করোনা পরবর্তী পরিস্থিতি ব্যাংকিং খাতের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ
৬ এপ্রিল ২০২০ ১৩:২১
ঢাকা: করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) মহামারি বিশ্ব অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার কবলে পড়বে। এমনকি এর বাইরে থাকবে না বাংলাদেশও। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা দেবে করোনাভাইরাস। আর করোনা সংক্রমণের পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে ব্যাংকিং খাতের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। তাদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি এবং খেলাপি ঋণের কারণে এই খাত এমনিতেই বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে। এ অবস্থায় করোনার সংক্রমণ ব্যাংকিং খাতের বিপর্যয় আরও বাড়াবে।
করোনার কারণে আগামী জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ আদায় এবং নিয়মিত ঋণের কিস্তি আদায়েও নানা বিধিনিষেধ রয়েছে। এ অবস্থায় খেলাপি ঋণ ও নিয়মিত ঋণের কিস্তি আদায় করতেন না পারলে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট সৃষ্টি হবে। এ ছাড়াও ব্যাংকের ডিপোজিট অনেক দিন আগে থেকেই কমছে। বর্তমান অবস্থায় ব্যাংকের ডিপোজিট আরও কমে যাবে। ফলে দেশের ব্যাংকিং খাতে আরও বিপর্যয় নেমে আসবে। আর এ বিপর্যয় থেকে উত্তরণকেই নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন দেশের বিশিষ্টজনরা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ব্যাংকিং খাত করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগে থেকেই বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিল। নতুন করে এই সংকট তৈরি হওয়ায় অবস্থা আরও খারাপ হবে। করোনার কারণে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বন্ধ থাকায় উদ্যেক্তারা ঋণ নিয়ে কী করবেন? আর ঋণ না নিলে ব্যাংকের আয় কমে যাবে। সব মিলিয়ে ব্যাংকিং খাতে সমস্যা আরও বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। ফলে নতুন করে কোনো ঋণ আদায়ও হবে না। এতে করে ব্যাংকের আয় কমে যাবে। এ ছাড়াও ব্যাংকের ডিপোজিট অনেক দিন ধরেই কমছে, এটা আরো কমে যাবে। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাত এক ধরনের তারল্য সংকটে পড়বে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন: সিআরআর ও পলিসি রেট কমিয়েছে। তবে এতে করে যে সমস্যার বড় মাত্রার সমাধান হবে, তা প্রত্যাশা করা মুশকিল। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে ব্যাংকগুলোতে নজরদারি বাড়াতে হবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটরিং পলিসি আরও রিলাক্স করতে হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনার কারণে ব্যাংকি খাতে দুই দিক থেকে প্রভাব পড়বে। প্রথমত ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হবে। কাজের গতি কমে যাবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্লো হয়ে পড়বে। এতে করে ব্যাংকের আয় কমে যাবে। ফলে নয় শতাংশ সুদে ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে পারবে কি-না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘করোনাভইরাসের কারণে ব্যবসায়ায়িক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। এলসি বন্ধ হবে, আমদানি-রফতানি হচ্ছে না। এটাও ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। মানুষ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে আসবে না। আমানত রাখার পরিমাণ আরও কমে যাবে। খেলাপি ঋণ জুন পর্যন্ত রেয়াদ দেওয়ায় ব্যাংকের আয় কমে যাবে। নতুন করে আরও ঋণ খেলাপি হবে।’
সালেহ উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘করোনার কারণে দেশের অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে ব্যাংকিংখাতে। আবার ব্যাংকের বিপর্যয় প্রভাব দেশের অর্থনীতিতেও পড়বে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে বড় ধরনের প্রণোদনা দিতে হবে।’
ইস্টার্ন ব্যাংকের ( ইবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান আলী রেজা ইফতেখার সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে বর্তমানে সব সেক্টর বন্ধ রয়েছে। আর বিভিন্ন সেক্টর বন্ধ হয়ে গেলে ব্যাংকিং খাতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এটাই স্বাভাবিক।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে ঋণের কোনো চাহিদা নেই। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে, ফ্যাক্টরিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাংক যাদের সঙ্গে ব্যবসা করে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হলে, ব্যাংকও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটাই স্বাভাবিক।’
আলী রেজা ইফতেখার উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘করোনায় চীন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সে জন্য আমেরিকা ইউরোপও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর একই কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতও বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে।’ কারণ হিসাবে তিনি বলেন, ‘ব্যাকওয়ার্ড লিনকেজ ক্ষতিগ্রস্ত হলে, ফরওয়ার্ড লিনকেজ ক্ষতিগ্রস্ত হবেই। ব্যাংকের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে ব্যাংকের সঙ্গে যারা ব্যবসা করেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত, এসএমই খাত, কুটির শিল্প, মাঝারি শিল্প, বড় বড় কলকারাখানা, করপোরেট, কনজ্যুমার লোন, ক্রেডিট কার্ড যাই বলি না কেন সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে এর প্রভাব ব্যাংক খাতে পড়বেই। এ থেকে নিস্তার পাওয়া কিংবা বাঁচার কোনো উপায় নেই। ফলে করোন পরবর্তী সময়ে ব্যাংকিং খাতে একটা বড় ধাক্কা আসবেই। এটা অবধারিত। এটা থেকে আমরা কেউই রেহাই পাব না।’
তিনি বলেন, ‘এই অবস্থা থেকে উত্তরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের আগামী জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ না বাড়ানো এবং খেলাপি ঋণের প্রতিবেদন একই রকম রাখতে হবে। এছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকগুলোর জন্য অনেক কিছু রিলাক্স করেছে। তার মধ্যে রয়েছে সিআরআর, রিপোর্টসহ বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা। সেগুলো অব্যাহত রাখতে হবে।’