Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিআইবিএম‘র ১৩ কর্মকর্তার দুর্নীতি: ২ বছর ঝুলছে তদন্ত প্রতিবেদন

গোলাম সামদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২১ নভেম্বর ২০২১ ১৪:২৯

ঢাকা: ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)-বিদায়ী মহাপরিচালকসহ ১৩ ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রশাসনিক ও আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছিল বাংলাদেশে ব্যাংক ও বিআইবিএম‘র যৌথ তদন্ত প্রতিবেদনে। ওই প্রতিবেদনে দায়ীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও বিভাগীয় শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু ঝুলে আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন। গত দুই বছরেও নেওয়া হয়নি দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।

বিজ্ঞাপন

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-বিআইবিএম‘র ১৩ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ২০১২ সালে থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে কনসালটেন্সি (বাজেট বর্হিভূত আয়) আয়ের কোটি কোটি টাকা নিজেরা ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছেন।

পাশাপাশি বিআইবিএম‘র ১০৮ কোটি টাকা প্রতিষ্ঠানটির ডিজি বাজারে প্রচলিত সুদের চেয়ে কম সুদে দুর্বল আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তিস্বার্থে এফডিআর করেছেন। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠানটির ডিজি ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালে ৫ বছরে ৪১ লাখ টাকা ট্যাক্সবাবদ প্রতিষ্ঠান থেকে পরিশোধ করেছেন। যা তার ব্যক্তিগতভাবে পরিশোধ করার কথা। এ ছাড়াও প্রতিবেদনে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, বিদেশ ভ্রমণ, এসিআর, অফিস ডেকোরেশন কার্যদেশে অনিয়ম, পুলের গাড়ি ব্যবহারে দুর্নীতি, হোস্টেল ও ডাইনিং হল পরিচালনায় দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তা সত্ত্বেও তদন্ত প্রতিবেদনটি রহস্যজনক কারণে ১৩ কর্মকর্কতার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেয়ার দুই বছর পরেও কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে কোটি কোটি তারা বহাল তবিয়তে রয়েছেন। এতে করে প্রতিষ্ঠানটির কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কারণে প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণমানের অবনতি এবং সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিআইবিএম এর আর্থিক অনিয়ম সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিআইবিএম একটি যৌথ তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। কমিটি একটি প্রতিবেদনও দিয়েছিল। সে আলোকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল কিনা আমার জানা নেই।’

অন্যদিকে বিআইবিএম এর মহাপরিচালক ড. মো. আখতারুজ্জামান এর কাছে প্রতিষ্ঠানটির অনিয়ম ও সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে চাইলে সবকিছু শোনার পর তিনি কোনো মন্তব্য না করে বলেন, ‘আমি এখন বোর্ড মিটিংয়ে রয়েছি। কোনো কথা বলতে পারব না।’

বিজ্ঞাপন

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিআইবিএম-এর অভ্যন্তরীণ আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের বিষয়ে প্রাপ্ত অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে বিআইবিএম ও বাংলাদেশ ব্যাংক-এর সমন্বয়ে ২০১৯ সালের ১০ জুন তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গঠিত তদন্ত কমিটি প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট ৮টি বিষয়ে তদন্ত চালায়। তদন্তে প্রতিষ্ঠানের সাবেক মহাপরিচালকসহ ১৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র উঠে আমে কমিটির প্রতিবেদনে।

অভিযুক্তরা হলেন, বিআইবিএম‘র সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী, প্রকল্প পরিচালক ড. শাহ মো. আহসান হাবীব, অধ্যাপক নেহাল আহমেদ, সহযোগী অধ্যাপক অতুল চন্দ্র পণ্ডিত, সহকারী অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, চুক্তিভিত্তিক ফ্যাকাল্টি সদস্য শেখ নজিবুল ইসলাম (বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সাবেক উপ-মহাব্যবস্থাপক, পিআরএল ভোগরত অবস্থায় উভয় প্রতিষ্ঠান থেকেই সুবিধা নিয়েছেন), সিনিয়র এডমিন অফিসার শারমিনা নার্গিস, মহাপরিচালকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা এসএম শাহীনুল ইসলাম, ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান ফারহানা হক, স্টাফ অফিসার এ কে এম শাহীনুজ্জামান, ট্রেনিং অফিসার সুজন কুমার ঘোষ ও হোস্টেল সুপার তারান্নুম পারভীন।

