১১ সপ্তাহ পর টানা ৫ দিন করোনা শনাক্ত দুই হাজারের অধিক
২১ নভেম্বর ২০২০ ১২:১৮
ঢাকা: ৮ মার্চ দেশে প্রথম নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) শনাক্ত হওয়ার পর কখনো সংক্রমণ বেড়েছে, আবার কখনো কমেছে। তবে গত কিছুদিন হলো দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা বাড়ছে। গত এক সপ্তাহের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে দেশে ১৬ নভেম্বর থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত টানা পাঁচ দিন দুই হাজারের অধিক মানুষের শরীরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে।
গত তিন মাসের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এর আগে দেশে একটানা পাঁচ দিন দুই হাজারের অধিক কোভিড-১৯ সংক্রমণ পাওয়া গেছে ২৫ আগস্ট থেকে ২৯ আগস্ট। শুধু তাই নয়, দেশে ৭৩ দিন পরে প্রথমবারের মতো সংক্রমণের হার ১৪ শতাংশ পার করে ১৪.৫৭ শতাংশ হয়েছে। এর আগে ৭ সেপ্টেম্বর কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার ছিল ১৪.২৮ শতাংশ।
শুক্রবার (২০ নভেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো কোভিড-১৯ সংক্রান্ত নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৫ হাজার ৬০৭টি নমুনা পরীক্ষায় ২ হাজার ২৭৫ জনের শরীরে সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এ সময়ে মারা গেছে আরও ১৭ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা এই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, দেশে এখন পর্যন্ত মোট ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৪৩৪ জনের মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ পাওয়া গেছে।
৮ মার্চ দেশে প্রথমবারের মতো তিনজনের শরীরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া যায়। এর পরে প্রথমবারের মতো দুই অংকের সংখ্যায় অর্থাৎ ১০ জনের অধিক মানুষের শরীরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ পাওয়া যায় ২৭ দিন পরে ৫ এপ্রিল (১৮ জন)। ঠিক তার চার দিন পরেই ৯ এপ্রিল ১০০ জনের অধিক ব্যক্তির শরীরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া যায় (১১২ জন)। দেশে প্রথমবারের মতো এক হাজারের অধিক ব্যক্তির শরীরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া যায় ১১ মে (১,০৩৪ জন)। দেশে প্রথমবারের মতো ২৪ ঘণ্টায় দুই হাজারের অধিক ব্যক্তির শরীরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ পাওয়া যায় ২৮ মে (২,০২৯ জন)। এর পরবর্তীতে ২ জুলাই দেশে ২৪ ঘণ্টায় সর্বাধিক অর্থাৎ চার হাজার ১৯ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ পাওয়া যায়।
মে মাস পরবর্তী সময়ে দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিত ব্যক্তির সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২৪ আগস্ট থেকে ২৯ আগস্ট সময় পর্যন্ত দৈনিক দুই হাজারের অধিক ব্যক্তির শরীরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ পাওয়া যায়। ৩০ আগস্ট থেকে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ দিন সময়ে চার দিন দুই হাজারের অধিক ব্যক্তির শরীরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ পাওয়া যায়। ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত ৬৯ দিন সময়ে দেশে একদিনে দুই হাজারের উপরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ পাওয়া যায়নি।
সম্প্রতি দেশে ১৬ নভেম্বর ২৪ ঘণ্টায় দুই হাজার ১৩৯ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া যায়। পরবর্তীতে ১৭ নভেম্বর দুই হাজার ২১২ জনের শরীরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া যায়। ১৮ নভেম্বর দুই হাজার ১১১ জন, ও ১৯ নভেম্বর দুই হাজার ৩৬৪ জনের শরীরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া যায়। ২০ নভেম্বর দুই হাজার ২৭৫ জনের শরীরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া যায়।
