Monday 14 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নতুন স্বপ্নের পাল উড়িয়ে আসছে ‘জাহাজী’


৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৭:০৯
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নদীভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থাই একসময় ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ। অবকাঠামোগত জটিলতা আর নানা অবহেলায় নৌপথে পণ্য পরিবহণে আগ্রহ কিছুটা কমে আসলেও এখনো অনেক ক্ষেত্রে নদীপথই ভরসা। স্বাধীনতার পাঁচ দশকে ভ্যন্তরীণ নৌপথে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা খুব একটা শৃঙ্খলায় আনা যায়নি। ফলে চরম অব্যবস্থাপনায় চলছে এই খাত। পণ্য নিয়ে রওনা করার পর মালিক যেমন জানেন না তার জাহাজ বা ট্রলারটি কখন কোথায় অবস্থান করছে, তেমনি গ্রাহকও জানেন না তার পণ্য কখন এসে পৌঁছাবে। এতে করে অর্থ ও সময়ের অপচয় হচ্ছে উভয় পক্ষেরই।

এই সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশের  অভ্যন্তরীণ নৌপথে পণ্যবাহী জাহাজের জন্য অ্যাপভিত্তিক বুকিং এবং ট্র্যাকিং সেবা নিয়ে এলো ‘জাহাজী’। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌ-রুটে যে পণ্যবাহী জাহাজ চলে সেগুলোকে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রযুক্তি সেবা দেবে এই প্রতিষ্ঠান। আবহাওয়ার পূর্বাভাস, ট্র্যাকিং এবং বুকিং এর ব্যাপারে সাহায্য করবে জাহাজী। ‘জাহাজী’ অ্যাপ ইনস্টল করে একজন সাপ্লায়ার বুকিং সেবার মাধ্যমে জাহাজ ভাড়া, জাহাজের অবস্থান ও ধারণক্ষমতা যাচাই করে লাইটার জাহাজ ভাড়া করতে পারবেন। আর জাহাজমালিক, ক্যারিয়ার এবং সাপ্লায়ার ট্র্যাকিং সেবার মাধ্যমে তাদের জাহাজের ও ট্রিপের সার্বক্ষণিক খোঁজ রাখতে পারবেন।

বিজ্ঞাপন

জাহাজী’র দুজন প্রতিষ্ঠাতা অভিনন্দন জোতদার এবং কাজল আব্দুল্লাহ। চেয়ারম্যান শেখ বাহাউদ্দীন রূপক।  খুলনার ছেলে কাজল এবং অভিনন্দন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। লেখাপড়া শেষ করে কাজল দেশি-বিদেশি নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। বিবিসি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুওয়াই প্রকল্প ছাড়াও কাজ করেছেন. গণহত্যা জাদুঘর, ব্র্যাক এবং আইসিটি ফর ডেভেলপমেন্ট বিভাগে। অভিনন্দন পড়াশোনা শেষে ব্যাংকে কাজ করেছেন কয়েক বছর। দুজনেই কর্মক্ষেত্রে ভালো করার সকল সম্ভাবনা রেখে নিজ শহর খুলনায় গিয়ে শুরু করেন সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এই উদ্যোগ।

সবাই যখন ঢাকামুখী তখন খুলনাতেই কেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শুরু করলেন? জানতে চাইলে কাজল আবদুল্লাহ বলেন, আগামী দশ বছরের মধ্যে খুলনাই হতে যাচ্ছে দেশের অন্যতম অর্থনৈতিক অঞ্চল। পদ্মাসেতু, পায়রা বন্দর, নতুন করে বানানো উন্নত রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা, নদী খনন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ইত্যাদি উন্নয়নমূলক কাজ চলছে জোরেসোরে। মূলত গণহত্যা জাদুঘরের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে খুলনায় ফিরলেও কাজল চাচ্ছিলেন নিজ উদ্যোগে কৃষি নিয়ে কিছু করতে। কিন্তু কিছুদিন পর অনুধাবন করেন, ভেতর থেকে তেমন একটা আগ্রহ পাচ্ছেন না। তথ্যপ্রযুক্তিখাতেই তার মূল আগ্রহের জায়গা।

