মেয়েটির জীবনে বড় সর্বনাশ হয়েছে!
৮ এপ্রিল ২০১৯ ২১:৪৮
ঢাকা: প্রতারকের হাত থেকে বাঁচতে বাদল হোসেন নামে এক পুলিশ কনস্টেবলের সঙ্গে পরিচয় হয়ে স্বস্তি পেয়েছিল মেয়েটি। কিন্তু সেখানেও শেষ রক্ষা হয়নি তার। কেড়ে নেওয়া মোবাইল ফোন ফিরিয়ে দেওয়া ও প্রেমিকরূপী প্রতারক জয় ঘোষকে ডেকে নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পুলিশ কনস্টেবল যৌন নির্যাতন করেছেন মেয়েটিকে।
পুলিশ কনস্টেবল বাদল হোসেন ওই মেয়েকে নিয়ে যান যাত্রাবাড়ীর ছনটেক দনিয়া এলাকায়। সেখানে দুই পুলিশ সদস্যের বাসায় মেয়েটিকে আটকে রেখে ধর্ষণ করেন বাদল। এর পরের ঘটনা আরও ভয়ঙ্কর।
সোমবার (৮ এপ্রিল) ধর্ষণের শিকার মেয়েটি সারাবাংলাকে জানান তার জীবনে ঘটে যাওয়া সর্বনাশের কথা।
পুলিশ কনস্টেবলের ভয়ঙ্কর আচরণ: সেদিন রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মেয়েটি। মেয়েটি জানান, ৩১ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা। ওইদিন আবদুল গণি রোডে পুলিশ কন্ট্রোল রুমের সামনে পরিচয় হয় কনস্টেবল বাদলের সঙ্গে। জয় ঘোষের বিষয়ে বিস্তারিত জানার পর ওই মেয়েকে পুলিশ কন্ট্রোল রুমের নিচে বসিয়ে তিন তলায় যান পুলিশের পোশাক খুলে রাখতে। এরপর পোশাক বদল করে তাকে নিয়ে হেঁটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল পর্যন্ত যান। ওইদিন ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল।
পুলিশ কনস্টেবল বাদল বলেন, ‘বাইরে কোথাও বসা যাবে না। চলো, যাত্রাবাড়ীতে যাই। সেখানে দুইজন পুলিশের বাসা আছে। তাদের স্ত্রী-সন্তানও আছে। কোনো সমস্যা হবে না। ভয় করো না। বিশ্বাস রাখো। সেখানে জয় ঘোষকে ডেকে নিয়ে তোমার ফোন দিয়ে দেব।’
মেয়েটি জানায়, সেই সময় তারা কোনো গাড়ি পাচ্ছিলেন না। একটা মোটরসাইকেল ডেকে তারা যাত্রাবাড়ীর দনিয়া এলাকায় যান। সেখানে বাদল ওই মেয়েকে ছয়তলা একটি বাসায় নিয়ে যান। মেয়েটিকে ওই বাসার একটি রুমে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন কনস্টেবল বাদল।
‘আমি বারবার চিৎকার করছিলাম। আপনি কেন আমাকে দরজা বন্ধ করে আটকালেন? আপনি তো বলেছিলেন জয়কে ডেকে আনবেন। তাকে ফোন করেন। আমার ফোন উদ্ধার করে দেন। না হলে আমার বাবাকে ফোন করেন। আমাকে যেতে দেন। আপনি আমার বাবার মতো। আপনি তো পুলিশ। আপনাকে অনেক বিশ্বাস করেছি। দয়া করে আমাকে ছেড়ে দেন’ বলেন মেয়েটি।
তখন বাদল হোসেন ধমক দিয়ে বলেন, ‘চুপ। কোথাও যেতে পারবি না। যা হবে কাল সকালে হবে। এরপর তাকে যৌন নির্যাতন করে কনস্টেবল বাদল।’
‘রাত ১টার দিকে আমি ওনাকে বলি এখন আমাকে ছেড়ে দেন। এরপরেও তিনি ছাড়েননি। আমি চিৎকার করছিলাম কিন্তু কেউ আমার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। এরপর আর কিছু বলতে পারি না। মনে হয়, খাবারের সঙ্গে কিছু একটা মিশিয়ে দিয়েছিল। সকাল সাড়ে ৬টার দিকে টের পাই। এরপর বাদল হোসেন জয় ঘোষকে ফোন করে গুলিস্তানে আসতে বলে। আমাকে নিয়ে আবার গুলিস্তানে নিয়ে নামিয়ে দিয়ে বাদল চলে যায়। জয়ের সঙ্গে দেখা হলে তার মোবাইল থেকে বাবা-মাকে কল করলে তারাও গুলিস্তানে চলে আসে। ঘটনা খুলে বললে, শাহবাগ থানা পুলিশ জয় ঘোষকে আটক করে।
ধরাছোঁয়ার বাইরে সহায়তাকারী দুই পুলিশ সদস্য: থানায় মেয়েটি মামলা করতে গেলে পুলিশ মেয়েটিকে বোঝায়, তুমি যে পুলিশের সঙ্গে ছিলে তা ভুলেও কাউকে বলবে না। পুলিশের বাসায় ছিলে সেটাও বলবে না। তোমার অনেক ক্ষতি হবে। এমনি নাম বলো। আসামি পুলিশ সদস্য সেটা বলো না। এ কারণে এজাহারে বাদলের পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি যারা (ওই দুই পুলিশ সদস্য) ধর্ষণে সহযোগিতা করল তারাও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেল।
মেয়েটির বাবা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ধর্ষণে সহায়তা করায় জয়ের সহযোগী জামালকেও গ্রেফতার করে শাহবাগ থানা পুলিশ। অথচ যাত্রাবাড়ীতে যে দুই পুলিশ সদস্যের বাড়িতে তাদের সহায়তায় সারারাত মেয়েটাকে নির্যাতন করা হলো, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকল! এমনকি এজাহারেও বাদলের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। ওই দুই পুলিশ সদস্য আর তাদের স্ত্রীরা যদি সহযোগিতা না করত বা তারা যদি থানায় ফোন করত তাহলে মেয়েটির এত বড় সর্বনাশ হতো না।’
যেখান থেকে ঘটনার শুরু: জয় ঘোষের (ডাক নাম অর্ক) সঙ্গে প্রায় দুবছর আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পরিচয় হয় মেয়েটির। দীর্ঘদিন আলাপচারিতার পর গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রথম গুলিস্তান এলাকায় তাদের সাক্ষাৎ হয়। ওইদিন একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে গল্প করে এবং একপর্যায়ে জয় মেয়েটির ফোন নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। তবে সিমটি খুলে দেয়।
কারণ হিসেবে মেয়েটি বলেন, “জয় জানত তাকে আমি পছন্দ করি না। আমার এক বয়ফ্রেন্ড রয়েছে। এই জেদে সে ফোনটা নিয়ে নেয়। এরপর অনেক কাহিনি ঘটে যায়। আমার বন্ধুদের ফোন করে বাজে বাজে কথা শোনায়। দেখা না করলে পোস্টারিং করবে এটা সেটা। সে বলে, ‘মাত্র ২০ মিনিট কোথাও বসে কথা বলবে।’ তার অনুরোধে গত ২৬ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে মাকে বন্ধুর জন্মদিনের কথা বলে বের হই। ওয়ারী থানার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক সিএনজিতে (জয়ের পাঠানো) উঠে ১০ মিনিটের পথ যায় একটি বাস টার্মিনালে। কিন্তু সেটি কোন টার্মিনাল তা বুঝতে পারি না। এরপর একটা বাসে উঠি দুজনে। ওই বাসে আর কোনো যাত্রী ছিল না। কাউকে উঠতেও দিচ্ছিল না। শুধু আমরা দুজন আর হেলপার-চালক। একটা সময় দেখলাম বাইরে টঙ্গী লেখা। সেখান থেকে আরও কিছুদুর গিয়ে দেখি, ঘোড়াশাল ব্রিজ লেখা। সেখানে নামিয়ে দিয়ে বাস চলে যায়। সেখান থেকে একটা সিএনজি নিয়ে নরসিংদী যাই। ওখান থেকে আরেক সিএনজিতে করে ভৈরব পৌঁছানো হয়। একটা খাবার দোকানে কিছু খাবার নিয়ে পাশেই একটি বাসার ৫ তলার ওপরে ওঠে। সেখানে একটি রুমে ঢোকে। আমি ঢুকতে না চাইলেও কোনো সমস্যা নেই বলে ভেতরে প্রবেশ করায়। বলে খাওয়া শেষ করো। একটু গল্প করে তোমাকে আবার পৌঁছিয়ে দেব।”
‘আমি খেতে শুরু করলে পেছন দিকে সে দরজা লাগিয়ে দেয়। এরপর আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। ঘর অন্ধকার ছিল। সেই আমার থেকে নেওয়া মোবাইল ফোনটি জানালার কাছে লাইট জ্বালিয়ে রাখে। পরে বুঝতে পারি, আসলে ওইদিন ভিডিও অন করে রেখেছিল। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ভৈরব বাস টার্মিনালে এসে আমাকে একা গাড়িতে তুলে দেয়। এর কয়েকদিন পর শুরু হয় জয়ের অত্যাচার। সাতদিন পরেই ডাকে তার সঙ্গে দেখা করার চাপ দেয়। রাজি না হলে ভিডিও ক্লিপস পাঠায়। সেটা ফেসবুকে ছড়িয়ে দেবে বলে ভয় দেখায়। এভাবে তার কথা রাখতে গিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসের ২৫ তারিখ পর্যন্ত ফকিরাপুল এলাকার বিভিন্ন হোটেলে আরও অন্তত ১৫ দিন সাক্ষাৎ করতে হয়েছে।’
ওই মেয়ে বলেন, ‘প্রতিবারই জয় শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছে। পুরো মার্চ মাস তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিই। নতুন সিম কার্ড তুলে আনি। ফেসবুকেও আসি না। এর মধ্যে জয় অনেক বন্ধুকে ভিডিও ফুটেজ ও নোংরা ছবি পাঠিয়েছে। এক বান্ধবীকে বলেছে, সে যদি শেষবারের মতো আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে তাহলে তার বাবা-মায়ের কাছে সবকিছু বলে দেবে। ওই বান্ধবী এসে ম্যানেজ করে বলে, দেখ শেষবারের মতো একবার সাক্ষাৎ কর। না হলে তোর বাবাকে বললে, স্ট্রোক করতে পারে।’
‘তখন সে বাধ্য হয়ে ৩১ মার্চ তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রাজি হই। ওই দিন দুপুরে কমলাপুরে যায়। সেখান থেকে জয় মেয়েটিকে রিকশায় করে নিয়ে সেগুনবাগিচা দিয়ে শাহবাগ এলাকায় যায়। সেখানে একটি নোংরা বস্তির মতো ঘরে নিয়ে যায় গল্প করার কথা বলে। ঘরে প্রবেশ করতেই বাইরে থেকে কে যেন দরজা লাগিয়ে দেয়। এরপর সেখানেও নির্যাতন করে। সেখানেও ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভিডিও করে জয়। এখানেও মেয়েটির কাছে থাকা মোবাইল ফোনটি কেড়ে নেয়। সেখান থেকে বেরিয়ে মেয়েটিকে বিয়ে করবে বলে জানায়’ মেয়েটি।
তখন মেয়েটিকে বলে, ‘চলো বাসায় যাই। বাসায় যাওয়ার কথা বলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ছাদে নিয়ে যায়। সেখানে গল্প করে একপর্যায়ে বাসায় যাওয়ার কথা বলে আব্দুল গণি রোডে পুলিশ কন্ট্রোল রুমের সামনে নামিয়ে দিয়ে ফোন নিয়ে চলে যায়। এরপর পুলিশ সদস্য বাদলের খপ্পড়ে পড়তে হয়।’
মেয়েটির মা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার কাছে মেয়ে যদি কোনোভাবে কথাগুলো শেয়ার করত তাহলে এত বড় ঘটনা ঘটত না। মেয়েকে ভয় দেখিয়ে কতবড় সর্বনাশ করেছে। আমি ওদের বিচার চাই।’
শাহবাগ থানার এসআই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহসীন মিয়া বলেন, ‘মামলার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ কনস্টেবল বাদলের নাম বেরিয়ে আসে। আর তখনই তাকে মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে গ্রেফতার করে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।’
জয় ঘোষ ধর্ষণের কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। জামালও সহযোগিতার কথা স্বীকার করেছে, জানান তদন্ত কর্মকতা মোহসীন মিয়া।
অন্যদিকে যাত্রাবাড়ী থানার এসআই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সুব্রত কুমার বলেন, ‘আসামি বাদল হোসেন পুলিশের প্রটেকশন বিভাগে কর্মরত ছিলেন। তাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তিনি ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন।’
সহযোগিতাকারীদের আইনের আওতায় আনবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারা জায়গা দিয়েছে। আদালত চাইলে তাদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’
ওই দুই পুলিশ সদস্য কোথায় চাকরি করেন জানতে চাইলে এসআই বলেন, ‘তারা দুজনই ডিএমপি সদর দফতরে চাকরি করেন। ওই বাসায় গিয়ে সমস্ত আলামত জব্দ করা হয়েছে।’
সারাবাংলা/ইউজে/একে