দেশে ৭ সেপ্টেম্বর সর্বশেষ ১৪ শতাংশের উপরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া যায়। ১৫ হাজার ৪১২ টি নমুনা পরীক্ষা করে দুই হাজার ২০২ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ পাওয়া যায় ৭ সেপ্টেম্বর। নমুনা পরীক্ষার তুলনায় সংক্রমণ হিসেবে যা ১৪.২৮ শতাংশ। এর ৭৩ দিন পরে ২০ নভেম্বর ২৪ ঘণ্টা সময়ে ১৫ হাজার ৬০৭টি নমুনা পরীক্ষা করে দুই হাজার ২৭৫ জনের শরীরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ পাওয়া যায় যা শতাংশ হিসেবে ১৪.৫৭।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যকরী সদস্য ডা. মোশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশে কোনো ঢেউ এসেছে কি না বা ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ হচ্ছে কি না, তা নিয়ে আসলে তেমন ভাবার দরকার নেই। বাস্তবতা হচ্ছে আমরা বিপৎসীমার মধ্যেই আছি। আমাদের এখানে সংক্রম স্থিতিশীল একটি অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিন বাদে সংক্রমণের হার কখনোই ১০ শতাংশের নিচে আসেনি। গত কিছুদিনের তথ্যও যদি হিসাব করা হয়, নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার কিন্তু ১০ থেকে ১১ বা ১২ শতাংশের কাছাকাছিই আছে। এটা যদি চলমান চিত্র হয়, তাহলে ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ বা ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ এলে এই হার দেড়গুণ পর্যন্ত হয়ে যাবে। অর্থাৎ সংক্রমণের হার তখন ১০-১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৫ শতাংশ পেরিয়ে যাবে। সেই পরিস্থিতি যদি সপ্তাহ দুয়েক বজায় থাকে, তখন দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু এখনো আমরা সে পরিস্থিতিতে যাইনি।
তবে দ্বিতীয় ঢেউ না এলেও স্থিতিশীল পরিস্থিতিটিকেই যথেষ্ট বিপজ্জনক বলে মনে করছেন ডা. মোশতাক। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিকে দ্বিতীয় ঢেউ না বলে বিপৎসীমা বাড়ছে বলাই শ্রেয়। জুন-জুলাইয়ের পর সংক্রমণ ও মৃত্যু কিছুটা কমলেও অবস্থা যে খুব বেশি ভালো হয়ে গেছে, তেমনটা বলার সুযোগ নেই। কারণ আমাদের এখানে মাসখানেক হলো সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা একটি নির্দিষ্ট অবস্থানের আশপাশেই রয়েছে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যেন কোনোভাবেই এই শতাংশের হার বেড়ে না যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ওয়েভ নিয়ে চিন্তা করার আগেও জরুরি আমাদের সবার সচেতন হওয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মানুষের মধ্যে করোনা নিয়ে গা ছাড়া ভাব দেখা যাচ্ছে। অনেকেই মনে করেন করোনা নেই। নিম্ন আয়ের মানুষ মনে করে এটি বড়লোকের রোগ। এসব বিভ্রান্তিমূলক কথাবার্তা, আর এ কারণে মানুষের মধ্যে গা ছাড়া ভাব রয়ে গেছে। সেজন্য এখন আবার সংক্রমণ বাড়ছে। সামনে শীত, সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে। কারণ করোনা সংক্রমণ যখন বিভিন্ন দেশে ছড়িয়েছে, তখন সেসব দেশে শীতকাল ছিল। এখনো অনেক দেশে শীত রয়েছে, তার ওপর লকডাউন চলছে। আমাদের সচেতন থাকতেই হবে, জনগণকে সচেতন করে তুলতেই হবে।’
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেই হবে
চলমান পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাসের সেকেন্ড ওয়েভ বা দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে আলোচনার বদলে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণের প্রতি মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। একদিকে করোনার ভ্যাকসিনও আশার আলো দেখাচ্ছে। তবে ভ্যাকসিন না পেলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেই করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব— সে বিষয়টিই জোর দিয়ে বলছেন তারা। সেক্ষেত্রে মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেটি কার্যকরভাবে প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন তারা। সম্ভব হলে এখনো এলাকাভিত্তিক আইসোলেশন বাস্তবায়নের কথাও বলছেন তারা।
ডা. আবদুল্লাহ বলেন, সরকার একটি উদ্যোগ নিয়েছে— ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’। দোকান মালিক সমিতি বলেছে— মাস্ক না থাকলে দোকানে ঢুকতেই দিবে না। তবে এসব যেন কাগজে-কলমে না থাকে, বাস্তবায়ন যেন থাকে। সর্বস্তরের জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। সবাই মিলে জনগণকে সচেতন করে তুলতে পারলেই আমরা কেবল দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে পারব, সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে পারব।
ডা. মোশতাক বলেন, ‘দেশের জনগণ এখন স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না— এটি বিপজ্জনক হতে পারে। এ অবস্থায় আমাদের নমুনা পরীক্ষার পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি সম্ভব হলে এলাকাভিত্তিক আইসোলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে হয়তো সংক্রমণের মাত্রা আরও নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে। তবে সংক্রমণের মাত্রা ৫ শতাংশের নিচে নামার পর তিন সপ্তাহের মতো সে সংখ্যায় স্থির না থাকলে নিশ্চিন্ত হওয়ার কিছু নেই। সবাইকে সম্মিলিতভাবে এগুলো নিয়ে ভাবা দরকার ও সচেতনভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার দরকার।’