একটি ব্যানার, অতঃপর কারাগার
৯ জানুয়ারি ২০১৯ ২৩:০৬
।। জামশেদ নাজিম, অতিথি প্রতিবেদক।।
ঢাকা: বশির ঘরামি। পেশায় আইসক্রিম বিক্রেতা। গত ১৩ অক্টোবর প্রতিদিনের মতো আইসক্রিম বিক্রি করতে বের হয়েছিলেন। রাজধানীর অলিগলি ঘুরে বিকেল ৩টার দিকে হাতিরঝিলের ভেতরে মধুবাগ সংলগ্ন ব্রিজের নিচে বসেন বিশ্রাম নিতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয় বৃষ্টি। তা থেকে নিজেকে ও সঙ্গের আইসক্রিম বাক্সকে বাঁচাতে এদিক-ওদিক তাকাতেই দেখতে পান, একটি ব্যানার পড়ে আছে পাশেই। সেটি তুলে নিয়ে বশির ফিরছিলেন রেখে যাওয়া আইসক্রিমের বাক্সের দিকে। কিন্তু বিধিবাম! আইসক্রিম বাক্সের কাছে আর ফিরতে পারেননি তিনি। বরং আটক হয়ে যান পুলিশের হাতে!
বশির ঘরামির আচমকা এভাবে পুলিশের হাতে আটকের কারণ জানা যায় তাৎক্ষণিকভাবেই। জানানো হয়, বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল ও জামায়াতের ছাত্র সংগঠন শিবিরের মিছিলে অংশ নিয়েছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে রয়েছে নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগ রয়েছে। এ সংক্রান্ত মামলার ১ নম্বর আসামি হয়েছে বশির ঘরামির দিন এখন কাটছে কারাগারে। আর তার জামিনের জন্য দুই বছরের সন্তানকে নিয়ে হন্যে হয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন স্ত্রী স্বপ্না। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বলছেন, বশিরের নামে তার গ্রামের বাড়ি থেকে পুলিশের তথ্য এলেই দেওয়া হবে মামলার চার্জশিট।
এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে মামলার রায়ের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছেন বশির। হাতিরঝিল থানায় দায়ের হওয়া ওই মামলায় (নম্বর-৩২) ১ নম্বর আসামিও তিনি।
মামলার এজাহারে বাদী হাতিরঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সঞ্জয় পাল উল্লেখ করেন, রাষ্ট্রের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট করতে সরকারি সম্পদ ও জনসাধারণের জানমালের ক্ষতিসাধন এবং শান্তিপ্রিয় জনমনে আতঙ্ক তৈরির লক্ষ্যে নাশকতার পরিকল্পনাসহ ককটেল বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন আসামিরা। ঘটনাস্থল থেকে একটি তিন ফুট বাই ১৫ ফুট আকৃতির ব্যানার, চারটি বাঁশের লাঠি ও অবিস্ফোরিত ককটেল উদ্ধার করা হয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফুটপাত থেকে কুড়িয়ে নেওয়া ব্যানারের কারণেই গ্রেফতার হয়েছেন বশির ঘরামি। পরে হাতিরঝিল থানার এসআই সঞ্জয় পাল, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) জালাল হোসেন মোল্লা ও খায়রুল ইসলামসহ কয়েকজন কনস্টেবল বশির ঘরামির কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন বলেও অভিযোগ তার পরিবারের। সেই টাকা না দেওয়ার কারণেই ক্ষুব্ধ হয়ে আইসক্রিম বিক্রেতা বশিরকে ১ নম্বর আসামি করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলেও অভিযোগ বশিরের পরিবারের।
বশিরের স্ত্রী স্বপ্না সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিদিন সন্ধ্যার দিকেই বাসায় ফেরেন বশির। তবে ১৩ অক্টোবর তিনি বাসায় ফেরেননি। সম্ভাব্য সব জায়গায় সন্ধান করেও আমরা বশিরের কোনো খোঁজ পাইনি।’
একপর্যায়ে স্বপ্না জানতে পারেন, বশিরকে গ্রেফতার করেছে হাতিরঝিল থানা পুলিশ। তাকে নাশকতার মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। স্বামীকে কারাগার থেকে ছাড়িয়ে আনতে পুলিশের দফতরে দফতরে ধরনা দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। স্বামীর জন্য পুলিশের বিভিন্ন কর্মকর্তার দফতরে ঘুরে বেড়ানোর সময়ই এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে স্বপ্নার সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার এ প্রতিবেদকের।
স্বপ্না সারাবাংলাকে বলেন, ‘বশির আইসক্রিম বিক্রি করে দিন শেষে বাজার আনলেই রান্না শুরু হয়। সেদিন রাতে বশিরের আর কোনো খোঁজ মেলেনি। কয়েকদিন পর পাশের বাড়ির একজনের মোবাইল ফোনে জানানো হয়, বশির হাতিরঝিল থানায় গ্রেফতার হয়েছে। পরদিন থানায় গেলে পুলিশ আইসক্রিমের বাক্স ফেরত দেয় আর বশিরকে আদালতে পাঠায়।’
বশিরের অনুপস্থিতিতে দুই বছরের সন্তানকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন স্বপ্না। পরিবারে বশিরই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হওয়ায় অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতে হয় তাকে। অসুস্থ হয়ে পড়ে সন্তান।
স্বপ্না বলেন, ‘অসুস্থ বাচ্চাটাকে দেখে পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ওর খাওয়া ও চিকিৎসার জন্য ১০ হাজার টাকা দেন। কিন্তু স্বামীকে কারাগার থেকে বের করার কোনো উপায় তো পাচ্ছি না। আমার স্বামী দোষী নয়। তাই শিশু সন্তানের দিকে তাকিয়ে আমার স্বামীকে মুক্ত করতে ব্যবস্থা নিতে সবার কাছে ঘুরছি। নিরুপায় হয়ে টাকার অভাবে ঢাকা ছেড়ে এখন গ্রামে চলে গিয়েছি।’
বশিরের বিরুদ্ধে দায়ের করা নাশকতার মামলায় তাকে ১ নম্বর আসামি দেখানো হলেও তার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি। অথচ তিন নম্বর আসামি হাবীবুর রহমানের পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি। অন্য আসামিদেরও বিএনপির বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) একজন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাজনৈতিক মামলার ক্ষেত্রে ১ নম্বর আসামির আদালতে জামিন পেতে সমস্যা হয়। এ কারণে অনেক সময় পুলিশের কিছু অসাধু কর্মকর্তা বিএনপির নেতাকর্মীদের কাছ থেকে টাকা খেয়ে ১ ও ২ নম্বর আসামি হওয়া থেকে রেহাই দেন। সে ক্ষেত্রে অনেক সময়ই ১ নম্বর আসামি হিসেবে অন্য কাউকে দেখানো হয়।’
এই মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে তদন্তকারী কর্মকর্তা সুব্রত দেবনাথ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বশির ঘরামির গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপা থানায়। তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ওই থানাকে বলা হয়েছে। তারা বশির সম্পর্কে লিখিতভাবে জানালেই মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে।’
বশির ঘরামির বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে মামলার বাদী হাতিরঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সঞ্জয় পাল মামলায় উল্লেখ করেন, বশির ঘরামিকে হাতে শিবিরের ব্যানারসহ গ্রেফতার করা হয়েছিল। প্রাথমিক যাচাই-বাছাই শেষে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তার রাজনৈতিক পরিচয় ও বিস্তারিত তথ্য জানতে পটুয়াখালীর গলাচিপা থানায় পুলিশের পক্ষ থেকে তথ্য থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। থানা থেকে তথ্য পাওয়ার পর এ মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে। অধিকতর তদন্ত ও যাচাই-বাছাই শেষে বশির ঘরামির কোনো দোষ পাওয়া গেলে তাকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হবে।
সারাবাংলা/জেডএন/টিআর