নন-কটনে ‘বিশেষ নজর’ পোশাক মালিকদের
১৪ জুন ২০২১ ১১:১২
ঢাকা: বিশ্ব বাজারে পোশাকের ফ্যাশনে পরিবর্তন ঘটছে। ম্যান মেইড ফাইবারে (নন-কটন) তৈরি পোশাকের দিকে ঝুঁকছে ক্রেতারা। দেশের তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরাও এখন নন-কটনের বাজারে বিশেষ মনযোগ দিতে চান। এ জন্য সরকারের নীতি সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন তারা। বাজার সম্প্রসারণে নন-কটন ফাইবার অমাদানিতে থাকা বিদ্যমান শুল্ক উঠিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে তাদের।
দেশে উৎপাদিত কটনের সুতায় প্রতি কেজিতে ৩ টাকা ভ্যাট থাকলেও নন কটনে ৬ টাকা ভ্যাট দিতে হচ্ছে। এ বৈষম্যেরও নিরসন চান তারা। এ ছাড়া নন-কটনে তৈরি পোশাক রফতানিতে ১০ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার দাবিও রয়েছে পোশাক মালিকদের। সুবিধা দেওয়া হলে নন-কটনের বাজার সম্প্রসারণসহ দেশের রফতানি আয় বাড়বে বলেও মনে করছেন পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা।
দেশের তৈরি পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী সংগঠন বাংলাদেশে পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) বলছে, বিগত চার দশকে আমাদের তৈরি পোশাক রফতানি ৩৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছালেও আমাদের পণ্যের ম্যাটেরিয়াল ডাইভারসিফিকেশন হয়নি বললেই চলে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রফতানি অনুযায়ী আমাদের মোট পোশাক রফতানির প্রায় ৭৪ দশমিক ১৪ শতাংশই ছিল কটনের তৈরি, যা দশক পূর্বে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ছিল ৬৯ শতাংশ।
অর্থাৎ বিগত দশ বছরে আমাদের শিল্পটির কটন নির্ভরতা বরং বেড়েছে। ২০১৮ সালে মোট ২০ লাখ ৫২ হাজার টন ফাইবার আমদানি হয়, যার ৯৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ ছিল কটন। আমাদের মোট ৪৩০ টি স্পিনিং মিল এর মধ্যে ৪০৩ টিই কটন স্পিনিং মিল। যেখানে বিশ্বের মোট টেক্সটাইল কনজাম্পশনের প্রায় ৭৫ শতাংশই নন-কটন, এর মধ্যে সিনথেটিক (ম্যান মেইড ফাইবার) যা বার্ষিক ৩ থেকে ৪ শতাংশ হারে বাড়ছে; সেখানে কটনের শেয়ার মাত্র ২৫ শতাংশ, যা বছরে ১ থেকে ২ শতাংশ হারে বাড়ছে।
সংগঠনটি বলছে, বর্তমানে বিশ্বে ভোক্তাদের ক্রমাগত জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং টেকসই ও পরিবেশ বান্ধব পোশাকের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নন-কটন পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। ২০১৭ সালে ম্যান মেইড ফাইবার বেসড টেক্সটাইল ট্রেড এর পরিমাণ ছিল প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে বাংলাদেশের শেয়ার ছিল মাত্র ৫ শতাংশ। অথচ আমাদের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের দখলে ছিল ১০ শতাংশ শেয়ার। অর্থাৎ বৈশ্বিক ফাইবার চাহিদার বিচারে আমরা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ কটনের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছি।
উল্লেখ্য যে, বিগত দশকে আমাদের দেশের নন-কটন, বিশেষত ম্যান মেইড ফাইবার খাতে কিছু বিনিয়োগ হলেও এসব বিনিয়োগ মূলত মূলধন ও টেকনোলজি নির্ভর। আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোতে এই শিল্পের কাঁচামাল ‘পেট্রোক্যামিকেল চিপস’ থাকায় এবং তাদের স্কেল ইকনোমির কারণে তারা প্রতিযোগী সক্ষমতায় এগিয়ে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নন-কটন খাতে বিনিয়োগ ও রফতানি উৎসাহিত করতে, বিশেষ করে প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে নন-কটন পোশাক রফতানির উপর ১০ শতাংশ হারে বিশেষ প্রণোদনা দাবি পোশাক কারখানা মালিকদের।
সম্প্রতি সারাবাংলার এক প্রশ্নের উত্তরে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘এতদিন আমরা শুধু কটনের পণ্যই উৎপাদন করতাম। সম্প্রতি আমরা নন কটন উৎপাদনে ধীরে ধীরে প্রস্তুত হয়েছি। মেশিনারিজ ও অন্যান্য খাতে আমরা বেশ বিনিয়োগ করেছি। এখন দেশের প্রায় প্রতিটি কারখানাতেই নন-কটনের পোশাক উৎপাদন সম্ভব। তিনি বলেন, বিশ্ব বাজার এখন নন-কটনের দখলে। আমরা সেদিকে নজর দিচ্ছি। নন-কটন রফতানিতে ১০ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হলে প্রতিবছরই রফতানি আয়ে বাড়তি ২ বিলিয়ন ডলার যোগ হবে।’
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহ-সভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘নন কটনের আইটেম অনেক আছে, আমাদের এখানে এই ফেব্রিক হয় না, সেটা আমাদের আমদানি করতে হয়। তাই নন কটনে আমাদের ফোকাস করা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘সবাই যে নন কটন করতে পারবে তা নয়। তবে দেশে নন কটনের প্রডাকশন বাড়ানো যেতে পারে। নন কটনের ভবিষ্যৎ ভালো। বর্তমানে আমরা যেসব আইটেম করছি, এর বাইরে যদি নতুন কোন আইটেম বাড়ানো যায়, তাহলে বাজার সম্প্রসারিত হবে। এতে বাজারের বহুমুখীকরণও ঘটবে।’
দেশের নিটওয়্যার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিকেএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘কটনে আমরা বিশ্ববাজারে খুবই স্ট্রং। প্রতিযোগিতায় আমরা ভালো অবস্থানে আছি। তবে বিশ্ব বাজার এখন কটন থেকে নন কটনে ধাবিত হচ্ছে। আমরা কটনে যে শার্ট বা টি শার্ট তৈরি করছি সেটি মেন মেইড ফাইবারে হলে তার চাহিদা বেড়ে যাবে। আবার দামও বেড়ে যাবে। কটনের টি শার্ট দেড় ডলারে বিক্রি করা গেলে নন কটনেরটি দুই ডলারে বিক্রি করা যাবে। এতে আমাদের রফতানি পণ্যের সংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে রফতানি আয়ও বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘কটনের ফাইবার আমদানি এখন ডিউটি ফ্রি। কিন্তু নন কটনে ডিউটি রয়েছে। আমরা মনে করি নন কটন ফাইবার আমদানির ক্ষেত্রে ডিউটি উঠিয়ে দেওয়া উচিৎ। আবার কটনের সুতায় পার কেজিতে ভ্যাট ৩ টাকা হলেও মেন মেইড সুতায় ভ্যাট ৬ টাকা। এই বৈষম্য কেন? বাজার সম্প্রসারণে এই বৈষম্য থাকা উচিৎ নয়।’
জানতে চাইলে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ফ্যাশন ডিজাইনের এখন সবই ম্যান মেইড ফাইবারে চলে এসেছে। পৃথিবীতে ফ্যাশন প্রতিনিয়তই বদলায়। ডেনিম আগে ছিল শুধুমাত্র প্লেন, এখন তো কত ধরনের। মানুষ এখন ম্যান মেইড, স্পোর্টস ওয়ার পড়ছে। বিশ্বে ফ্যাশন ডিজাইনের চেঞ্জ হচ্ছে। বাজারে আমাদের যে হিস্যা তা ধরে রাখতে ম্যান মেইড ফাইবারে নজর দিতে হবে। কারণ এখন ম্যান মেইড ফাইবারের চলন আসছে। আমরা যদি আমাদের মার্কেট শেয়ার ধরে রাখতে চাই, রফতানি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে, বহিবির্শ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ম্যান মেইড ফাইবার বা নন-কটনে যেতে হবে।’
বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং হাউজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিবিএ) সভাপতি কাজী ইফতেখার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্বে ম্যান মেইড ফাইবারের চাহিদা নতুন নয়। তবে বাংলাদেশ এখনও সেই যায়গায় পৌঁছায়নি। বেটার কোয়ালিটির জ্যাকেট বানাতে বাংলাদেশে কেউ আসে না। ওয়ার ওয়ার্ক বা স্পোর্টস ওয়ারেও আমরা ভালো ব্র্যান্ড ধরতে পারিনি। বাংলাদেশ এখন যে কাজগুলো করছে তা মধ্যম পর্যায়ের ক্রেতাদের। মধ্যমানের পণ্য আমরা উৎপাদন করি। আমাদের আরও উচ্চমানের পণ্য উৎপাদন করতে হবে। মার্কেট শেয়ার বাড়াতে আমাদের আরও অনেক কাজ করতে হবে। একইসঙ্গে ম্যান মেইড ফাইবারে পরিবেশের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।’
সারাবাংলা/ইএইচটি/একে