Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মুনাফার বিষে নীল শীতের ফুলকপি!


২৩ জানুয়ারি ২০১৮ ১০:৪০

আসাদ জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: মাঘের শীতার্ত বিকেল। উত্তরের ঝিরিঝিরি হিমেল হাওয়ায় কদম আলী ঝিলপাড়ের আবাদি জমিতে গাঢ় সবুজ পাতাগুলো বেজায় দুলছিল। চক্রাকারে ঘিরে থাকা পাতার আড়ালে চোখে পড়ে দুধের স্বরের মতো সাদা ফুলকপি। দেখলে মন জুড়িয়ে যায়।

শীতের প্রধান ক’টি সবজির নাম বলতে গেলে ফুলকপির কথা বলতেই হবে। খাওয়ার সময় জিভে যেমন স্বাদ মেলে, একটা মিষ্টি গন্ধও এসে লাগে নাকে। ফুলকপির স্বাদ যারা জানেন, তারা যেন শীতের অপেক্ষাতেই থাকেন।

কিন্তু কোথায় সেই স্বাদ! গাঢ় সবুজ পাতার আবরণে ঢাকা দুধের স্বরের মতো সাদা এই সবজিটি ইদানিং খাবারপ্লেটে পৌঁছতে পৌঁছতে অতি ‘মুনাফা’র বিষে যেন নীল হয়ে উঠছে।

রাজধানী ঢাকার প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে মাণ্ডায় এই কদম আলী ঝিলপাড়। ঢাকা মহানগরের বাইরে সবুজে মোড়ানো এলাকাটি মৌসুমী সবজি চাষের জন্য বিশেষভাবে খ্যাত। সেখান থেকেই বাজারে আসে রাজধানীর চাহিদার অধিকাংশ ফুলকপি।

এবারতো গোটা শীত জুড়ে মৌসুমী সবজি ‘বর্ষার’ দামে কেনার তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে রাজধানীবাসীর। ফুল কপিও চড়া দরে বিক্রি হয়েছে। ভরা মৌসুমেও এর দাম সাধারণের ক্রয় ক্ষমতায় পৌঁছেনি।

শীতের অন্য প্রধান সবজিগুলো, যেমন- শিম, আলু, বাঁধাকপি, লাউ, মুলা, কাচা টমেটো, বিভিন্ন ধরনের শাক স্বল্প  আয়ের মানুষের কাছে কম দামে এবছর ধরা দেয়নি মোটেই।

ক্রেতারাই বলছেন, গত বছরও মাঝারি আকারের একটা ফুলকপি ১৫ থেকে ২০ টাকায় কিনতে পেরেছেন তারা। কিন্তু এবার ৪০ টাকার নিচে নামেনি। একটি ফুলকপি কিনতেই যখন ৪০ টাকা ফুরিয়ে যায়, তখন নিম্নবিত্তের হয়তো এই সবজির স্বাদ আর নেওয়াই হয় না। কেবল ভোজন রসিকেরেই চড়া দামে কিনে খান এই সবজি।

বিজ্ঞাপন

মাণ্ডা কদম আলী ঝিলপাড়ে কপিক্ষেত পরিচর্যার কাজে ব্যস্ত কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানাা গেছে, অন্য যে কোনো সবজির চেয়ে ফুলকপি চাষে সময় ও খরচ তুলনামূলক কম। আশ্বিন-কার্তিক মাসে রোপন করা চারা গাছ থেকে পৌষ-মাঘ মাসেই পরিণত কপি পাওয়া যায়। এ জন্য আবাদি জমি খুব বেশি দিন ব্যস্ত রাখতে হয় না। কম টাকায় মেলে আবাদি জমি।

তাছাড়া প্রতিটি চারা দেড় বা দুই টাকায় কিনে রোপন করলে তিন মাসের মধ্যে সেটির বাজারমূ্ল্য দাঁড়ায় ১৫ থেকে ২০ টাকা। কিন্তু এবার সেটা ৩০ টাকায় পৌঁছেছে। ক্ষেতেই পাইকারি দর বেঁধে দেওয়া হয়েছে ৩০ টাকা। মাণ্ডা কদম আলী ঝিলপাড় থেকে দুই কিলোমিটার দূর মতিঝিল ও আশপাশের এলাকায় পৌঁছনোর পর যোগ হচ্ছে আরো ১০ টাকা। অর্থাৎ ভোক্তার হাতে পৌঁছতে প্রতিটি ফুলকপি ৪০ টাকায় গিয়ে ঠেকছে।

অর্থাৎ উৎপাদনের প্রাথমিক পর্যায় থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত প্রতিটা ধাপে ওঁত পেতে থাকা মুনাফাখোরদের অতিরিক্ত মুনাফার কারণেই সুস্বাদু এই সবজিটি এখন সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

ঝিলপাড় কপিক্ষেতে কাজে ব্যস্ত রহিম আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘শহর থেকে যারা পাইকারি কিনতে আসেন, তাদের কাছ থেকে একেকটা ফুলকপি ৩০ টাকা রাখা হয়। তারা আবার বাজারে নিয়ে ৪০ টাকা করে  বিক্রি করে।’

মাণ্ডা কদম আলী ঝিলপাড় থেকে ফিরে মুগদাপাড়া থানা রোডে কথা হয় ফুলকপি চাষী আতাউর রহমানের সঙ্গে। নিজ হাতে উৎপাদিত কপি ভ্যানে করে বিক্রি করছিলেন তিনি।

আতাউর জানান, ৫ কাঠা জমি ৬ হাজার টাকায় তিন মাসের জন্য লিজ নিয়েছেন। সেখানে ৯ হাজার টাকা খরচ করে তিন হাজার ফুলকপি চারা রোপন করেছেন তিনি। কপিগুলো এখন পরিণত পর্যায়ে পৌঁছেছে। পাইকারি বিক্রির পাশাপাশি বেশি মুনাফা পাওয়ার আশায় প্রতিদিন ভ্যানে করে নিজেও ফুলকপি বিক্রি করছেন আতাউর। বাজার মূল্যের চেয়ে ৫ টাকা কমে প্রতিটি কপি ৩৫ টাকা বিক্রি করায় খরিদদারও তুলনামূলক বেশি পাচ্ছেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সব মিলে ৫ কাঠা জমিতে ২০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে— ৯ হাজার টাকার চারা, ৬ হাজার টাকা জমির লিজ, আর ৫ হাজার টাকা সারা-কিটনাশক-মজুর। এখন যে দামে কপি বিক্রি করছি, সে দামে সব কপি বিক্রি করতে পারলে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা বিক্রি করা যাবে।’

অর্থাৎ মাত্র ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে তিন মাসে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা মুনাফা করতে যাচ্ছেন খণ্ডকালীন চাষী আতাউর রহমান।

আর মান্ডায় ৩০ টাকায় কিনে শহরে তুলেই তা ১০ টাকা বাড়িয়ে ৪০ টাকায় বিক্রি করছেন পাইকাররা।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্পর্শকাতর সবজি হওয়ায় অল্পতেই দাগ পড়ে দাম কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকায় বেশিরভাগ খুচরা বিক্রেতা ঢাকার আশাপাশ থেকেই ফুলকপি সংগ্রহ করেন। ফলে ক্ষেত থেকে বাজার পর্যন্ত পৌঁছাতে খুব বেশি মধ্যসত্ত্বভোগীর আচড় পড়ে না এই সবজিটিতে। তারপরও ঢাকার খণ্ডকালীন চাষী ও খুচরা বিক্রেতারা মিলে অস্থির করে রেখেছে ফুলকপির বাজার।

মুগদাপাড়া কাচাবাজারে কথা হয় খুচরা সবজি বিক্রেতা হাফিজের সঙ্গে। সারাবাংলার কাছে অকপটে স্বীকার করেন, মান্ডা কদম আলী ঝিলপাড় থেকে পাইকারি দরে ২৮ ও ৩০ টাকা করে ফুলকপি কেনেন তিনি। বিক্রি করেন ৪০ টাকা করে। অর্থাৎ প্রতিটা ফুলকপিতে ১০ থেকে ১২ টাকা মুনাফা হয় তার। অন্যান্য সবজির সঙ্গে দিনে ১ শ’টি কপি বিক্রি করতে পারলে ১ হাজার থেকে ১২শ টাকা আয় হয় তার। দিনের কপি দিনেই বিক্রি করার চেষ্টা করেন তিনি।

সারাবাংলাকে হাফিজ বলেন, ‘আজ ১শ’ পিস কপি এনেছি। এরইমধ্যে ৫০/৬০ পিস বিক্রি হয়ে গেছে। বিকেল নাগাদ বাকিগুলো বিক্রি হয়ে যাবে।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের উদাসীনতা এবং উৎপাদক ও খুচরা বিক্রেতাদের সীমাহীন মুনাফা লিপ্সার কারণেই শীতেও সবজি বাজারে স্বস্তির বাতাস নেই।

এ প্রসঙ্গে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘জীবন-যাত্রার মান বেড়ে যাওয়ায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষই বেশি বেশি আয় করতে চায়। যিনি বিক্রি করেন তিনি যেমন বেশি মুনাফা করতে চান, আবার যিনি উৎপাদন করেন তিনিও বেশি মুনাফা করতে চান। মাঝখান থেকে সমস্যায় পড়েন নিম্ন মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষেরা। এ অবস্থার উন্নতি ঘটাতে হবে। নইলে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষেরা তাদের সঞ্চয় হারিয়ে বিপদের মধ্যে পড়ে যাবেন।’

 

সারাবাংলা/এজেড/এমএম

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর