২১ তলা থেকে লাফিয়ে পড়া সেই রেজওয়ানের ধকল কাটানোই বড় ব্যাপার
৪ এপ্রিল ২০১৯ ১৯:৫৪
ঢাকা: বনানীর এফআর টাওয়ারে লাগা আগুন থেকে নিজেকে বাঁচাতে ২১ তলা থেকে লাফ দিয়েছিলেন রেজওয়ান আহমেদ। প্রাণ বেঁচে গেলেও এরইমধ্যে তার কয়েকদফা বড় বড় অস্ত্রোপচার হয়েছে। বর্তমানে তাকে রাখা হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে।
চিকিৎসকরা বলছেন, এত বড় অস্ত্রোপচার এবং তার আগে অগ্নিকাণ্ড; সেখান থেকে লাফ দিয়ে নেমে আসার ঘটনায় রেজোয়ান বেশ ট্রমাটাইজড থাকবে। তার এই ধকল কাটানোই এখন সবচেয়ে বড় ব্যাপার বলছেন চিকিৎসকরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে উদ্বিগ্ন মুখে বসে রয়েছেন রেজওয়ানের ছোট ভাই, মামা এবং স্ত্রী। বাবা গিয়েছেন ওষুধ কিনতে।
রেজওয়ানের স্ত্রী শিথিল মনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুইবছরের দাম্পত্য জীবনে বরাবরই রেজওয়ানের মনের জোর খুব বেশি বলে দেখেছেন তিনি। এমনকি আইসিইউতেও স্ত্রীকে সে বারবার বলেছে, আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, আমি সুস্থ হয়ে যাব।’
আগুন লাগার দিন কী কথা হয়েছিল জানতে চাইলে শিথিল বলেন, ‘আগুন লাগার পরই সে আমাকে ফোন করে। তারপর থেকে কিছুক্ষণ পরপরই কথা হচ্ছিল তার সঙ্গে। নামার আগে সে আমাকে বলেছিল, ‘ধোঁয়ায় সব অন্ধকার হয়ে গিয়েছে, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করে এসির পাশের একটু জায়গা ভেঙে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছি, কিন্তু আর পারছি না। দম বন্ধ হয়ে আসছে, আমি মারা যাচ্ছি বোধহয়। আমি চেষ্টা করব নামার জন্য।’
তার অফিস ছিল ২০ এবং ২১ তলায়। সে ২১ তলা থেকে নেমে আসার চেষ্টা করেছিল, বলেন শিথিল মনি।
গত ২৮ মার্চ বিকেল সাড়ে চারটার দিকে রেজওয়ানকে নিয়ে আসা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে।
বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘রেজওয়ানকে যখন হাসপাতালে আনা হয় তখন তার জ্ঞান ছিল। কিন্তু বার্নের চেয়েও বড় বিষয় ছিল তার দুইটা পাই ভাঙা। ডান এবং বাম পায়ের উরুর হাড়ও ভাঙা। হাড় ভেঙে যাওয়ায় বেশ রক্তক্ষরণ হয়। এছাড়া বাম হাতে ছিল বিশাল ক্ষত।’
‘তবে রেজওয়ান ছিল প্রচণ্ড শকে। তাই আমাদের প্রাথমিক কনসার্ন ছিল তাকে শক থেকে মুক্ত করা। পালস খুব বেশি ছিল। তিনি একটা স্যালাইন হাতে নিয়েই এখানে আসেন, সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রোপচার কক্ষে তাকে নেওয়া হয় এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাকে আরও কিছু চিকিৎসা দিয়ে তাকে প্রথমে তার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল করা হয়’ বলেন ডা. সামন্ত লাল সেন।
গত রোববারে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের অধীনে রেজওয়ানের অস্ত্রোপচার হয় জানিয়ে সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘সেখানে পায়ের হাড়, বাম হাতের কাঁধের হাড়ও ফিক্সড করা হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি বাম হাতের ক্ষত চেক করা হবে। এখন পর্যন্ত ভালো আছেন।’
এদিকে আগুনের ঘটনার পর থেকে আমরা সবাই মিলে সবকিছু নিয়ে প্রস্তুত ছিলাম। যার কারণে সে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তার চিকিৎসা শুরু হয়েছে। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট হয়নি। আমাদের প্রতিটি অস্ত্রোপচার কক্ষ প্রস্তুত ছিল।
বার্ন ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন বলেন, ‘আমাদের অস্ত্রোপচার কক্ষ প্রস্তুত ছিল। ডা. সামন্ত লাল সেন, অধ্যাপক ডা. আবুল কালামসহ এই বার্নের প্রতিটি চিকিৎসক সেদিন এখানে প্রস্তুত ছিলেন। সব জায়গাতে পর্যাপ্তভাবে আমরা প্রস্তুত ছিলাম। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে কোনো সময় নষ্ট হয়নি। এর চেয়ে দ্রুত করা আসলে কঠিন। একটা সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে রেজওয়ানের চিকিৎসা শুরু হয়েছে এবং সেটা এখনো চলছে।’
চিকিৎসকদের রেজওয়ান কী বলেছেন জানতে চাইলে ডা. নাসির উদ্দীন বলেন, ‘তার বক্তব্য হচ্ছে সে ২১ তলায় একটি জানালা পেয়েছিল যেখান থেকে সে নামতে চেয়েছিল। কিন্তু নামার সময় এসির স্ট্যান্ডসহ বিভিন্ন তলার পাশের দেয়ালের সঙ্গে শরীরের বাম পাশটা থেতলে গেছে।’
ডা. নাসির বলেন, ‘তার শরীরের বড় বড় তিনটা হাড় ভাঙা, এইটার জন্যও যে ট্রমাটা হয়, তার জন্যই রেজোয়ানের আইসিইউ সার্পোট দরকার, সঙ্গে রয়েছে অস্ত্রোপচারের ধকল।’
রেজওয়ানের চিকিৎসায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শাহ আলমের নেতৃত্বে প্রায় ১০ জন সার্জন একসঙ্গে কাজ করেছেন। সঙ্গে ছিলেন বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা।
রেজওয়ান স্বাভাবিক জীবনে কবে নাগাদ ফিরতে পারবে বলে মনে করছেন প্রশ্নে ডা. নাসির উদ্দীন বলেন, ‘তার প্রথম যে ট্রমা, সেটি কিন্তু অনেক বড়, সঙ্গে রয়েছে অস্ত্রোপচারের ট্রমা। তবে আমাদের উদ্বেগের প্রধান এবং প্রথম জায়গা হচ্ছে তার লাইফ সেভিং, স্টিল।’
কিন্তু রেজওয়ানের অবস্থা স্থিতিশীল। খারাপ কিছু হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করছেন কি না প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এখনও আমরা মনে করি।’
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘তার যে অস্ত্রোপচারগুলো হয়েছে, সে অস্ত্রোপচারের অনেকগুলো কম্প্লিকেশন রয়েছে। আর এ বিষয়গুলোকে সামনে রেখেই তার চিকিৎসা হচ্ছে। তারপরও আরও অন্তত বেশকিছু দিন না গেলে তার সার্ভাইবিলিটি নিয়ে পরিষ্কার কিছু বলা কষ্টকর। আর এ সব কিছু বিবেচনায় নিয়েই তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে।’
রেজওয়ানের ‘শারীরিক এবং মানসিক ধকল কাটানোই বড় ব্যাপার’ হয়ে দেখা দেবে-বলেন ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন।
রেজওয়ানের মানসিক ট্রমা বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনার পরে যে কেউ একিউট স্ট্রেস ডিজঅর্ডার অথবা তীব্র মানসিক চাপে আক্রান্ত হতে পারেন। যদি উদ্বিগ্নতা ও নিদ্রাহীনতার মতো কোনো সমস্যা থাকে তাহলে প্রয়োজনীয় কাউন্সেলিং এবং সাইকোথেরাপি দিতে হবে।’
তবে উদ্বিগ্নতা প্রশমনকারী ওষুধ দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে যদি এ চাপ ক্রমাগত চলতে থাকে। আর তার ভেতরে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার অর্থাৎ আঘাত পরবর্তী মানসিক চাপ বা পিটিএসডি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই তাকে কাউন্সিলিং বা সাইকোথেরাপি প্রদান এবং মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। একইসঙ্গে ভীতিকর অভিজ্ঞতা কাটিয়ে উঠতে সিস্টেমিক ডিসেনসিটাইজেশন অর্থাৎ এই ভীতিকর অভিজ্ঞতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য এক বিশেষ ধরনের কাউন্সিলিং সার্ভিস তিনি নিতে পারেন। পরবর্তীতে তার মধ্যে উঁচু স্থানের ভীতি, আগুনভীতি ইত্যাদি থাকতে পারে। এই ঘটনাটি তার মনে ফ্ল্যাশব্যাকের মতো করেও আসতে পারে যেন তা না আসে সে জন্য তাকে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলেও জানান ডা. হেলাল উদ্দীন আহমেদ।
সারাবাংলা/জেএ/একে