Friday 17 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কাভার্ডভ্যানে ইয়াবা কুঠুরি, দিনমজুর-পানবিক্রেতা এখন কোটিপতি


১ মার্চ ২০১৮ ১৬:০৮ | আপডেট: ৪ মার্চ ২০১৮ ১৫:২১

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, চট্টগ্রাম ব্যুরো 

চট্টগ্রাম: তিন-চার বছর আগেও কেউ ছিলেন গ্রামের দিনমজুর, কেউ পানবিক্রেতা, কেউ অটোরিকশার চালক। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। কিন্তু হঠাৎ করে, অনেকটা আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ পাওয়ার মতো করে বদলে গেছে তাদের জীবন। এখন তাদের হাতে অনেক টাকা। একেকজন কোটিপতি বনে গেছেন। জীবন-যাপন পাল্টে গেছে।
সারাবাংলা জেনেছে, তাদের এই নতুন জীবনের পেছনে আছে ইয়াবা।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম টু ঢাকা ইয়াবা সরবরাহ করেন তারা। যার মধ্য দিয়ে এখন ধনাঢ্য পরিবহন ব্যবসায়ী। গ্রামে প্রত্যেকেই বিলাসবহুল বাড়ি বানিয়েছেন। শহরে এলে ফাইভস্টার হোটেলই তাদের ঠিকানা।

গত বছরের ২০ নভেম্বর নগরীর বাকলিয়ায় এলাকায় কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে আসা একটি কাভার্ড ভ্যানে তল্লাশি করে ১ লাখ ২০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গ্রেফতার করা হয় চালকসহ তিনজনকে। এই মামলা তদন্ত করতে গিয়ে ইয়াবা ব্যবসা করে কোটিপতি হওয়ায় অন্তঃত সাতজনের তথ্য মিলেছে, যারা শুধুমাত্র ইয়াবা ব্যবসা করে এখন কোটিপতি। তাদের গ্রেফতার করতে চেষ্টা চালাচ্ছে ডিবি। একই সঙ্গে চলছে ইয়াবা ব্যবসার শেকড়ের খোঁজ।

এ বিষয়ে নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, কাভার্ড ভ্যানে তল্লাশির সময় গ্রেফতার হওয়া তিনজনের তথ্যের ভিত্তিতে হাসান নামে আরেকজনকে আটক করা হয়েছে। তার কাছ থেকেই মূলত আমরা ইয়াবা কিভাবে সরবরাহ করে, কাদের কাছে যায়, কি অংকের টাকা লেনদেন হয়, কারা এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রাঘববোয়াল কারা এসব তথ্য পেয়েছি।

তদন্তের মাধ্যমে আমরা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের রুট পর্যন্ত পৌঁছাতে চাই, বলেন এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

বিজ্ঞাপন

হাসানকে গত ১ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের রামু উপজেলা থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ৪ ফেব্রুয়ারি আদালতে জবানবন্দি দেন তিনি।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. কামরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, অটোরিকশা চালক এই হাসানের দেওয়া তথ্য এবং আরও তদন্তে আমরা টেকনাফের পানবিক্রেতা করিম, বাসচালকের সহকারী আমির, দিনমজুর শফিক ও জমিরের সন্ধান পেয়েছি। এদের প্রত্যেকেই একই ইয়াবা সিন্ডিকেটে রয়েছে। এবং প্রত্যেকেই এখন কয়েক কোটি টাকার মালিক।

শাহজাহান নামে একজন কাভার্ড ভ্যান চালক রয়েছে, যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে জানিয়ে পুলিশ পরিদর্শক সারাবাংলাকে জানান, শাহজাহানও কয়েক কোটি টাকার মালিক। এছাড়া আনোয়ার হোসেন বাবু নামে একজন ট্রান্সপোর্ট ব্রোকার ইয়াবা পাচার করে এখন কোটিপতি।

এদের প্রত্যেকের এলাকায় গিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ খোঁজ খবর নিয়েছে। তারা দেখতে পেয়েছে, এদের সকলেরেই গ্রামে বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে।

এই ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগ সময়ই কাটছে টেকনাফে এলাকায়। তবে কখনও কক্সবাজার শহরে গেলে ফাইভ স্টার হোটেলে ওঠার মতো ডকুমেন্টও গোয়েন্দোদের কাছে রয়েছে।

‘চট্টগ্রাম শহরে এলে খুলশীতে অভিজাত রেস্টহাউজে থাকেন এই ব্যবসায়ীরা। তবে তারা নিজেরা ইয়াবা সেবন করেন না। এমনকি কখনো ইয়াবা ছুঁয়েও দেখেন না,’ বলেন কামরুজ্জামান।

তদন্ত টিমের সদস্য নগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মোহাম্মদ মহসীন সারাবাংলাকে জানান, প্রায় তিন বছর আগে টেকনাফের ৪-৫ জনের এই সিন্ডিকেট মিয়ানমার থেকে ১-২ হাজার ইয়াবা এনে খুচরা বিক্রি শুরু করে। ঢাকার ইয়াবা বিক্রেতারা তখন সরাসরি টেকনাফে গিয়ে ইয়াবা কিনে নিয়ে যেত। ঢাকার পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হলে টেকনাফের বিক্রেতারা নিজেরাই পাঠাতে শুরু করেন। তারা প্রথমে বাসের চালক-সহকারী দিয়ে পাঠাতে থাকেন। কিন্তু বাসে তল্লাশির মাধ্যমে ইয়াবাগুলো ধরা পড়ে যাচ্ছিল। পরে তারা কৌশল পাল্টান।

মহসীন জানান, তারা জানতে পেরেছেন, শাহজাহান, হাসান এবং শফিক মিলে নিজেরাই ইয়াবা পরিবহনের পরিকল্পনা করেন। পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে চট্টগ্রাম শহরের পরিবহন ব্রোকার আনোয়ার হোসেন বাবু এই পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে তাদের কাভার্ড ভ্যান কেনার পরামর্শ দিলেন। ইয়াবা বিক্রির টাকা দিয়ে তারা একটি কাভার্ড ভ্যান কিনে ফেলেন। বাবু সেটা চালানোর দায়িত্ব নেন।

জহির মিস্ত্রি নামে একজন কাভার্ড ভ্যানের ভেতরেই ইয়াবা রাখার বিশেষ খোপ বানিয়ে দেন বলেও তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের হাতে।

এভাবেই দুই বছর আগে কাভার্ড ভ্যানের মাধ্যমে ইয়াবা পাচার শুরু হয়। এক বছরের মধ্যেই অবৈধ এই ব্যবসা ফুলে ফেঁপে অনেক বড় হয়। কালাম, শফিক, হাসান ও আমির মিলে মোট ৪টি কাভার্ড ভ্যান কিনে নেন। আর সবগুলোতেই রয়েছে ইয়াবা পরিবহনের বিশেষ ব্যবস্থা। সেগুলোর মাধ্যমে ইয়াবা ঢাকায় নেওয়া চলতে থাকে।

ডিবি’র উপ-পরিদর্শক আব্দুর রব সারাবাংলাকে বলেন, কাভার্ড ভ্যানে শুধু যে এই চক্রের ইয়াবা ঢাকায় যেত, তা-ই নয়, ইয়াবা সিন্ডিকেটগুলোর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের ভিত্তিতে অন্যদের ইয়াবাও পরিবহন করা হতো এসব ভ্যানে। কারো ৫০ হাজার, কারো ২০ হাজার, কারো ৫ হাজার পিস ইয়াবার চালান যেতো এসব কাভার্ড ভ্যানে।

গোয়েন্দারা জানান, এসব চালানের আলাদা আলাদা প্যাকেটে আলাদা শনাক্তকরণ চিহ্ন দেওয়া থাকে।

এই পরিবহন ব্যবস্থায় শাহজাহান মূল চালক। তবে গাড়ি চালানোর দায়িত্ব তার নয়। গাড়ি চালাতে ড্রাইভার নিয়োগ করা হতো। তবে ঢাকার পার্টির কাছে ইয়াবা হস্তান্তরের মূল দায়িত্ব থাকে শাহজাহানেরই হাতে।

পুলিশের পরিদর্শক কামরুজ্জামান সারাবাংলাকে জানান, তারা হিসাব কষে দেখেছেন, কিংবা জিজ্ঞাসাবাদে জেনেছেন, একবার যদি একটি কাভার্ড ভ্যান ইয়াবা নিয়ে ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে তাতেই ১০ লাখ টাকা আয় হয় এই সিন্ডিকেটের। যার প্রায় অর্ধেক যেতো শাহজাহান ও তার সহকারীদের পকেটে। বাকি অর্ধেক কাভার্ড ভ্যানের মূল মালিক ও ব্রোকার আনোয়ারের লোকেরা ভাগাভাগি করতো।

মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের মাধ্যমে ইয়াবা নেওয়ার আগেই অর্ধেক টাকা দিয়ে দিতে হয় টেকনাফের ব্যবসায়ীদের। বাকি টাকা চালক শাহজাহান সংগ্রহ করে নিয়ে যান, এমনটাই জানেন গোয়েন্দারা।

ঢাকায় চালনের মোকাম আশুলিয়া বেড়িবাঁধ। মাসে অন্তত তিনটি ট্রিপ নিশ্চিত থাকে প্রতিটি কাভার্ড ভ্যানের । তাতে চক্রের সদস্যদের একেকজনের ভাগে অন্তত পাঁচ লাখ টাকা করে আসে। ফলে মাত্র দুই বছরেই তারা প্রত্যেকেই এখন কোটিপতি, বলেন পুলিশের পরিদর্শক কামরুজ্জামান।

‘গত তিন বছর ধরে এই প্রক্রিয়ায় ইয়াবার ব্যবসা করে এলেও এই চক্র ছিলো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এতদিন পর্যন্ত ইয়াবা নিয়ে যারা আটক হয়েছে তারা মূলত বহনকারী। এই প্রথম আমরা মূল ব্যবসায়ীদের নাগাল পেয়েছি,’ বলেন তিনি।
কামরুজ্জামান বলেন, চক্রটি এতই সতর্ক যে, কাভার্ড ভ্যান তিন-চার মাস পরপর বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রি করে দেয়। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতেই তাদের এই কৌশল।

ডিবি পরিদর্শক মোহাম্মদ মহসীন সারাবাংলাকে বলেন, একটি চক্রের সন্ধান আমরা পেলাম। তদন্তের মাধ্যমে এভাবে আরও কয়েকজন মূল গডফাদারের সন্ধান আমরা পাবো বলে আশা করছি। তাদের গ্রেফতারে আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি।

সারাবাংলা/আরডি/এমএম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর