Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রশ্নফাঁস ঠেকাবে প্রযুক্তি!


১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৯:৪৭

মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: লিক ট্র্যাকার, রিমোট আনলক, পিন নম্বর। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে প্রযুক্তিনির্ভর এই শব্দগুলো উচ্চারিত হচ্ছে এখন। ধারণা করা হচ্ছে এর মাধ্যমে ঠেকানো যাবে দেশে মহামারির মত ছড়িয়ে পড়া ব্যাধি- প্রশ্নপত্র ফাঁস।

প্রথম শ্রেণির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের মত ঘটনাও বাংলাদেশে ঘটেছে। আর এবারের এসএসসি পরীক্ষায় শিক্ষামন্ত্রীর সকল চ্যালেঞ্জকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে ফাঁস করা হয়েছে সবগুলো পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ালে ফাঁস প্রতিরোধে সরকারের নিষ্ক্রিয়তাই দেখছেন হাইকোর্ট। বৃহস্পতিবার এ নিয়ে রুল জারি হয়েছে। গঠিত হয়েছে বিচার বিভাগীয় ও প্রশাসনিক কমিটি। এ অবস্থায় এগিয়ে এসেছেন প্রযুক্তিবিদরা। রিমোট আনলক স্মার্টবক্স নামের একটি প্রযুক্তির কথা বলছেন, যার মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করা সম্ভব বলেই মনে করছেন তারা।

প্রযুক্তিকর্মীরা বলছেন, ছাপা থেকে ‍শুরু করে পরীক্ষা শুরু পর্যন্ত এই প্রযুক্তির ব্যবহারে প্রশ্নপত্রের ওপর সার্বক্ষণিক মনিটরিং সম্ভব। এজন্য প্রশ্নপত্র প্যাক করা হবে একটি স্মার্টবক্সে। যা আনলক করার ক্ষমতাও থাকবে নিয়ন্ত্রিত। রিমোট আনলক স্মার্ট বক্স নামের এই বক্সগুলো খুলতে ব্যবহার করা হবে বিশেষ পিন নম্বর। যা কেন্দ্রগুলোতে পাঠানো হবে পরীক্ষা শুরুর আধাঘণ্টা কিংবা তার কম সময় আগে। ফলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের আর কোনও সুযোগ থাকবে না।

এছাড়া থাকবে বিশেষ অ্যালার্ম সিস্টেম। মাঝপথে কেউ প্রশ্নপত্রের বাক্স খুলতে চেষ্টা করলে সিগন্যাল যাবে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। ফলে প্রশ্ন ঢুকিয়ে একেকটি বক্স প্রস্তুত করা থেকে শুরু করে তা পরীক্ষার হলে খুলে নেওয়া পর্যন্ত প্রতি সেকেন্ডে রিয়েল টাইম মনিটরিং করার সুবিধা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারবে এ পদ্ধতি।

বিজ্ঞাপন

প্রচলিত সকল পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করতে সরকার যেভাবে ব্যরথ তাতে প্রযুক্তি নিরভর এই পদ্ধতির বিষয়ে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট অনেকেই।

এরই মধ্যে অনেকটা একই পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা সম্ভব হয়েছে মেডিকেল কলেজগুলোর ভর্তি পরীক্ষায়। প্রযুক্তিবিদদের দাবি, অপেক্ষাকৃত বৃহৎ পরিসরের এসএসসি, এইচএসসি, জেএসসি, পিইসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধেও তাদের এ প্রযুক্তি কাজ করবে।

এরই মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়েসহ কয়েকটি দেশে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে এই প্রযুক্তির ব্যবহার হয়েছে বলে সারাবাংলাকে জানিয়েছেন এই প্রযুক্তি সামনে নিয়ে আসা প্রতিষ্ঠান বন্ডস্টেইন-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর শাহরুখ ইসলাম।

তবে এ পদ্ধতির অসুবিধার দিকটিও জানিয়েছেন তারা। বলেছেন, বিষয়টি মোবাইল নেটওয়ার্কের কানেক্টিভিটির উপর আংশিকভাবে নির্ভরশীল। ফলে একটি সুসমন্বয়ের প্রয়োজন হবে। এছাড়া প্রযুক্তিটি ব্যয়বহুলও বটে।

শাহরুখ ইসলাম সারাবাংলাকে জানান, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করলে দেশের তিন হাজার পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রশ্ন পাঠাতে খরচ হবে ত্রিশ কোটি টাকা।

সরকার সংশ্লিষ্টরা এরই মধ্যে বলতে শুরু করেছেন, প্রচলিত পদ্ধতিতে প্রশ্নফাঁস ঠেকানো সম্ভব নয়। নতুন কোনো পদ্ধতি খুঁজছেন তারা। তবে সে পদ্ধতি কি সে বিষয়ে সঠিক কোনো ধারণা নেই তাদের। এই যখন অবস্থা তখন প্রযুক্তিনির্ভর এই ব্যবস্থা খরচান্ত হলেও অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

চলতি এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে প্রতিদিনই। ফাঁসকারী বিভিন্ন চক্র বিশাল অংকের টাকা লুটে নিচ্ছে রাতারাতি। ফাঁস ঠেকাতে সরকার ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি করলেও এ ক্ষেত্রে বড় কোনো সাফল্য আসেনি। কোথাও কোথাও চক্রের দুয়েকজন ধরা পড়ছে ঠিকই কিন্তু সর্বনাশ যা হওয়ার তা ঠিক হয়ে গেছে।

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরীক্ষা গ্রহণ একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া হওয়ায় অসাধু চক্র এখান থেকে আর্থিক সুবিধা লুটে নিতে নানা রকম ফন্দি আঁটে। তবে এসবের মূলে থাকে শিক্ষক বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কেউ। তাদের কাছে বিষয়টি ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও প্রযুক্তির কল্যাণে তা ব্যাপকতা লাভ করে। ঘটে বিপর্যয়। প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে হলে আগে পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন।

প্রশ্ন প্রণয়ন পরিবহনের প্রচলিত ব্যবস্থা:

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে সব পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন প্রণয়ন করে থাকেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা। এছাড়া মেডিকেল-বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র তৈরিতে প্যানেল তৈরি করা হয়। ওই প্যানেল একাধিক প্রশ্ন সেট তৈরি করে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কমিটির কাছে জমা দেন। পরে সেখান থেকে পরীক্ষার জন্য এক বা একাধিক সেট নির্বাচন করে নিয়ন্ত্রক কমিটি। সেখানে প্রশ্নফাঁস সম্ভব নয়।

সরকারি পরীক্ষাগুলোর প্রশ্ন ছাপা হয় বিজি প্রেস থেকে। আর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাসহ অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশ্ন ছাপা হয় স্ব স্ব ব্যবস্থাপনায়। সেখানে সরকারের নজরদারি থাকলে প্রশ্ন ফাঁস হয়না।

প্রশ্ন পরিবহন ও সংরক্ষণ স্তরে দেখা যায়, প্রশ্ন ছাপার পর তা কমিটির সরাসরি তত্ত্বাবধানে পুলিশী নিরাপত্তায় তুলে দেওয়া হয় প্রতিটি জেলার ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্বে। ছাপার পর প্রশ্ন বক্সে করে জেলা প্রশাসকদের দায়িত্বে থাকা জেলা ট্রেজারিতে পাঠানো হয়। সেখান থেকে পরীক্ষা শুরুর তিনদিন আগে তা পাঠানো হয় উপজেলা ট্রেজারি কিংবা ব্যাংকের ভোল্টে। এ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই প্রশ্ন সিলগালা করা থাকায় তা ফাঁস হওয়ার সুযোগ থাকেনা।

পরীক্ষার ঠিক আগের দিন দূরত্বভেদে ওইদিন সকালে কেন্দ্র সচিব ও পুলিশের দায়িত্বে প্রত্যেক কেন্দ্রের জন্য প্রশ্ন বিতরণ করা হয়। আর এখান থেকেই ঘটে থাকে বিপত্তি। কেননা এই স্তর থেকেই তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের নাগালের বাইরে চলে যায়।

নিরাপত্তা ঝুঁকি:

প্রশ্নফাঁসের তীব্রতা বৃদ্ধির অন্যতম কারন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা প্রযুক্তি। কিন্তু প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে প্রযুক্তির ব্যবহার খুব বেশি হয় না। পাশাপাশি কখনো কখনো অনিরাপদ ছাপাখানায় প্রশ্ন ছাপার কারনেও প্রশ্নফাঁস হয়। এছাড়া পরিবহন ও কেন্দ্র সচিবের ওপর বিশ্বাসভিত্তিক দায়িত্বের কারণেও প্রশ্নফাঁস হয়ে থাকে। সর্বোপরি সরকারের দূর্বল মনিটরিং ব্যবস্থাও প্রশ্নফাঁসের জন্য অনেকখানি সহায়ক বলে মনে করা হয়।

এ অবস্থায় রিমোট আনলক স্মার্ট বক্সের কথা বলছেন প্রযুক্তিবিদরা। এছাড়াও আরেকটি পদ্ধতির কথা বলা হচ্ছে। তা হলো কেন্দ্রে কেন্দ্রে রিমোট প্রিন্টিং ফ্যাসিলিটি রাখা। কেন্দ্র ভিত্তিক রিমোট প্রিন্টিং ফ্যাসিলিটি থাকলে একটি বাটনের চাপে পরীক্ষার ৩০ মিনিট আগে প্রশ্ন ছাপিয়ে পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। এর সুবিধা হলো মাত্র একটি বাটনের চাপেই কেন্দ্রে বসেই প্রশ্ন ছাপানোর ব্যবস্থা করা। এখানে প্রণয়নকারী ছাড়া আর কারো পক্ষেই প্রশ্ন ফাঁস করা সম্ভব না। তবে এ পদ্ধতিতেও অসুবিধা রয়েছে। এর জন্য ইন্টাারনেট সংযোগ থাকতে হবে। এটাও ব্যয়বহুল ও রক্ষণাবেক্ষণ সাপেক্ষ।

প্রযুক্তিবিদরা আরও যা বললেন:

বন্ডস্টাইনের ব্যবস্থাপণা পরিচালক মীর শাহরুখ ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, প্রশ্নফাঁস ঠেকানোর আগে তা কীভাবে ফাঁস হচ্ছে সে বিষয়ে ভাল করে বুঝতে হবে। মূলত ছাপাখানা ও পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে প্রশ্নফাঁস হয়। এরপর  তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফলে একবার কোনো প্রশ্ন কারো হাতে পড়লে মুহুর্তের মধ্যে সবখানে ছড়িয়ে পড়ে।

তিনি বলেন, প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা সম্ভব। তবে সবার আগে সরকার কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে তারা কোন ধরণের সহায়তা নিতে চায়।

প্রযুক্তিবিদ ফিদা হক বলেন, দেশের ৬৫ ভাগ লোক ২৫ বছরের মধ্যে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর সিংহভাগই মূলত শিক্ষার্থী। সেক্ষেত্রে শিক্ষাখাতে এদেশের বরাদ্দ অনেক বেশি। তবে প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে বাজেট একদম নেই। আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা এভাবে প্রশ্নফাঁস হতে থাকলে বরাদ্দ যতই বাড়ানো হোকনা কেন শিক্ষার মান  বাড়বে না। বরং আমরা একটি কলঙ্কিত জাতি হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃতি পাব।

চাই মানসিকতার পরিবর্তন

প্রশ্নফাঁসের ইতিহাস ঠিক কত পূরণো সে বিষয়ে সঠিক কোনো তথ্য নাই। তবে দেশে সাম্প্রতিককালের প্রশ্নফাঁসের রেকর্ড ইতোমধ্যে আমাদের আন্তর্জাতিকভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় দায় কি কেবল সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের? এমন প্রশ্নে প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, মোটেই না। এর জন্য শিক্ষক-অভিভাবকদের দায় কোনো অংশেই কম নয়।

প্রশ্ন প্রণয়ন থেকে শুরু করে পুরো প্রকিয়ায় যে শিক্ষকরা জড়িত তাদের কাছে প্রশ্নপত্র নিরাপদ না করা গেলে এর সমাধান হবেনা। তবে এরও আগে প্রয়োজন অভিভাবকদের সচেতনতা। তাদেরকে আগে বুঝতে হবে তথাকথিত জিপিএ-৫ সন্তানদের ভবিষ্যত গড়তে পারবে না। তার জন্য প্রয়োজন গভীর জ্ঞান। এজন্য প্রথমে অভিভাবক, তারপর শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। তা না হলে প্রশ্নফাঁসের বাণিজ্যিকিকরণ বন্ধ করা সম্ভব নয়।

কেউ কেউ অবশ্য আরও একটি পদ্ধতির কথা বলেছেন। তাদের মতে, পরীক্ষার আগে একাধিক ভূয়া প্রশ্নপত্র করে তা ব্যাপকভাবে ইন্টারনেটে ছাড়া যেতে পারে। এতে যারা ইন্টারনেটে প্রশ্ন খুঁজছেন তারা সার্চ ইঞ্জিনের অনেক প্রশ্ন যখন পাবেন তখন তাতে বিভ্রান্ত হবেন এবং এক সময় নিজে থেকেই খোঁজা বন্ধ করবেন। ব্যাপকভাবে ভুয়া প্রশ্নপত্র যখন সোশ্যাল মিডিয়ার ঘুরতে থাকবে তখন ধীরে ধীরে এই প্রশ্ন খোঁজার প্রবণতা কমে আসবে।

সারাবাংলা/এমএস/এমএ

 

প্রশ্নফাঁস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর