ঢাকা: হেনলি পাসপোর্ট সূচক ২০২৫ অনুযায়ী ভারতীয় পাসপোর্টের স্থান বিশ্বের ১৯৯টি দেশের মধ্যে ৮৫তম, যা গত বছরের তুলনায় পাঁচ ধাপ নিচে নেমেছে। ভারতের নাগরিকরা ৫৭টি দেশে ভিসা-মুক্ত প্রবেশাধিকার উপভোগ করতে পারে, তবে র্যাংকে পতনের কারণ হিসেবে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা ও কূটনৈতিক অবস্থানের প্রভাব প্রধান বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাসপোর্টের র্যাংক শুধুমাত্র ভিসা-মুক্ত দেশগুলোর সংখ্যা দ্বারা নির্ধারিত হয় না। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, অভিবাসন নীতি এবং কূটনৈতিক সংযোগও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
প্রতিবেশী বনাম পশ্চিমা দেশ
ভারতের পাসপোর্টের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা যায় পশ্চিমা ও ইউরোপীয় দেশগুলিতে। ভুটান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল এবং মালদ্বীপের মতো প্রতিবেশী দেশ ভারতীয় পর্যটকদের তুলনামূলকভাবে স্বাগত জানালেও, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলিতে ভিসার জন্য কঠোর প্রক্রিয়া বিদ্যমান।
একজন ভ্রমণ প্রভাবশালী সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিওতে বলেছিলেন, ‘ভুটান ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলিতে ভ্রমণ সহজ হলেও, পশ্চিমা দেশগুলিতে ভিসার প্রক্রিয়া দীর্ঘ, ব্যয়বহুল এবং জটিল। ভারতীয় পর্যটকরা এখনও এই ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন।’
ভারতের এই দুর্বলতা নাগরিকদের ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক ভ্রমণের সুযোগ সীমিত করছে এবং দেশের শক্তি ও বিশ্বব্যাপী প্রভাব কমাচ্ছে।
ভিসা-মুক্ত গন্তব্যের সংখ্যা বনাম র্যাংকিং
ভারতের নাগরিকদের জন্য ভিসা-মুক্ত গন্তব্যের সংখ্যা ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৫ সালে ৫২টি দেশে ভারতীয়রা ভিসা-মুক্ত ভ্রমণ করতে পারত, যা ২০২৩ সালে বেড়ে ৬০ এবং ২০২৪ সালে ৬২ হয়েছে। তবুও, হেনলি সূচকে ভারত ৮৫তম।
বিশেষজ্ঞরা ব্যাখ্যা করছেন, এই ‘অসঙ্গতি’ মূলত বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের কারণে। বিশ্বজুড়ে দেশগুলি তাদের নাগরিকদের জন্য ভিসা-মুক্ত গন্তব্যের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, চীন মাত্র দশ বছরে ৫০টি থেকে ৮২টি দেশে ভিসা-মুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করেছে, ফলে তার র্যাংক ৯৪ থেকে ৬০-এ উন্নীত হয়েছে।
এটি নির্দেশ করে যে শুধু ভিসা-মুক্ত দেশ বাড়ানো যথেষ্ট নয়; বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর পদক্ষেপের তুলনায় ভারতীয় পদক্ষেপের প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ।
ইতিহাস ও কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট
ভারতের পাসপোর্ট শক্তি ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭০-এর দশকে ভারতীয়রা অনেক পশ্চিমা ও ইউরোপীয় দেশে ভিসা-মুক্ত ভ্রমণ করত। তবে ১৯৮০-এর দশকের খালিস্তান আন্দোলন, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অভ্যন্তরীণ সংঘাত ভারতের স্থায়ী চিত্র ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
আর্মেনিয়ায় নিযুক্ত ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত আচল মালহোত্রা বলেছেন, ‘অনেক দেশ অভিবাসীদের প্রতি ক্রমশ সতর্ক হয়ে উঠছে। ভারতের নাগরিকদের দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান বা অবৈধ অভিবাসন পরিস্থিতি দেশের সুনামের ক্ষতি করছে।’
অন্যদিকে, দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং বিদেশি নাগরিকদের জন্য গ্রহণযোগ্য নীতি ভারতীয় পাসপোর্টের মানকে প্রভাবিত করে।
নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি
ভারতের পাসপোর্ট নিরাপত্তা সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। ২০২৪ সালে দিল্লি পুলিশ ভিসা ও পাসপোর্ট জালিয়াতির অভিযোগে ২০৩ জনকে গ্রেফতার করেছে।
তবে ইলেকট্রনিক পাসপোর্ট (ই-পাসপোর্ট) চালু হওয়ার ফলে সুরক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে। বায়োমেট্রিক চিপ সংযুক্ত ই-পাসপোর্ট নথি জালিয়াতি এবং কারচুপি প্রতিরোধ করে। এটি ভারতীয় নাগরিকদের নিরাপদ ভ্রমণের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও প্রতিক্রিয়া
বিশ্বব্যাপী দেশগুলি ক্রমশ নিজেদের নাগরিকদের সুবিধার জন্য ভিসা-স্বাধীনতা সম্প্রসারণ করছে। ২০২৫ সালে গড় ভিসা-মুক্ত দেশ সংখ্যা ১০৯, যা ২০০৬ সালের ৫৮টির দ্বিগুণ। এতে ভারতীয় পাসপোর্টের অবস্থান প্রভাবিত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু ভিসা-বৃদ্ধি নয়, কূটনৈতিক সংযোগ, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বই ভারতের স্থান পুনরুদ্ধারের মূল চাবিকাঠি।
প্রভাব ও নাগরিকদের জন্য প্রাসঙ্গিকতা
ভারতের পাসপোর্টের দুর্বলতা নাগরিকদের জন্য কয়েকটি প্রভাব ফেলেছে:
-
আন্তর্জাতিক ভ্রমণে দীর্ঘ অপেক্ষা ও অতিরিক্ত খরচ
-
ব্যবসায়িক ও শিক্ষামূলক ভ্রমণে সীমাবদ্ধতা
-
দেশের নরম শক্তি ও আন্তর্জাতিক প্রভাবের হ্রাস
তবে, সাম্প্রতিক দশকে ভিসা-মুক্ত গন্তব্যের বৃদ্ধি নির্দেশ করছে যে ধীরগতিতে হলেও ভারতীয়দের ভ্রমণ সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতের পাসপোর্টের শক্তি বৃদ্ধি করতে হলে কেবল প্রযুক্তিগত উন্নয়ন যথেষ্ট নয়। এজন্য প্রয়োজন:
-
আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সংযোগ বৃদ্ধি
-
দ্বিপাক্ষিক ও বহু-পাক্ষিক ভ্রমণ চুক্তি সম্প্রসারণ
-
অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করা
-
আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির উন্নয়ন
ভারতের নাগরিকদের ভিসা-মুক্ত গন্তব্য বৃদ্ধি, ই-পাসপোর্ট প্রযুক্তি এবং কূটনৈতিক উদ্যোগ একসাথে কাজে লাগালে ভারতীয় পাসপোর্টের র্যাঙ্কিং উন্নত করা সম্ভব। এটি কেবল নাগরিকদের জন্য সুবিধা নয়, দেশের নরম শক্তি এবং বিশ্বব্যাপী প্রভাব বৃদ্ধিতেও সহায়ক হবে।