হায়া সোফিয়া ও এরদোগান: মতাদর্শ এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বিতর্ক
১৮ জুলাই ২০২০ ১৫:৫১
রাজনৈতিক বিপণনে একটি পরিচিত কৌশল হচ্ছে- ক্রাইসিস মাইগ্রেশন স্ট্র্যাটেজি বা সংকট স্থানান্তর কৌশল। সম্প্রতি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান যেভাবে এই কৌশলটির চর্চা করলেন তা বেশ আকর্ষণীয়। বাইজেন্টাইন আমলের চার্চ ও পরে মসজিদ ও জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হায়া সোফিয়াকে মসজিদে পরিণত করে তিনি তুরস্ক ও সারা বিশ্বের মনোযোগ সেদিকে ফিরিয়েছেন। জাতিসংঘসহ বিশ্ব নেতৃত্বের বড় অংশ তুরস্কের এ সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছে। জাতিসংঘ তুরস্কের এই পদক্ষেপে হতাশা জানিয়ে এবং এটিকে অবৈধ উল্লেখ করে একটি বিবৃতি দিয়েছে।
ইউনেস্কোর মহা পরিচালক অড্রে আজুলেই তুরস্ক প্রতিনিধিদের জানিয়েছেন, হায়া সোফিয়া ইস্তানবুলের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর একটি এবং বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকার মধ্যে এটি অন্যতম। তিনি এই স্থাপনাটিকে একটি ‘আর্কিটেকচারাল মাস্টারপিস’ এবং কয়েক শতাব্দী ধরে ইউরোপ ও এশিয়ার সেতুবন্ধনের এক অনন্য নজির হিসেবে উল্লেখ করেন। জাদুঘর হিসেবে এর মর্যাদা পারস্পরিক আলোচনার পক্ষে এক শক্তিশালী প্রতীক বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এরদোগানের এই পদক্ষেপটি মূলত তার দেশের অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে মনোযোগ সরানোর একটি কৌশল। লিবিয়া ও সিরিয়ায় তার বেপরোয়া নীতির কারণে বিপরীত ফলাফল, উগ্রবাদী সংগঠনগুলোর প্রতি সমর্থন, উত্তেজনাপূর্ণ অঞ্চলে সন্ত্রাসীদের মদদ দেওয়া এবং তুরস্কের ভঙ্গুর কূটনৈতিক পদক্ষেপের কারণে ইউরোপসহ সবার সঙ্গেই বিবাদে জড়িয়েছে দেশটি। এতে নিকট ভবিষ্যতে কারো সঙ্গে সুসম্পর্কের আশা নেই তুরস্কের।
এরদোগানের এমন আচরণ শুধু কূটনৈতিক উগ্রতারই প্রমাণ নয় বরং ইসলামের ধারণারও সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। এরদোগানের এ ধরণের পদক্ষেপ সভ্যতার মধ্যে দ্বন্দ্ব উস্কে দেয় এবং ‘ইসলামফোবিয়া’কে আরও চাঙ্গা করে তুলে। এ ধরণের আচরণ উগ্রবাদী ও সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী যারা মূলত ঐতিহাসিক বিষয়, স্থাপনা ও সভ্যতার নিদর্শনগুলোকে ইস্যু বানিয়ে তা নিয়ে খেলা করতে পছন্দ করে- ঠিক তাদের সঙ্গে মিলে যায়।
হায়া সোফিয়া মূলত চার্চ হিসেবেই তৈরি করা হয়েছিলো। অটোমানরা মসজিদে রূপান্তর করার আগে এটি ছিলো বাইজেন্টাইন ঐতিহ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনের অন্যতম। পরে এটি মুস্তফা কামাল আতার্তুকের আমলে জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়। এই স্থাপনাটির নামের অর্থ ‘পবিত্র জ্ঞান’।
ইস্তানবুলের হায়া সোফিয়া এই ধরণের রূপান্তরের প্রথম উদাহরণ নয়। আরও চারটি বাইজেন্টাইন চার্চকে গত এক দশকে মসজিদে পরিণত করে তুরস্ক। এর মধ্যে একটি স্থাপনা রয়েছে ট্রাবজনে, যেখানে গ্রিকরা বসবাস করত, সেটিও পবিত্র জ্ঞান (হায়া সোফিয়া) বলেই নামকরণ করা হয়েছিলো। গত এক দশকে চারটি চার্চকে এরদোগানের পলিটিকাল ইসলাম প্রকল্পের আওতায় মসজিদের রূপান্তর করা হয়।
অন্যান্য চার্চগুলো মসজিদে রূপান্তরিত হলেও ইস্তানবুলের হায়া সোফিয়াকে নিয়ে এবার অধিক আলোচনার কারণ এটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব। হায়া সোফিয়া চার্চ হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটি ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত হয়। প্রাচ্যে খ্রিস্টিয় জগতের ‘গ্র্যান্ড ওল্ড লেডি’ হিসেবে পরিচিত ছিলো এটি। খ্রিস্টান সাহিত্যে হায়া সোফিয়া ইস্তানবুলের গুম্বজ হিসেবে পরিচিত।
হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করার সিদ্ধান্তটি এসেছে এরদোগানের রাজনৈতিক দল একেপি পার্টির সঙ্গে যুক্ত একটি এনজিও’র আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে। এই আবেদনে ১৯৩৪ সালে তুরস্কের সুপ্রিম প্রশাসনিক আদালতের জারি করা এক রায় বাতিলের আবেদন জানানো হয়। নতুন অটোমান যুগ চালু করার প্রকল্প হাতে নেওয়া এরদোগানের মনোভাব দেখে এটি আগেই বুঝা গিয়েছিলো যে তিনি এই আবেদনে সমর্থন জানাবেন। তাই হয়েছে পরে। গত বছর এক বিবৃতিতে এরদোগান বলেছিলেন, হায়া সোফিয়াকে মসজিদ থেকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্তটি একটি বড় ভুল ছিল।
এক মাস আগে এরদোগান ১৫ জুলাই হায়া সোফিয়ায় নামাজ পড়ার প্রস্তাব দেন। এই তারিখটি এমন একটি তারিখ যা ২০১৬ সালে এরদোগানকে উৎখাতে এক ব্যর্থ ক্যু’র তারিখের সঙ্গে মিলে যায়। তিনি এখানেও ইসলামিক লোকরঞ্জনবাদ কাজে লাগিয়ে তার রাজনৈতিক ভাবমূর্তি বাড়ানোর চেষ্টা করেন।
হায়া সোফিয়া অটোমানদের আগে কখনই মসজিদ ছিল না। ১৪৫৩ সালে অটোমানরা ইস্তানবুল বিজয়ের পর সুলতান মেহমুদ দ্বিতীয় তার ২১ বছর বয়েসে পাঁচ শতাব্দী প্রাচীন এই চার্চকে মসজিদে রূপান্তরের আদেশ দেন। অটোমান আমলে হায়া সোফিয়ার প্রাচীন নিদর্শণগুলো লোকচক্ষুর আড়াল করতে ঢেকে রাখা হয়। কামাল আতার্তুক এটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করার পর তা আবার উন্মোচন করা হয়।
তুরস্কে অর্থনৈতিক বিপর্যয়, সিরিয়া ও লিবিয়ায় তুর্কি সেনাদের ব্যর্থতা এবং দেশটির সর্বোপরি মারাত্মক কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণে দেশে এরদোগানের ভাবমূর্তি ইতিমধ্যে তলানিতে। বিশেষ করে সম্প্রতি ১০০০ কক্ষের একটি প্রাসাদ নির্মাণের পর এবং পরিবারের কিছু সদস্যদের নাম আর্থিক কেলেঙ্কারিতে যুক্ত হওয়ায় দেশে তার ভাবমূর্তির চরম ক্ষতি হয়েছে। এসব কারণই এরদোগানকে দেশে ও দেশের বাইরে ভাবমূর্তি ফেরানোর তাড়না যুগিয়েছ। এক্ষেত্রে তিনি অতি জাতীয়তাবাদী ও অতি ধর্মীয় স্লোগানকে কাজে লাগিয়েছেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েও তিনি যেসব দেশের ক্ষতি করতে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতেও তিনি এসব স্লোগান ব্যবহার করছেন।
সম্প্রতি প্রখ্যাত সাময়িকী ইকোনমিস্টের এক জরীপে দেখা গেছে, তুরস্কের বহু মানুষ হায়া সোফিয়াকে জাদুঘর থেকে মসজিদে রূপান্তরের সিদ্ধান্তে সাধুবাদ জানিয়েছেন। বিশেষ করে এরদোগান এই পদক্ষেপকে অটোমানদের গৌরব ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা হিসেবে উল্লেখ করায় তুরস্কের নাগরিকরা খুশি। তবে ওই একই জরীপে এটিও উঠে আসে যে, এরদোগান এই মুহূর্তে এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন শুধুমাত্র তুরস্কের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো, বিশেষ করে অর্থনৈতিক সংকট থেকে মনোযোগ সরাতে। তুরস্কের অভ্যন্তরীণ সূত্রের বরাত দিয়ে কিছু প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে তুরস্কে অগ্রিম নির্বাচনের কথাও ভাবছে সরকার।
সম্প্রতি করোনাভাইরাস মহামারির সময়েও এরদোগান বিরুধীদের ওপর দমন-পীড়ন বেড়ে গেছে। গত মাসে পার্লামেন্টে তিন বিরোধী সদস্য ও চার মানবাধিকার কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তুরস্ক কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি বেশ কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত একটি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছে। এসব দমন পীড়ন থেকে মনোযোগ সরাতেও এটি কাজে লাগিয়েছেন এরদোগান।
হায়া সোফিয়া নিয়ে এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারের ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির সোনার ক্যাগাপ্টে একটি মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, এরদোগান আসলে হায়া সোফিয়াকে রক্ষা করছেন না, মূলত তিনি কামাল আতার্তুকের বিপ্লবের সমান তার নিজস্ব আরেকটি বিপ্লব করতে চান তুরস্কে। সেই প্রতিশ্রুতির প্রতি তার স্বদিচ্ছা প্রমাণ করতেই হায়া সোফিয়া বিষয়েএই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তুরস্কের পাবলিক প্লেস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারে রক্ষণশীল ইসলাম স্থাপনের মধ্যে তিনি এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবেন।
আরব নিউজের কলাম বিভাগে প্রকাশিত নিবন্ধটি বাংলায় অনূদিত।