Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

৭০ দিনে মৃত্যুহার ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে কম, সংক্রমণের ঝুঁকি কমেনি


২২ মে ২০২০ ২১:৪৭

ঢাকা: বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে ১০ সপ্তাহ বা ৭০ দিন। বিশ্বের অনেক দেশেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ পেরিয়ে গেছে ৯০ বা ১০০ দিনের সীমা। এসব দেশের প্রথম ৭০ দিনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুর হার আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক দেশের তুলনায় কম। তবে একই সময়ে সংক্রমণের পরিমাণ মোটেও কম নয়। বরং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য সামনের দিনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ।

বিজ্ঞাপন

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপর গত ১৬ মে ছিল সংক্রমণ শনাক্তের ৭০তম দিন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, ওই দিন পর্যন্ত এক লাখ ৬৭ হাজার ২৯৪টি নমুনা পরীক্ষায় দেশে ২০ হাজার ৯৯৫ জনের মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন ৩১৪ জন, যা মোট শনাক্তের ১ দশমিক ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে, এই সময়ে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণ শনাক্তের হার ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

বিজ্ঞাপন

নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে সংক্রমণের হারের তথ্য বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, বেশি সংক্রমিত দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্কে এই হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। অন্যদিকে সৌদি আরব, জার্মানি, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়ার মতো দেশগুলোতে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। সঠিক নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা জানাতে না পারার কারণে স্পেন ও ব্রাজিলের তথ্য এই পরিসংখ্যানে যুক্ত করা যায়নি।

এদিকে, কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রথম ৭০ দিনে বাংলাদেশের চেয়ে কম মৃত্যুহার কেবল রাশিয়া (শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ) ও সৌদি আরবে (শূন্য দশমিক ৬৩ শতাংশ)। ৭০ দিনের হিসাবে জার্মানির মৃত্যুর হার বাংলাদেশের সমান ১ দশমিক ৫০ শতাংশ। বাকি দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্যে মৃত্যুর হার ১৪ শতাংশ, ইতালিতে ১২ দশমিক ৭৩ শতাংশ, স্পেনে ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ, ফ্রান্সে ৭ দশমিক ৬২ শতাংশ, ব্রাজিলে ৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ, ভারতে ২ দশমিক ৯০ শতাংশ ও যুক্তরাষ্ট্রে ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সফল হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ কোরিয়াতেও মোট আক্রান্তের ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ মারা গেছে সংক্রমণের প্রথম ৭০ দিনে। আর তুরস্কে ১৬ মে ছিল দেশটিতে সংক্রমণ শনাক্তের ৬৬তম দিন। ওই দিন পর্যন্ত দেশটিতে মোট কোভিড-১৯ আক্রান্তের ২ দশমিক ৭৭ শতাংশ মারা গেছেন।

বাংলাদেশে যখন সংক্রমণের হার অনেক দেশের তুলনাতেই বেশি, তখন মৃত্যুর হার অন্য দেশগুলোর চেয়ে কেম। এর কারণ কী হতে পারে— জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ডা. বেনজির আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মৃতদের একটি বড় অংশ বৃদ্ধ। আমাদের দেশের এই শ্রেণির দিকে তাকালে দেখা যাবে, তারা আসলে তেমন বহির্মুখী নন। ইউরোপ বা আমেরিকায় বৃদ্ধ মানুষরা কিন্তু বাইরে যাচ্ছেন। তারা কাছাকাছি রেস্টুরেন্টে যান, আড্ডা দেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আমাদের বৃদ্ধ মানুষেরা বড়জোড় মসজিদ-মন্দিরে যান। সেখান থেকেও বাসাতেই ফিরে আসেন। সাধারণ ছুটির মধ্যে তাদের বড় একটি অংশ দীর্ঘ সময় ছিলেন। বাইরে কম যাওয়ার কারণে তাদের মধ্যে সংক্রমণও কম।

তবে এ নিয়ে নির্ভার থাকা যাবে না বলে মনে করেন ডা. বেনজির। তিনি বলেন, এখন একটি দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণের মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাইরে যে তরুণরা এখনো যাচ্ছে, তারা যদি সংক্রমণ নিয়ে বাসায় ফেরে, তাহলে বাসায় থাকা বৃদ্ধরাও আক্রান্ত হবে। তখন দেখা যাবে আমাদের হয়তো আক্রান্ত ও মৃত্যুর হারের চিত্র ভিন্ন হবে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, করোনা উপসর্গ নিয়ে অনেকেই মারা যাচ্ছেন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার কম হওয়ার পেছনে এ বিষয়টির ভূমিকা রয়েছে কি না— এ বিষয়ে ডা. বেনজির বলেন, সব ক্ষেত্রে এমন হবে না। গণমাধ্যমের কিছু দায় অবশ্যই আছে। তারা বস্তুনিষ্ঠ তথ্য দিয়ে থাকলে তা সঠিক চিত্র জানতে সাহায্য করে। এখানে বস্তুনিষ্ঠতা গুরুত্বপূর্ণ। গণমাধ্যমে হয়তো করোনা আক্রান্ত হিসেবে সন্দেহভাজনের মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে, কিন্তু পরে পরীক্ষায় তিনি নেগেটিভ আসছেন। ফলে গণমাধ্যমের তথ্য বিবেচনায় নিয়ে জোর গলায় কিছু বলার সুযোগ কমে যাচ্ছে। অথচ গণমাধ্যম বস্তুনিষ্ঠতার মাধ্যমে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারত। আমরাও চাপ দিতে পারতাম। আর আমাদের সরকারি সিস্টেমের যে দুর্বলতা, সেখানে আসলে এগুলো নিয়ে পরিষ্কার কোনো বক্তব্য আসে না। এই দুইটি মিলে আসলে সবাইকে একটা দ্বিধার মধ্যে থাকতে হয়। স্বাস্থ্য বিভাগের সব মৃত্যুর বিষয়ে স্পষ্ট তথ্য প্রকাশ করা উচিত বলে মত স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক এই কর্মকর্তার।

তবে উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া প্রায় সবারই নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যকরী সদস্য ডা. মোশতাক হোসেন।

তিনি বলেন, মৃত্যুর যে সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে, তা কিন্তু ল্যাবরেটরি পরীক্ষার মাধ্যমেই করা হয়েছে। প্রতিটি মৃত্যুর ক্ষেত্রেই প্রথম দিকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করানো হতো। এখন স্বাভাবিক মৃত্যুর হারও কিন্তু আছে। এর আগে তারা সামাজিক হেনস্তার আশঙ্কায় অনেক তথ্যই গোপন করতেন। আর তাই দেখা যেত, তারা কেউ হাসপাতালে আসতেন না। আবার হাসপাতালেরও সুরক্ষা সরঞ্জামের অভাব ছিল শুরুতে। তাই তারাও রোগী নিত না। ধীরে ধীরে সেই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। এখন কেউ উপসর্গ নিয়ে মারা গেলে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে।

ডা. মোশতাক আরও বলেন, কোনো কোনো পত্রিকা নিজেরাই জরিপ করে বলছে, পরিসংখ্যানের বাইরেও লক্ষণ নিয়ে কতজন মারা গেছেন। সেটাও কিন্তু ৩০০ জনের কাছাকাছি, এর বেশি না। এগুলো যোগ করলেও মৃত্যু এক হাজার ছাড়াবে না। ফলে এইটার ভূমিকা যে খুব বেশি, তা বলা যাবে না। তাছাড়া এ কথা একবারেই ঠিক না যে উপসর্গ থাকা ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে না।

তবে মৃত্যুহার কম আছে বলেও নিশ্চিন্ত হওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করেন ডা. মোশতাক। তিনি বলেন, আমাদের সংক্রমণ কিন্তু দিন দিন বাড়ছে। আমাদের এখানে উল্লেখ করার মতো একটি বৈশিষ্ট্য আছে। এখানে ছোট ছোট ক্লাস্টারে বাংলাদেশজুড়ে সংক্রমণ আছে এখনো। এভাবে যদি আমরা রাখতে পারি, তবে ক্ষয়ক্ষতি কম হবে, মৃত্যুর সংখ্যাও কম হবে। যদি নিউইয়র্কের মতো হঠাৎ করে বেড়ে যায়, সেক্ষেত্রে ক্ষতির আশঙ্কা অনেক বেড়ে যাবে। সারাদেশে যদি এক হাজার ক্লাস্টারে দু’জন করে রোগীর সংখ্যা বাড়ে, তাতে দুই হাজার জন আক্রান্ত হলে ক্ষয়ক্ষতি খুব একটা হবে না। কিন্তু এক ক্লাস্টারে যদি এই পরিমাণ আক্রান্ত হয়, তবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর হয়ে যাবে।

এ পরিস্থিতিতে সাধারণ ছুটিতে কিছু বিধিনিষেধ শিথিল করা হলেও তা দ্রুত সংশোধন করে কঠোর করার পক্ষে মত দেন ডা. মোশতাক। তিনি বলেন, এটা করতে পারলে দেখা যাবে, যেখানে ক্লাস্টার নেই সেখানে আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল করতে পারব। কিন্তু বিপর্যয় যদি এর চেয়ে বাড়ে, তখন নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে যাবে।

জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, এর জন্য সুনির্দিষ্ট কারণ হতে পারে বাংলাদেশের ‘জেনেটিক কনফিগারেশন অব পিপল’। আমাদের দেশের মানুষের যে আচার-ব্যবহার ও চালচলন, তাতে আসলে সংক্রমণ কমার খুব একটা কারণ নেই। আটটি বিভাগের মধ্যে ঢাকা বাদে অন্যান্য বিভাগে সংক্রমণ একটু কম। ঢাকা বিভাগের সংক্রমণ অনেক বেশি। কারণ এখানের মানুষের চালচলনের ধরন দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে আলাদা। এটিই আমাদের সংক্রমণ বাড়ার অন্যতম একটি কারণ। আমাদের গার্মেন্টস খুলে দেওয়াসহ লকডাউনের বিভিন্ন কার্যক্রম শিথিল হওয়ার পরে সংক্রমণ বাড়ছে— এটা আমরা দেখতে পাচ্ছি।

ডা. নজরুল বলেন, আমাদের মৃত্যুর হার আরও কমে যাবে যদি হাসপাতালগুলোর কার্যক্ষমতা আরও বাড়ানো হয়। বিশেষ করে অক্সিজেনের যে ঘাটতি আছে, তা রিকভার করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে। এখানেই মূলত আমাদের মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। আর কিছু মানুষ আছে যারা আগে থেকেই অসুস্থ, তাদের মাঝে সংক্রমণ পাওয়া গেলে ঝুঁকির মাত্রা বাড়ে। চিকিৎসাব্যবস্থাকে আমাদের উন্নত করার কোনো বিকল্প নেই। আশার বিষয় হলো, এগুলো নিয়ে কাজ হচ্ছে। তবে মৃত্যুর হার আরও কমাতে হলে সাধারণ মানুষেরও কিন্তু সচেতন হতে হবে।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা সারাবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশে এখনো যে সংক্রমণের ধারা, তাতে আমাদের অধিকাংশই রোগীই কিন্তু মৃদু মাত্রায় আক্রান্ত। যে কারণে অধিকাংশই বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে ২ শতাংশ রোগীর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সাপোর্ট দরকার হচ্ছে। তাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য সেবা আরও বাড়ানোর পরিকল্পনায় কাজ করে যাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। যদি সংক্রমণের মাত্রা না বাড়ে, তবে আমরা আশা করছি, মৃত্যুর সংখ্যাও বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

ইউরোপ-আমেরিকা করোনাভাইরাস করোনার ঝুঁকি কোভিড-১৯ সংক্রমণ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর