Friday 25 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যেসব কারণে গ্রেফতার হলেন বিচারপতি খায়রুল

রাশেদ মামুন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২৪ জুলাই ২০২৫ ১১:০১ | আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২৫ ১৩:৫০

সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খাইরুল হক। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: বিচারাঙ্গনে তুমুল আলোচিত-সমালোচিত নাম এবিএম খায়রুল হক। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খুশি রাখাই ছিল যার অন্যতম কাজ। তার বেশ কিছু রায় ঘিরে এখনও চলছে বিতর্ক। তবে গেল ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি তাকে। অবশেষে ডিবির জালে ধরা পড়েছেন বিচার বিভাগকে ‘কলঙ্কিত’ করা সাবেক এই প্রধান বিচারপতি।

রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার নিজ বাসা থেকেই গ্রেফতার হন খায়রুল হক।

বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) সকাল ৮টার পর তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। বর্তমানে তিনি ডিবি কার্যালয়ে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ডিবির যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর দেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন এবিএম খায়রুল হক। কিন্তু ৬৭ বছর পূর্ণ হওয়ায় ২০১১ সালের ১৭ মে অবসরে যেতে হয় তাকে। তবে এ ক’দিনেই বিচার অঙ্গনে বেশ কিছু রায় দেন তিনি। আর এসব কাজের জন্য পুরস্কারও পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ মেয়াদ পর্যন্ত আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের পদে বসান শেখ হাসিনা।

শুধু তাই নয়, একাধিক জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে ডিঙিয়ে খায়রুল হককে বানানো হয়েছিল দেশের প্রধান বিচারপতি। আর সেই প্রতিদানও পেয়েছেন শেখ হাসিনা। অবসরে যাওয়ার কিছুদিন আগে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেন তিনি। ফলে দেশে উন্মুক্ত হয় রাজনৈতিক সংঘাতের পথ। একইসঙ্গে ভোট কারচুপির সুযোগও করে দেওয়া হয়।

প্রধান বিচারপতির আসনে বসে রাজনৈতিক অঙ্গনেও চরকি ঘোরাতেন এবিএম খায়রুল। কেননা রাজনৈতিক বিষয় আদালতের আওতায় নিয়ে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ‘স্বাধীনতার ঘোষক নন’ বলেও রায় দিয়েছিলেন তিনি। এভাবেই নিজের কলমের খোঁচায় অসংখ্য বিতর্কিত রায় দেন এই বিচারপতি। এসব কর্মকাণ্ডে দেশের ক্ষতি হলেও নানাভাবেই সুবিধা পেয়েছেন আওয়ামী লীগের শাসনামলে।

২০১১ সালের ১০ মে। এদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানসম্বলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের মৌখিক রায় দেন এবিএম খায়রুল। আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত এ রায়ে আরও দুই মেয়াদে নির্বাচন করার পথ খোলা রাখা হয়। কিন্তু ভিন্নতা ছিল লিখিত রায়ে। মূলত শেখ হাসিনার মন জয় করতেই তিনি এ পথ বেছে নেন বলে অভিযোগ অনেকের। এ নিয়ে প্রশ্নও তুলেছিলেন দেশের ১১তম প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী।

তথ্যমতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশেষ ব্যবস্থা বহাল রাখার পরামর্শ দেন তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমসহ শীর্ষ আইনজীবীরা। শুনানির সময় প্রয়াত জ্যেষ্ঠ আইনজীবী টিএইচ খানও বিরোধিতা করেন। কিন্তু এসবে মোটেও কান দেননি খায়রুল হক। বিভক্ত রায়েই বাতিল হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। এমনকি পূর্ণাঙ্গ রায়ের আগেই ২০১১ সালের ৩০ জুন নবম সংসদে নির্দলীয় সরকারের বিধান বিলুপ্ত করে দেয় আওয়ামী লীগ সরকার।

সংবিধান থেকে বাদ দেওয়ার প্রায় ১৬ মাস পর প্রকাশিত হয় ৩৪২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়। তখন খায়রুল হক আর প্রধান বিচারপতির আসনে ছিলেন না। কিন্তু সংক্ষিপ্ত রায়ে থাকা আরো দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে পারার কথাটি ছিল না। উলটো সরকারের মেয়াদ শেষে সংসদ বহাল থাকার কথা যুক্ত করা হয় পূর্ণাঙ্গ রায়ে।

সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ে ছয়জনের মধ্যে তিনজনই খায়রুলের কথায় সায় দেন। এর মধ্যে বিচাপরতি এস কে সিনহা অন্যতম। আর রায়ের বিপক্ষে ছিলেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা ও নাজমুন আরা সুলতানা। অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পর কোনো রায় পরিবর্তন করা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে জানিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।

তথ্য বলছে, আইন পেশা শুরুর দীর্ঘ ২৫ বছর পর বদলাতে থাকে খায়রুলের ভাগ্য। ১৯৯৮ সালের এপ্রিলে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকের মধ্য দিয়েই শুরু হয় সেই যাত্রা। মূলত হাইকোর্ট বিভাগের চারটি বেঞ্চ পরপর শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার আপিল শুনানিতে বিব্রতবোধ করায় তাকে নিয়োগ দেন শেখ হাসিনা। সেদিনই এ হত্যা মামলার আপিল শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হয়। এমনকি আপিলের রায়ে বিচারপতি রুহুল আমিনের সঙ্গে দ্বিমত জানিয়ে নিজের প্রভাব খাটিয়ে ঘুরিয়ে দেন পুরো রায়।

খায়রুলের অপকর্ম এখানেই শেষ নয়, স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমানের নাম বাদ দিয়ে বানানো হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। ২০০৯ সালের ২১ জুন দেওয়া হয় বিতর্কিত এ রায়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি নিয়ে করা লিভ টু আপিলও না শুনে খারিজ করে দেন এই বিচারক।

প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নিয়েই আইন অঙ্গনের প্রথা ভাঙেন খায়রুল হক। তিনিই প্রথম সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতির দফতরে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি টানান। অথচ এর আগে কোনো রাজনৈতিক নেতার ছবিই টাঙানো হয়নি। বিচারকের আসনে মোটা অংকের সুযোগ-সুবিধা থাকলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের টাকার লোভ সামলাতে পারেননি তিনি। চিকিৎসার কথা বলে এই তহবিল থেকে অর্থ নিয়েছেন একাধিকবার।

খায়রুল হকের দফতরে ১০ লাখ টাকার চেক পৌঁছে দেন তৎকালীন একজন তরুণ আইনজীবী। চেকটি পাওয়ার পর নিজের অ্যাকাউন্টে জমা দেয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে পাঠান তিনি। ২০০৯ সালের ২৭ জুলাই সোনালী ব্যাংকের সুপ্রিম কোর্ট শাখায় খায়রুল হকের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে এ টাকা জমা হয়। ভবিষ্যতে প্রশ্ন ওঠার ভয়ে একই দিন তিনি ৯ লাখ টাকা উত্তোলন করেন।

আইনজীবী মনোয়ার হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, দেশের বিচার বিভাগ ধ্বংসের অন্যতম কারিগর এবিএম খায়রুল হক। আইন বহির্ভূত বিভিন্ন রায় দিয়ে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় পেশাজুড়েই তিনি শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করে গেছেন। মাঝে কলঙ্কিত হয়েছিল পুরো বিচার অঙ্গন। এছাড়া হাসিনার অনুগত থাকার কারণেই অবসরে যাওয়ার পরও পুরস্কার হিসেবে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান দায়িত্ব পান তিনি।

এই আইনজীবী বলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে খায়রুলের পদও আমরণ থাকতো। তাকে সরানোর মতো অন্য কেউই ছিলেন না। শুধুমাত্র জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসকের পতনের পর তিনিও পদত্যাগে বাধ্য হন। এককথায় আওয়ামী লীগের আদেশ-নির্দেশে অন্যান্য বিচারকদেরও দাম দিতেন না এবিএম খায়রুল। দলীয় স্বার্থে সব অপকর্মই জায়েজ করতেন তিনি। তার কারণে বিচার বিভাগকে নিয়ে আঙুল তুলে কথা বলার সাহস করেন অনেকে।

এ প্রসঙ্গে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট ইমরুল কায়েস রানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট বানানোর অন্যতম কুশীলব হলেন খায়রুল হক। জুলাই-আগস্টে গণহত্যার দায়ে হাসিনা বাদে যদি অন্য কাউকে মূলহোতা হিসেবে তার বিচার করতে হবে। তাকে রিমান্ডে নিলে চক্রান্তের সব নীলনকশার কথা বেরিয়ে আসবে বলেও মনে করছেন তিনি।’

এরই মধ্যে খায়রুল হকের বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা হয়েছে। গত বছরের ১৮ আগস্ট তার বিরুদ্ধে মামলা করেন ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য ইমরুল হাসান। তার বিরুদ্ধে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পরিবর্তন ও জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়। ২৮ আগস্ট দুর্নীতি ও রায় জালিয়াতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করেন আরেক আইনজীবী। এছাড়া ২৫ আগস্ট একই ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায় আরেকটি মামলা হয়।

সারাবাংলা/আরএম/এমপি

এবিএম খায়রুল হক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রেফতার প্রধান বিচারপতি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর