ব্যাংকের ‘নয়-ছয়’ সুদে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমার আশঙ্কা
২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৭:৫৭
ঢাকা: ক্রেডিট কার্ড ছাড়া ব্যাংকের সব ধরণের ঋণে ৯ শতাংশ ও আমানতে ৬ শতাংশ সুদের হার বেঁধে দেওয়াকে ভুল পদক্ষেপ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ওব্যাংকাররা। তাদের মতে, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বের কোথাও ব্যাংকের সুদের হার নির্ধারণ করে দেওয়ার নজির নেই। এতে বড় বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। অন্যদিকে ব্যক্তি শ্রেণির আমানতকারীরা ব্যাংকে টাকা রাখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। এতে করে ব্যাংকের আমানত প্রবৃদ্ধি ও ঋণপ্রবাহ— উভয়ই কমে যাবে। এতে করে কমবে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ব্যাংক সুদের হার ৯ শতাংশ ও ডিপোজিটে সর্বোচ্চ ছয় শতাংশ সুদ নির্ধারণ করে দেওয়া একটি ভুল পদক্ষেপ। কারণ বাংলাদেশে সবসময় আমানত ও ব্যাংক ঋণের সুদের হারের মধ্যে কমপক্ষে সাড়ে চার শতাংশ ব্যবধান থাকতে হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই ব্যবধান কখনো সাড়ে চার শতাংশের নিচে নামেনি।
মির্জ্জা আজিজুল বলেন, ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশ সুদ নির্ধারিত হলে আমানতকারীদের ৬ শতাংশের কমে সুদ দিতে হবে। আর তাহলে আমানতকারীরা ব্যাংকে টাকা রাখবে না। এরই মধ্যে অনেকেই ব্যাংকে টাকা রাখা কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে ব্যাংকের আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। এতে করে ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়েছে।
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ব্যাংকগুলোকে অ্যাডভান্স ডিপোজিট রেশিও (এডিআর) সংরক্ষণ করতে হয়। আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে গেলে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটের মধ্যে পড়বে। ফলে ব্যাংকগুলোর এডিআর সংরক্ষণেও সমস্যা হবে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে যাবে। এতে করে বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা, যা পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। ফলে সরকারি খাতে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বেসকারি খাতে ঋণ দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত তারল্য থাকবে না।
মির্জ্জা আজিজ আরও বলেন, ব্যাংক ঋণে সুদের হার ৯ শতাংশ করার ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। বিশেষ করে এসএমই খাত অর্থ্যাৎ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণ পাওয়া যাবে না। কারণ এসএমই খাতে ঋণ দিতে ব্যাংকগুলোর প্রশাসনিক খরচ বেশি। ফলে এই খাতে ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে পারবে না। তাতে করে এই খাতে কর্মসংস্থানও হবে না। এককথায় বলা যায়, ঋণে ৯ শতাংশ সুদ নির্ধারণের ফলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান ব্যাহত হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতেতে পৃথিবীর কোথাও ব্যাংকের সুদের হার নির্ধারণ করে দেওয়া হয় না। সুদের হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেওয়ায় দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং শেয়ারবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তিনি বলেন, আমানতে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বাস্তবে ৯ শতাংশ সুদে ব্যাংক ঋণ দিলে ব্যাক্তি শ্রেণির আমানতকারীরা তাদের আমানতে ৪ থেকে ৫ শতাংশের বেশি সুদ পাবেন না। এতে করে সাধারণ মানুষ ব্যাংক বিমুখ হয়ে পড়বে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর আরও বলেন, এই অবস্থায় ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দেবে এবং বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাবে। আর বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে গেলে নতুন কর্মসংস্থান কম হবে। সব মিলিয়ে এটি কোনো ভালো উদ্যোগ হয়নি।
এদিকে, একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সব ধরনের ঋণে ৯ শতাংশ ও আমানতে ৬ শতাংশ সুদ বেঁধে দেওয়ায় ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি ব্যক্তি আমানতকারীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমানতে সুদের হার কম হওয়ায় সাধারণ মানুষ ব্যাংকে আমানত রাখা কমিয়ে দেবে এবং বাসাবাড়িতে টাকা রাখার প্রবণতাও বাড়তে পারে।
ব্যাংকাররা আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। এতে আগামীতে ব্যাংকগুলোর ঋণযোগ্য তহবিল সংকট আরও প্রকট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ব্যাংকগুলো যদি আমানত কম পায়, তাহলে ঋণ দেবে কোথা থেকে?— সে প্রশ্নও রাখেন তারা।
এর আগে, ব্যাংক মালিকরা নয়-ছয় সুদহার বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন ২০১৮ সালের জুনে। কিন্তু গত দেড় বছরে বেশিরভাগ বেসরকারি ব্যাংকই তা কার্যকর করেনি। সর্বশেষ গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করে। এতে বলা হয়, ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ধরনের ঋণের ওপর সুদের হার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়। সার্কুলারে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া অন্য সব খাতের অশ্রেণিকৃত ঋণ বা বিনিয়োগের ওপর সুদ বা মুনাফার হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্ধারণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী ১ এপ্রিল থেকে সুদের নতুন সুদের হার কার্যকর হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে সার্কুলারে।