মুখর উৎসব অঙ্গন। এবার বসন্তের প্রথম দিনে ভালোবাসা দিবসও। তাই আনন্দ আয়োজনেও ছিল ভিন্নমাত্রা।
প্রমা আবৃত্তি সংগঠন
সকাল ৮টায় নগরীর সিআরবির শিরীষতলায় মুক্তমঞ্চে বেহালা ও ঢোলবাদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রমা আবৃত্তি আবৃত্তি সংগঠনের বসন্ত উৎসব। বন্দরনগরীতে বসন্ত উৎসবের সবচেয়ে বড় এই আয়োজন উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক শিক্ষক ড. মাহবুবুল হক।
উদ্বোধনী বক্তব্যে মাহবুবুল হক বলেন, ‘ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। প্রত্যেকটি ঋতু ভিন্ন ভিন্ন বৈচিত্র্য নিয়ে প্রকৃতিতে আসে। এর মধ্যে বসন্ত আসে প্রাণের স্পন্দন নিয়ে। সবকিছু নতুন করে শুরু করার বার্তা দেয় বসন্ত। মানুষের জীবনেও দু:খ, ব্যাথা, অপ্রাপ্তির যত বঞ্চনা আছে, সব ধুয়েমুছে নতুনভাবে শুরুর যে বিষয় থাকে, সেখানে প্রকৃতি আর জীবনবোধ একাকার হয়ে যায়। প্রকৃতিতে যেমন প্রাণের স্পন্দন তৈরি হয়, তেমনি মানুষের জীবনেও।’
অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ‘প্রকৃতির সময়কে ধারণ করে বিভিন্ন উৎসব পালন বাঙালির ঐতিহ্য, চিরায়ত রীতি। এই কৃষ্টি-ঐতিহ্যকে আমাদের ধরে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এগুলো আমাদের শেকড়, বাঙালির অস্তিত্বের ভিত।’
প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের সভাপতি রাশেদ হাসানের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ পালের সঞ্চালনায় এতে আরও বক্তব্য রাখেনবাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক নিতাই কুমার ভট্টাচার্য।
আয়োজন সম্পর্কে রাশেদ হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বসন্ত উৎসব শুধু একটি সাংস্কৃতিক আয়োজন নয়, এটি আমাদের বাঙালির আবহমান সংস্কৃতি। আমাদের ঐতিহ্য। এই সংস্কৃতি আমাদের জীবনবোধের শিক্ষা দেয়। মানবিকতাবোধ জাগ্রত করে। আমরা তৃতীয়বারের মতো সিআরবিতে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করেছি। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে আমরা অন্ধকারের অপশক্তির বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক জাগরণের বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করি।’
উদ্বোধনী কথামালার পর ওড়িশী নৃত্যশিল্পী প্রমা অবন্তীর দলের নাচের মধ্য দিয়ে মূল আয়োজনের দিকে এগিয়ে যায় শিরিষতলার মঞ্চ। ততক্ষণে মঞ্চের সামনে থেকে সিআরবির আশপাশের এলাকায়ও লোক সমাগম বাড়তে থাকে। রক্তকরবী, অভ্যুদয় সঙ্গীত অঙ্গণ, সঙ্গীত ভবনের শিল্পীরাও গান পরিবেশন করেন এই মঞ্চে।
দুপুরের বিরতির পর বিকেল থেকে আবারও রয়েছে বসন্তবরণের নানা আয়োজন। আর একে ঘিরে প্রকৃতিপ্রেমী আর উৎসবমুখর বাঙালির কোলাহলের রঙ পুরো এলাকায়।
বোধন আবৃত্তি পরিষদ
বোধন আবৃত্তি পরিষদের একাংশ চট্টগ্রাম নগরীর আমবাগানে রেলওয়ে জাদুঘরের সামনে শেখ রাসেল পার্কের মুক্তমঞ্চে বসন্ত বরণের আয়োজন করে। শুক্রবার সকালে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সোহেল আনোয়ারের একক আবৃত্তি পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। এরপর ভায়েলিনিস্ট চিটাগং বেহালা এবং দীপক ও তার দলের ঢোলবাদনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে অনুষ্ঠানমালা। বোধনের শিশু বিভাগের শিল্পীরা বৃন্দ আবৃত্তি পরিবেশন করে।
কোলাহলমুক্ত ছায়া-সুনিবিড় এলাকাটিতে বোধনের বসন্ত উৎসবকে ঘিরে সকাল থেকেই শুরু হয় প্রাণের স্পন্দন। বসন্ত বাতাসের নতুন ফুলের গন্ধ যেন ছড়িয়ে পড়েছে জড়ো হওয়া তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। মাথায় লাল-হলুদ ফুল। হলুদ শাড়ি পরে বাসন্তী সাজে সেজে নারী, হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে জড়িয়ে পুরুষ। কারও গায়ে আবার পলাশ রঙে রাঙা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবি অথবা শাড়ি জড়িয়ে শিশুরা শামিল হয়েছেন বসন্ত বরণে।
বিকেলের আয়োজনে আছে- কথামালা, শোভাযাত্রা, যন্ত্রসঙ্গীত, একক ও বৃন্দ আবৃত্তি, একক ও দলীয় সঙ্গীতসহ আরও নানা আয়োজন।
বোধন আবৃত্তি পরিষদের সংগঠক অনুপম শীল সারাবাংলাকে বলেন, ‘দ্বিতীয়বারের মতো আমরা রেলওয়ে জাদুঘর এলাকায় উৎসবের আয়োজন করেছি। প্রথমবারের চেয়ে বেশি সাড়া পাচ্ছি। আশা করি, আস্তে আস্তে মূল শহরের অদূরে হলেও এই আয়োজনই চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় পরিসরের আয়োজনে পরিণত হবে।’
এদিকে বোধন আবৃত্তি পরিষদের আরেক অংশ নগরীর আন্দরকিল্লায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন চত্বরে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করে। শুক্রবার সকালে আবৃত্তিশিল্পী শিমুল নন্দীর একক আবৃত্তি পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠানমালা। উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ রীতা দত্ত। এসময় মঞ্চে ছিলেন বোধন আবৃত্তি পরিষদের সভাপতি আব্দুল হালিম দোভাষ, প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য সুভাষ বরণ চক্রবর্তী, নারায়ণ প্রসাদ বিশ্বাস, সুজিত রায় ও সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক প্রনব চৌধুরী।
এরপর মোহনবীণা বাজিয়ে মঞ্চে ভিন্নতা আনেন শিল্পী দোলন কানুনগো ও টিটন বিশ্বাস। সঙ্গীত ভবন, গীতধ্বনি, অদিতি সঙ্গীত নিকেতনের শিল্পীরা দলীয় পরিবেশনায় অংশ নেন। ওডিসি এন্ড টেগোর মুভমেন্ট ও ঘুঙ্গুর ললিতকলা কেন্দ্রের শিল্পীরা নৃত্য পরিবেশন করেন।
অনুষ্ঠানে ফাঁকে মঞ্চে কথামালায় অংশ নেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর হাসান মাহমুদ হাসনী ও হাসান মুরাদ বিপ্লব, প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা সুমন বড়ুয়া এবং কবি ও সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল।
বোধন আবৃত্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রনব চৌধুরী সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, বিকেলে তবলার লহড়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে আয়োজন চলবে রাত পর্যন্ত। এর আগে আন্দরকিল্লা থেকে বের হবে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা।
সম্মিলিত বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ
চট্টগ্রাম নগরীর জামালখান মোড়ে সম্মিলিত বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদের আয়োজনের উদ্বোধন করেন সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন। প্রথমবারের মতো শুরু হওয়া এই আয়োজনে মোহনবীণার সুর সকালে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করে।
উদ্বোধনী বক্তব্যে অনুপম সেন বলেন, ‘বাঙালির বহুকালের রীতি হচ্ছে ঋতুকে বরণ করে নেওয়া। আমাদের আবহমান সংস্কৃতিই হচ্ছে প্রকৃতিনির্ভর। এর কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের মতো এতো সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সুন্দর দেশে এই পৃথিবীতে আর নেই। এর ফলে এদেশের ঋতুগুলো ভারি চমৎকার। একেকটি ঋতুর শুরুতে বিভিন্ন আনন্দ আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিন যাপনের গ্লানি থেকে বেরোবার চেষ্টা থেকেই নানা উৎসবের আয়োজন। বাঙালি যতদিন থাকবে, তার আবহমান সংস্কৃতিও থাকবে।’
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান। মঞ্চে ছিলেন পরিষদের কো- চেয়ারম্যান কল্পনা লালা, হেলাল উদ্দিন, হাসান মুরাদ বিপ্লব, হাসান জাহাঙ্গীর, সাজ্জাত হোসেন, শাহাদাৎ নবী খোকা, আকতারী ইসলাম এবং শিলা চৌধুরী। গান, নাচ, একক ও বৃন্দ আবৃত্তিসহ নানা আয়োজন চলে সকালে।
বিকেলে শিল্পী ফকির শাহাবুদ্দিনের একক সঙ্গীত পরিবেশনের কথা রয়েছে এই আয়োজনে।
ছবি: শ্যামল নন্দী
সারাবাংলা/আরডি