এরপর নৌ-রুটে লজিস্টিক সাপ্লাইয়ের কাজ শুরু করেন। তখন দেখেন, এই সেক্টরে বাজারব্যবস্থা অনেকটাই অপরিপক্ক ও অগোছালো। এখন যারা আছেন, তারা টাকার হিসেব বুঝলেও কাজের জায়গায় বা ভিশনের জায়গায় বেশ পিছিয়ে।

অভিনন্দন জোতদার এই সেক্টরে আগে থেকেই কাজ করছিলেন। একদিন দুই বন্ধুর সান্ধ্য আড্ডাতেই বের হয়ে আসে এই সেক্টরে প্রযুক্তির অভাবে কতটা খারাপ অবস্থা। তখন তারা ড্যাটা নিয়ে কাজ শুরু করেন। প্রায় দেড় বছর কাজ করার পর তারা বুঝতে পারেন, এই সেক্টরে কাজের অনেক সুযোগ। এবং কাজটা করতে পারলে বাংলাদেশের জিডিপিতে ভালো অবদান রাখা সম্ভব। কারণ, এখনো নৌপথেই প্রায় ৫০ শতাংশ পণ্য পরিবহণ করা হয়। সড়কের তুলনায় এটা যথেষ্ট সাশ্রয়ীও।

দেড় বছরের আলোচনা এবং ড্যাটা প্রসেসিংয়ের পরে কাজল চাকরি ছেড়ে দেন। তারপর ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অভিনন্দন ও বাহাউদ্দীন রূপকের সঙ্গে ‘জাহাজী’ নামের প্রতিষ্ঠান শুরু করেন। অভিনন্দনের ব্যাবসায়িক পার্টনার ও জাহাজ মালিক বাহাউদ্দীন রূপক হন চেয়ারম্যান, কাজল আব্দুল্লাহ সিইও এবং অভিনন্দন অপারেশনাল হেড। তাদের একটা অফিস আগে থেকেই ছিল। সেটাই নতুন করে কাজে লাগান। জাহাজী মূলত নৌ-রুটে চলাচলকারী পণ্য পরিবহনকারী জাহাজগুলোকে কারিগরি সহায়তা দেয়।

জাহাজী নামকরণের প্রসঙ্গে কাজল আবদুল্লাহ বলেন, শুধুমাত্র নৌ-রুটে কাজ করার জন্যই নয়, শিরোনামহীনের গানের জাহাজী গান খুব পছন্দ ছিল তাদের। সেখান থেকেই প্রতিষ্ঠানের নাম জাহাজী।

জাহাজীকে টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিচ্ছে সরফরাজ- শিরাম সিস্টেমস। কাজল বলেন, তাদের বন্ধু সরফরাজ বুয়েট থেকে পড়াশোনা শেষ করে খুলনাতেই শুরু করেন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। স্থানীয় এই প্রতিষ্ঠানকেই বেছে নেন জাহাজীর উদ্যোক্তারা। কাজল বলেন, অনেকেরই প্রশ্ন ছিলো খুলনার স্থানীয় একটা প্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রে কতটা উপযোগী হবে? কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই কাজল এবং অভি জানেন তাদের বন্ধু কতটা মেধাবী। তাই বন্ধুর প্রতিষ্ঠানের উপরই ভরসা রেখেছেন।

সবাই যখন কেরিয়ার বা ব্যবসার জন্য ঢাকা নির্ভর তখন অভিনন্দন ও কাজল খুলনার মতো বিভাগীয় শহরে কেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শুরু করলেন? তার উত্তরে কাজল আবদুল্লাহ বলেন, খুলনায় শুরু করার তিনটি কারণ। প্রথমত, তারা খুলনার স্থানীয় বাসিন্দা। নিজেদের এলাকার প্রায় সবকিছু তাদের চেনা- পরিচিত। দ্বিতীয়ত, অভিনন্দন ও বাহাউদ্দীন রূপক আগে থেকেই সেখানে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। এখানকার ব্যবসার খুঁটিনাটি তাদের জানা; আর তৃতীয়ত, সবাই সবকিছু ঢাকায় করতে চায়। তাদের পরিকল্পনায় আগেই ছিল যে তারা ঢাকা কেন্দ্রিক নয়, খুলনা থেকেই একটা স্টার্ট আপ শুরু করবেন যেটা বিশ্বব্যাপী খুলনার স্টার্ট আপ হিসেবে পরিচিতি পাবে।

কাজল বলেন, কোম্পানির রেজিস্ট্রেশনের সময় তাদের আইনজীবী ঢাকাতেই করতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ঢাকায় করলে নাকি অনেক সুবিধা থাকে। পরে তারা একরকম জোর করে নিবন্ধন ফিয়ের জন্য অতিরিক্ত টাকা খরচ করে খুলনায় রেজিস্ট্রেশন করান। কারণ, তাদের স্বপ্নই ছিল খুলনাতেই ব্যবসা করবেন। খুলনাই পরিচিতি পাক। কাজল আশা করেন, একবার শুরু হলে এভাবে অন্য এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়বে নানারকম উদ্যোগ।

জাহাজীর ভিন্নতা দেখা যায় তাদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতেও। ব্যতিক্রমী সেই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকের নজর কেড়েছিল। তাদের দেওয়া চাকরির বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, তাদের প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য দারুণ সিজিপিএ, নির্দিষ্ট বয়স ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন নেই। শুধু ৫০০ শব্দে লিখতে হবে প্রার্থী কেন ওই পদের জন্য নিজেকে যোগ্য মনে করেন। নজড় কাড়ে পদের অভিনব নামকরণও। টপ সিক্রেট অফিসার, এক্সিকিউটিভ অব ফার্স্ট ইম্প্রেশন, মাস্টার অব কয়েন এবং পিপলস অফিসার ইত্যাদি। একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে শুধুই নারীদের আবেদন করার কথাও বলা হয়েছিল।

জাহাজী

এর কারণ হিসেবে কাজল আবদুল্লাহ বলেন, তিনি নিজে দেশি-বিদেশি কয়েকটি নামীদামী প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে যেয়ে দেখেছেন, মানুষের জীবনে সার্টিফিকেটের চেয়ে দক্ষতাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া নিজ কর্মজীবনে তিনি দেখেছেন মেয়েরা কাজের ব্যপারে বেশি সিরিয়াস এবং সময়ানুবর্তী। তাই ওই পদের জন্য শুধুই নারীদের যোগ্য মনে করেছেন তারা। কাজল বলেন, শিক্ষা জীবনে তারাও যে খুব অসাধারণ মেধাবী কেউ ছিলেন তা নয়। তবে কর্মজীবনে তারা ভালো করেছেন।

‘এমন অনেকেই আছেন যারা পরীক্ষার ফলাফল বা চাকরির অভিজ্ঞতা না থাকা নিয়ে আফসোস করেন। তাই তাদের জন্য সুযোগ করে দিতেই জাহাজীর এই অভিনব নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি,’ বলেন তিনি।

কেন এতো বড় চাকরি ছেড়ে এই ব্যবসা শুরু করলেন, সে প্রশ্ন তাকে তার সহযোদ্ধা অভিনন্দনও বিভিন্ন সময়ে করেন, জানালেন কাজল। আরও বলেন, ‘উত্তরে আমি বলেছি, হাফ প্যান্ট পরে অফিস করতে চাই তাই এই কাজ বেছে নিয়েছি।’

‘এর মানে হচ্ছে, ক্যাজুয়াল ভাবে, খুব আরামের সাথে কাজটা করতে পারবো। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে প্রতিষ্ঠানে এমন লোক নিয়োগ দেওয়া যারা নিজেদের কাজটা ভালো করে জানেন, আর কাজটা সুন্দর করে করবেন। অতিরিক্ত চাপ নেবেন না।’

তরুণ উদ্যোক্তা কাজল আবদুল্লাহ ও অভিনন্দন জোতদারের জাহাজী অ্যাপ’র আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন রবিবার (৮ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১২টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে। ইতোমধ্যেই জাহাজী অ্যাপের অ্যান্ড্রয়েড ভার্সন পাওয়া যাচ্ছে গুগলের প্লে স্টোরে।

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর