Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অভাব-হতাশা, দাম্পত্য কলহে মায়ের হাতে খুন হয় প্রিয় সন্তান!


২৪ মে ২০২০ ১৩:২৬

ঢাকা: বলা হয় মায়ের কোল শিশুদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু এমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে যে, সন্তান হত্যায় সরাসরি অংশ নেন মা কিংবা হত্যাকাণ্ডের নেপণ্যে থাকেন গর্ভধারিণী মা। আবার আদরের সন্তান হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে সেই গর্ভধারিণী মাকে দাঁড়াতে হয় আদালতের কাঠগড়ায়।

সন্তান হত্যার অপরাধে বিচার শেষে সাজা ভোগ করছেন অনেক নারী। কিন্তু কেন মায়েদের হাতে খুন তার আদরের সন্তান? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পারিবারিক অভাব অনটন, হতাশা, দাম্পত্য কলহ, মানসিক সমস্যার কারণে শিশু হত্যার মতো ঘটনা ঘটে।

বিজ্ঞাপন

শিশু হত্যার পেছনে তার মায়ের হাত থাকার কিছু কারণ উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা জানান, সামাজিক সহিংস মনোভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় শিশু নির্যাতন বেড়েছে। যার ফলে শিশু হত্যার মতো ঘটনা যে কোনো মানুষের হাতেই হতে পারে! সেটি গর্ভধারিণী মা হোন কিংবা অন্য কেউ। সামাজিক-পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে এ সব ঘটনা ঘটছে বলে তারা দাবি করছেন।

চলতি বছরের ৭ মার্চ রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার দক্ষিণ গোড়ানে মেহজাবিন আল্ভী (১১) ও জান্নাতুল ফেরদৌস (৬) দুই শিশুকে গলা কেটে হত্যার অভিযোগ ওঠে আক্তারুন্নেসা পপি (৩৫) নামে এক মায়ের বিরুদ্ধে। হত্যার পর শিশুদের মৃতদেহ পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। পরে তিনি নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এতে তার শরীরের ১৮ শতাংশ পুড়ে যায়।

ওই ঘটনায় ঐদিন রাতে স্ত্রীর বিরুদ্ধে খিলগাঁও থানায় মামলাটি করেছেন স্বামী বিপ্লব। পপি অভিযোগ করে জানান, স্বামী সংসার খরচ না দেয়ায় হতাশায় দুই মেয়েকে খুন করেছেন তিনি।

২০১৯ সালের ২২ ডিসেম্বর মোহাম্মদপুর থানার রায়েরবাজার এলাকার মোকাব খান রোডের ডাস্টবিনে এক নবজাতক ছেলের লাশ পাওয়া যায়।

বিজ্ঞাপন

ওই ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়। মৃত নবজাতকের পরিচয় শনাক্ত করতে ঐ বছরের ২৪ ডিসেম্বর মৃত নবজাতকের মা সন্দেহে নার্গিসকে আটক করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে নার্গিস জানান, প্রেম করে শামীমকে বিয়ে করেন তিনি। পরে জানতে পারেন, শামীমের আরও তিনজন স্ত্রী আছে।

পরবর্তীতে গত ২০ ডিসেম্বর প্রসববেদনা উঠলে টয়লেটে গিয়ে একা একা বাচ্চা প্রসব করেন নার্গিস। বাচ্চাটির গলা টিপে মেরে লাশ গোপন করার জন্য পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দেন। মামলাটি তদন্তাধীন।

২০১৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি রামপুরায় দুই ভাইবোনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। স্বজনদের দাবি ছিল, রেস্তোরাঁর খাবার খেয়ে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। দুই সন্তানের মরদেহ মর্গে রেখে মা-বাবার গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ায় এ ঘটনা নিয়ে রহস্য ঘণীভূত হয়। এরপর লাশের ময়নাতদন্তে দুই শিশুকে শ্বাসরোধে হত্যার আলামত পান চিকিৎসকরা।

এ ঘটনায় মাহফুজার স্বামী আমান উল্লাহ বাদী হয়ে তার স্ত্রী মাহফুজা মালেককে একমাত্র আসামি করে রামপুরা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

একই বছরে মামলাটির তদন্ত করে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক লোকমান হাকিম মাহফুজা মালেককে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন। মামলাটি ঢাকা মহানগর ৪র্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে। মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। মামলায় ৩৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ২০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর সাইফুল ইসলাম হেলাল জানান, সাক্ষ্যগ্রহণ প্রায় শেষ পর্যায়ে। কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়েই সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হবে। যত দ্রুত সম্ভব রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মামলাটির বিচারকাজ শেষ করার চেষ্টা করছে। আশা করছি, মামলার আসামির সর্বোচ্চ সাজা হবে।

২০১৬ সালের ১৮ এপ্রিল রাজধানীর উত্তরখানে মাস্টারপাড়া একটি বাসায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে দেড় বছরের শিশু নিহাল সাদিককে হত্যা করে মা মাহমিদা মীর মুক্তি। শিশুটির বাবা সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন মুরাদ মুক্তিকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন।

শিশু নিহালকে হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন মা মুক্তি। স্বামীর সঙ্গে কলহের জেরে সন্তান হত্যার পর মুক্তি নিজে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন বলে দাবি করেন তিনি। বর্তমানে বিচারাধীন।

২০১২ সালের ২৫ অক্টোবরন মামলাটির তদন্ত শেষে আদাবর থানার ওসি কাজী শাহান হক দুই জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। বর্তমানে মামলাটি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক শেখ নাজমুল আলমের আদালতে বিচারাধীন।

মামলাটির সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট আদালতের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর ফারুক উজ-জামান ভূঁইয়া জানান, মামলাটি প্রায় শেষের দিকে চলে আসছে। গত ৫ এপ্রিল যুক্তিতর্ক শেষ হয়ে গেলে ৮/১০দিনের মধ্যে মামলাটির রায় হয়ে যেত। করোনাভাইরাসের জন্য কিছুটা বিলম্বিত হচ্ছে। আশা করছি আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা পাবে রায়ের মধ্যে দিয়ে।

২০১০ সালের ২৩ জুন প্রেমিক শামসুজ্জামান আরিফ ওরফে বাক্কুর সঙ্গে মা আয়েশা হুমায়রা এশার অনৈতিক সম্পর্কের কোনো ঘটনা দেখে ফেলায় শিশু শামিউলকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। এরপর লাশ গুম করতে ঢোকানো হয় ফ্রিজে। পরদিন লাশটি বস্তায় ঢুকিয়ে ফেলে দেওয়া হয় রাস্তায়।

ওই ঘটনায় শামিউলের বাবা আর আজম (৪২) আদাবর থানায় হত্যার অভিযোগে এশা এবং বাক্কুর বিরুদ্ধে মামলা করেন। বাক্কু ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন।

এ বিষয়ে ঢাকা নিম্ম আদালতের সিনিয়র আইনজীবী মাহবুবুল হক জানান, শিশুদের জন্য পৃথিবীর সব চেয়ে নিরাপদ স্থান হচ্ছে মায়ের কোল। কিন্তু সেই জায়গায়টায় এখন আর নিরাপদ নেই। সামান্য ইস্যুতেই নিজের শিশুকে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করছেন না বাবা-মা। মূলত নৈতিক অবক্ষয়, ধর্মীয় অনুশাসনের অভাবের এ সব ঘটনা ঘটে চলেছে। এ ছাড়াও পারিবারিক দাম্পত্য কলহের জের থেকেও মায়ের হাতে শিশু হত্যাকাণ্ড ঘটছে।

এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আইনুন নাহার সিদ্দিকা সারাবাংলাকে বলেন, ‘একজন মা হচ্ছে সন্তানের জন্য সব চাইতে নিরাপদ একটা স্থান। শুধু সন্তান না একজন ‘মা’ যে কারোই জন্য নিরাপদ স্থান। সেখানে যদি কোনো মা তার সন্তানকে হত্যা করে ফেলে শুধু পারিবারিক কলহ, দারিদ্র্যতা ও পরকীয়া দেখলে চলবে না। আমাদের দেশে একটা জিনিসের প্যাক্টিস নেই সেটা হচ্ছে ক্রিমিনাল মাইন্ড এবং সাইকোলজিক্যাল বিষয়টি স্টাডি করিনা। সাইকোলজিক্যাল দিকটা আমরা পুরাপুরি বন্ধ করে রেখে দিয়েছি। এ জায়গাটা আমাদের বন্ধ। চিন্তা করিনা  আসলে একটা মানুষ ক্রাইম করলো তার সাইকোলজিটা কী?’

তিনি বলেন, ‘কোন পর্যায়ে চলেগেলে বা তার মানসিক অবস্থা বিকল হলে একজন মা তার সন্তানকে হত্যা করতে পারে! এই জিনিসটা আমাদের দেখতে হবে। শুরুতেই আমরা বলে বসে থাকি একজন মা তার শিশুকে হত্যা করেছে না জানি ওই মহিলা কতটুকু খারাপ! সব কিছুতেই আমরা না জেনেই একটা জাজমেন্ট দিয়ে বসে থাকি।

তিনি আরও বলেন, ‘একটা বাচ্চা হওয়ার সময় মায়ের কিছু মানসিক সমেস্যা তৈরী হয়। বাচ্চা ডেলিভারি হওয়ার আগে/পরে নারীদের কিছু হরমোনের পরিবর্তন ঘটে সে বিষয়টি আমরা কখনো চিন্তা করি না। সামাজিক, পারিবারিক অর্থনৈতিক পেশার সব মিলিয়ে মানসিক যে একটা অবস্থা কতটুকু খারাপ হতে পারে সেই জিনিসটা আমরা কখনো চিন্তা করি না।’

এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘মানসিক/ সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট আমরা কখনো দিতে চাই না। আমার মনে হয়, এখন আমাদের সময় এসেছে এই দিকগুলোই চিন্তা করার। আবার সকলের ক্ষেত্রে কিন্ত একই ধরণ না। অনেকেই কাটিয়ে ওঠতে পারলেও অনেকেই পারেন না। অনেক মা এক্সিডেন্টলি বেঁচে যান। দেখে গেছে পারিবারিক চাপ না নিতেই মা আত্মহত্যা পথ বেছে নিয়েছেন, তখন তিনি ভাবছেন আমি মরে গেলে সন্তানের কী হবে? সেই দিকটা চিন্তা করে একসঙ্গে সুইসাইড করার চেষ্টা করেন। পরে দেখা যায় যে মা বেঁচে গেছেন কিন্তু শিশুটা মারা গেছেন।’

খুন মায়ের হাতে খুন শিশু হত্যা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর