ভার্চুয়ালে অপপ্রচার জামায়াত-বিএনপি-জঙ্গির, কঠোর পুলিশ-বিটিআরসি
২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৬:০৫
।। এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: নির্বাচনের ঠিক আগে ভার্চুয়াল জগতে নানা ধরনের অপপ্রচার আর গুজব ছড়াতে ব্যস্ত রয়েছে জামায়াত-বিএনপি ও জঙ্গি গোষ্ঠী। নানা ধরনের মিথ্যা তথ্য-উপাত্তে ভরে উঠছে ভার্চুয়াল জগত। প্রচারণার চেয়েও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার, প্রতিপক্ষের অবমাননার মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে নিয়ে স্যোশাল মিডিয়ায় তা ছড়ানো হচ্ছে ব্যাপক হারে। কোনও কোনও প্রপ্যাগান্ডা ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
এদিকে এসব অপপ্রচার ঠেকাতে সোচ্চার রয়েছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। সজাগ রয়েছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসিও। হুমকি মোকাবেলায় যে কোন মুহূর্তে যে কোন ওয়েবসাইট বন্ধ করা হতে পারে বলেও জানানো হয়েছে। অনেকের ফেসবুক আইডি ও পেইজ বন্ধ করে দিচ্ছে। ইউটিউব চ্যানেলগুলোতেও চলছে কড়া নজরদারি।
পুলিশ ও বিটিআরসি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম ডিভিশনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) নাজমুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘যদি রিউমারটি এমন হয়, আমাদের সমাজের গাঁথুনিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বা দেশে বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি করছে, সেক্ষেত্রে অবশ্যই আমরা সেই কন্টেন্টটি মুছে ফেলার উদ্যোগ নেবো। কোন ওয়েবসাইট হুমকি সৃষ্টি করলে তাও ব্লক করে দেয়া হবে।’
নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘আগস্টের আগে পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব বা অপপ্রচার মূলক কার্যক্রমের মাত্রা ছিল ভিন্ন। তবে গত দুই মাস ধরেই নির্বাচন কেন্দ্রিক গুজব ও অপপ্রচার বেশি ছড়ানো হচ্ছে। নির্বাচনকে সামনে রেখেও অপপ্রচারের শঙ্কা রয়েছে।’
পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি ইউনিটের তথ্যমতে, গত ২ মাসে সাইবার ক্রাইম ইউনিটে মামলা হয়েছে ১১ টি। এসব মামলায় ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২০০ এর মতো ফেসবুক আইডি অকার্যকর করা হয়েছে। ১৫ থেকে ২০ টি ফেসবুক পেইজের কার্যক্রমও বন্ধ করা হয়েছে। বন্ধ করা হয়েছে ১২ টি ইউটিউব চ্যানেল, ব্লক করা হয়েছে ৩৫ টি ফেক নিউজ পোর্টাল। আর এ কার্যক্রম সার্বক্ষণিক চলমান রয়েছে।
‘বাংলাদেশে যেহেতু জঙ্গিবাদের কিছু ছোঁয়া রয়েছে, গত ৩ থেকে ৪ বছরে যা দেখেছি আমরা, একই ধরণের কিছু আমরা দেখেছি মধ্যপ্রাচ্যে, পাকিস্তানে, আফগানিস্তানে এবং আফ্রিকার কিছু রাষ্ট্রে। সেসব দেশে নির্বাচন কেন্দ্রিক জঙ্গিবাদের প্রচারণা বা জঙ্গি তৎপরতার উদাহরণ রয়েছে। বাংলাদেশেও তা হতে পারে, যা অসম্ভব কিছু নয়,’ বলেন নাজমুল ইসলাম।
তিনি আরও বলেন, ‘ফিজিক্যালি মাঠে থেকে ক্ষতি করার মতো অবস্থায় তারা নেই বলেই আমরা মনে করছি, সেদিক থেকে আমরা মোটামোটি নিরাপদ। তবে অনলাইনে এরা বেশ সক্রিয়। অনলাইনকে বেছে নিয়েছে দেশে একটি বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করার জন্য।’
এরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন দলীয় নামে, কখনও জঙ্গিদের নামে, কখনও দলের পরিচয়ে এসব অপকর্ম করছে, জানিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, তাদেরকে রুখে দেয়া আমাদের প্রধান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কোন পথে রুখে দেওয়া হচ্ছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, কখনও পেজ ব্লক করে দেয়ায় কাজ হয়, আর তা না হলে আটক কর হয়।’
নির্বাচনের সময়টিতে এই ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে বলেও জানান এডিসি নাজমুল।
এদিকে, ভার্চুয়াল জগতের নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রয়েছে বিটিআরসি। হুমকি মোকাবেলায় সরকারকে সর্বোচ্চ প্রযুক্তি সহায়তা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
জানতে চাইলে বিটিআরসির মিডিয়া উইংয়ের সিনিয়র সহকারী পরিচালক জাকির হোসেন খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট থেকে যদি কোন হুমকি বা অপপ্রচার চালানো হয়, সেক্ষেত্রে অবশ্যই সাইটটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সরকার যদি মনে করে ব্যবস্থা নেয়া দরকার, সেক্ষেত্রে বিটিআরসি প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনকে সামনে রেখে আমাদের সার্বক্ষণিক নজরদারি রয়েছে। আমাদের রেগুলার যে কার্যক্রম সেক্ষেত্রে লোকবল বৃদ্ধি করে কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।’
অপপ্রচারে ফেসবুক: নির্বাচনের দিন যতো ঘনিয়ে আসছে অপপ্রচার ততো বেড়ে চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সেনাবাহিনী নিয়েও অপপ্রচার চলছে।
‘সবুজ শাড়ি লাল টিপ’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে সুলতান বিন নাদের নামের একজন সেনাবাহিনীর কয়েকটি ছবি আপলোড দিয়ে লিখেছেন, ‘গুড নিউজ। রাতের বেলায় কোন পুলিশ এলাকায় ঢুকলে বেধে রেখে সেনাবাহিনীকে খবর দিন। কপি পোস্ট বিডি সেনাবাহিনী।’
অর্থাৎ সেনাবাহিনীর নাম করে ফেসবুকে অপপ্রচার ছড়াচ্ছেন নাদের। বাঁশেরকেল্লাসহ বেশকিছু ফেসবুক গ্রুপেও একই ধরণের অপপ্রচার চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন একাধিক ফেসবুকার। বাশের কেল্লা নামক একটি পেইজে ‘হাসিনাকে নিবেদিত গান: শয়তান দিলা ক্যান’ নামের একটি ভিডিও আপলোড করা হয়। যেখানে শিশু কণ্ঠ আর গানের ভিডিও ব্যবহার করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করা হয়।
সম্প্রতি এক অভিনেত্রীর পোশাক নিয়ে করা মন্তব্য নিয়েও ট্রল করা হয়েছে জামায়াতের এই পেজটিতে। একই পেইজে প্রধান নির্বাচন কমিশনার সিইসিকে নিয়ে মন্তব্য করা হয়- ‘মেরুদন্ডহীন আওয়ামী সিইসির পদত্যাগ চাই’।
সিইসিকে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বলে অপপ্রচার চালিয়ে তাকে ‘বেহুদা’ বলেও কটাক্ষ করা হয়। পেজটির বেশ কিছু কমেন্টে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দেখিয়ে তাদের পক্ষে কাজ করার প্রত্যাশার কথা জানানো হয়েছে।
শামীম এইচ চৌধুরী নামে একজন ফেসবুকে একটি ভিডিও আপলোড দিয়ে লিখেছেন, ‘‘এবার আসছে ষড়যন্ত্রের সর্বোচ্চ আঘাত! তৈরি করা হয়েছে নকল ভোটের বুথ। ছাপানো হয়েছে কয়েক লাখ ব্যালট পেপার। প্ল্যান অনুযায়ী কেনা হয়েছে ৩ হাজার ক্যামেরাও। উদ্দেশ্য, নৌকায় সিল মেরে তা ব্যালট বক্সে ভরার দৃশ্য গোপনে ধারন করা হবে এবং ভোটের আগের দিন রাতে সেই ভিডিও ছাড়া হবে সোশ্যাল মিডিয়ায়। গুজব ছড়ানো হবে, ‘আওয়ামী লীগ ভোটের আগেই নৌকায় সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে রাখছে’।’’ আওয়ামী ঘরনার একাধিক ফেসবুকার ভিডিওটি শেয়ার দিয়েছেন।
এ বিষয়টিকেও একটি অবৈধ প্রচারণা বলে নিশ্চিত করেছে সাইবার ক্রাইম ইউনিট।
প্রপাগান্ডায় কোনও কোনও প্রার্থী নিজেও অংশ নিচ্ছেন। এক্ষেত্রেও তারা বেছে নিচ্ছেন স্যোশাল মিডিয়া।
শেরপুর-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী সানসিলা জেবরিন সর্বকনিষ্ঠ প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন। সোমবার (২৪ ডিসেম্বর) তার গাড়িবহরে হামলার অভিযোগ এসেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে কাচ ভেঙে দেয়া গাড়ির ছবিও দেখা গেছে। তবে, রাতে বিএনপির এই প্রার্থী ফেসবুক লাইভে এসে হামলার ঘটনাকে পূঁজি করে কুৎসা রটাতে থাকেন। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, গাড়িতে বসে থাকা সানসিলা বলতে থাকেন, আজকে মৃত্যু আমাদের সবার সামানে, আপনারা দেশটাকে বাঁচাবেন প্লিজ। বলেন, তিনি ডিসি অফিসে যাচ্ছেন, ডিসি অফিসই বলে দিবে তারা কতোটুকু নিরপেক্ষ। ভিডিওটির এক পর্যায়ে দেখা যায়, হামলায় আক্রান্ত একজনের রক্ত দেখাতে চাচ্ছেন তিনি। তবে আক্রান্ত ওই ব্যক্তির হাতে তখন রক্ত দেখা যায়নি। জানা গেছে, সানসিলার গাড়িতে হামলা হয়েছে ঠিকই তবে কেউ রক্তাক্ত হয়নি।
ভিডিওটিতে নিজেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ব্যক্তি বলে উল্লেখ করে ডিসি অফিসের অনেককে হুমকি দিতে দেখা গেছে সানসিলাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ভিডিওটি ঘুরছে। ভিডিওটি শেয়ার দিয়ে আশিকুর রহমান অণু লিখেছেন, ‘বাজারে এসেছে নতুন গুজব রাণী বিএনপির প্রার্থী ডা.সানসীলা। নওশাবা আউট, সানসীলা ইন।’
একই ভিডিও ফেসবুকে আপলোড দিয়ে আল জোবায়ের লিখেছেন, ‘মিথ্যাচার ও গুজব হতে সতর্ক থাকুন।’ এসব পোস্টে সানসিলাকে গুজব ছড়ানো অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদের সঙ্গে তুলনা করা হয়। কোটা আন্দোলনের সময় গুজব ছড়ানো অভিযোগে যিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। একই কায়দায় গুজব ছড়িয়ে তরুণ সমাজকে রাস্তায় নামানোর অপকৌশলের অভিযোগে সানসিলাকে গ্রেফতারের দাবিও তুলেছে অনেক ফেসবুকার। কেউ কেউ বলছেন, ভার্র্চুয়াল অপপ্রচার প্রতিরোধে সবার আরও বেশি সচেতন হওয়া উচিৎ। সচেতনতাও কমাতে পারে গুজব কিংবা অপপ্রচার।
সারাবাংলা/ইএইচটি/এমএম
অপপ্রচার ইউটিউব নির্বাচন নির্বাচন ২০১৮ প্রচারণা প্রপাগান্ডা ফেসবুক ভার্চুয়াল