অনিয়মের ধরনের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবদনে বলা হয়— অভিযুক্তরা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের কনসালটেন্সির মাধ্যমে বেতন-বহির্ভূত ও বেতনের চেয়ে অনেক বেশি আয় করলেও ব্যক্তিগতভাবে নিজেরা লাভবান হয়েছেন সবচেয়ে বেশি। কনসালটেন্সি আয়ের ৩৩.১৩ শতাংশ থেকে ৪৭ শতাংশ (গড়ে ৪২.২৬%) গেছে তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে। এর বিপরীতে বিআইবিএম-এর তহবিলে জমা হয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ। যা খুবই অপ্রতুল। এ ছাড়া কনসালটেন্সি বণ্টনের ক্ষেত্রেও ব্যক্তি বিশেষের পছন্দের বিষয়টি অগ্রাধিকার পেয়েছে। প্রতিবেদনে ২০১২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অভিযুক্তদের কনসালটেন্সি আয় পর্যালোচনা করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়— কনসালটেন্সিতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন সাবেক মহাপরিচালক। তিনি একই নিয়েছেন ১ কোটি ৫৬ লাখ ৯১ হাজার টাকা। এরপর পর্যায়ক্রমে শেখ নজিবুল ইসলাম ১ কোটি ৩ লাখ টাকা (প্রতিবছর আয়ের ১০০% থেকে বেশি এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রায় ৩১৩%), ড. শাহ মো. আহসান হাবীব ৯৭ লাখ টাকা, অতুল চন্দ্র পণ্ডিত ৫৮ লাখ ও নেহাল আহমেদ ৫৩ লাখ টাকা।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়— ‘কনসালটেন্সি খাতে অর্জিত আয় ব্যক্তিপর্যায়ে বিতরণে সংস্থার পর্ষদ অনুমোদিত কোনো নীতিমালা নেই। গুটিকয়েক ফ্যাকাল্টি ও কর্মকর্তা একটি গ্রুপ তৈরি করে রিসার্চ কনসালটেন্সি, ব্যাংকের নিয়োগ, পদোন্নতি পরীক্ষাসহ বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত কোর্সসমূহ পরিচালনা করে সেগুলো থেকে প্রাপ্ত আয় নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালনায় এ গ্রুপটি সুবিধাভোগী এবং তাদের কারণে একটি প্রকল্পে লোকসানও হয়েছে। এর ফলে অন্যান্য ফ্যাকাল্টিগুলোকে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং বিআইবিএম-এর নিয়মিত কোর্সগুলোর মানের অবনমন হয়েছে।’

এ ছাড়া কনসালটেন্সিভুক্ত ‘প্রকল্পগুলো বিআইবিএম-এর বাজেট বহির্ভূত ব্যয় হওয়ায় এবং এ সব ব্যয় নির্বাহের ভাউচার/কাগজপত্রাদি যথাযথ অডিট না হওয়ায় এক্ষেত্রে ব্যয় নির্বাহের বিষয়াদি অস্বচ্ছ ও প্রশ্নবিদ্ধ। বিভিন্ন ব্যাংকের পেইড কোর্স থেকে প্রাপ্ত অর্থ বণ্টনের ক্ষেত্রে ব্যাপকমাত্রায় অনিয়ম হয়েছে’ বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে ‘সুবিধাভোগী’রা তদন্ত কমিটিকে বলেছেন, ‘পেইড কোর্সসমূহ পরিচালনার দক্ষতা ও বিশেষায়িত হিসেবে তাদের কাছে বণ্টন করা হয়েছে।’ কিন্তু তাদের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেনি কমিটি। অন্যদিকে সুবিধা বঞ্চিতরা বলেছেন, ‘যথেষ্ট যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তাদের সংশ্লিষ্ট কাজে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি, প্রকারান্তরে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে।’

উভয়পক্ষের বক্তব্য পর্যালোচনা করে ‘বিআইবিএম-এ অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা চলছে’ বলে মন্তব্য করেছে তদন্ত কমিটি।

প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানের সাবেক মহাপরিচালক-এর বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘কোনো নীতিমালা প্রণয়ন না করে দীর্ঘদিন যাবৎ প্রাক্তন মহাপরিচালক তার অনুগত কতিপয় ফ্যাকাল্টি ও স্টাফদের নিয়ে ইচ্ছামাফিক নিজেদের মধ্যে আর্থিক সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ও সুনাম নষ্ট করেছন।’

এ ছাড়া ‘বোর্ডের নির্দেশনা না-থাকা সত্ত্বেও সাবেক মহাপরিচালকের বেতন-ভাতার ওপর ধার্যকৃত আয়কর বিআইবিএম-এর তহবিল থেকে প্রদান করা হয়েছে, যা অনৈতিক বলে মন্তব্য করছে কমিটি।

প্রতিবেদনে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে কনসালটেন্সির মাধ্যমে অভিযুক্তদের অতিরিক্ত আয়ের ৫০ শতাংশ বিআইবিএম-এর তহবিলে ফেরত প্রদান; বিআইবিএম কর্তৃক পরিশোধিত সাবেক মহাপরিচালকের আয়কর আদায় করা ও অনাদায়ে প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ; চারজনের (সাবেক মহাপরিচালক, ড. শাহ মো. আহসান হাবীব, শেখ নজিবুল ইসলাম ও শারমিনা নার্গিস) বিষয়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি।

প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র প্রশাসনিক কর্মকর্তা শারমিনা নার্গিস-এর বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও সুবিধা গ্রহণের বিষয়ে প্রতিবেদনে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে তাকে অবিলম্বে এ পদ থেকে প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়। ‘প্রশাসনিক অনিয়মের বিষয়ে তিনি কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি’ বলেও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

এ ছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এর বাইরে বিআইবিএম-এর সুনাম ও শৃঙ্খলা অক্ষুণ্ন রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক পদমর্যাদার একজনকে প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক পদে এবং মহাব্যবস্থাপক পদমর্যাদার একজনকে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক (প্রশাসন ও হিসাব) পদে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছিল।

সারাবাংলা/জিএস/একে

তদন্ত প্রতিবেদন দুর্নীতি বাংলাদেশ ব্যাংক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর