একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা নিয়ে আইনজীবীরা যা বলছেন
১ ডিসেম্বর ২০২৪ ২০:৫১ | আপডেট: ১ ডিসেম্বর ২০২৪ ২২:৪৯
ঢাকা: বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সব আসামিকে খালাস দিয়েছেন আদালত।
ওই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের (মৃত্যুদণ্ডের জন্য হাইকোর্টের অনুমোদন) শুনানি নিয়ে রোববার (১ ডিসেম্বর) সকাল ১১টায় বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. জসিম সরকার, রাসেল আহমেদ ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল লাবনী আক্তার।
লুৎফুজ্জামান বাবর, আবদুস সালাম পিন্টুসহ দণ্ডিত বেশ কয়েকজনের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী এস এম শাহজাহান। এ ছাড়া লুৎফুজ্জামান বাবরসহ আরও তিন আসামির পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে স্থাপিত ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিনের আদালত আলোচিত এ মামলার ঘোষণা করেছিলেন।
মামলার অন্যতম আইনজীবী এস এম শাহজাহান বলেন, মামলাটি সাক্ষ্য এবং আইনের কোনও দিক থেকেই প্রমাণিত হয়নি। কোনও একজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে অন্য আসামিকে সাজা দেওয়া যায় না। একজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে দণ্ডবিধির ১২০(খ) (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের শাস্তি) প্রমাণ করা যায় না। আর সাক্ষ্য আইনের ১০ ধারা অনুযায়ী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে ষড়যন্ত্রকারীর কথা বা কার্য স্বাধীন হতে হবে।
তিনি বলেন, মামলায় মুফতি হান্নানের প্রথম ও দ্বিতীয় দুটি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ছাড়া আর কোনও সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় অভিযোগপত্রে তারেক রহমানসহ অন্যান্য যাদের আসামি করা হলো, তাদের বেলায়ও দেখা গেছে মুফতি হান্নানের দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ছাড়া আর কোনও সাক্ষ্য-প্রমাণ নাই। দুটি জবানবন্দিই মুফতি হান্নান জীবদ্দশাতেই প্রত্যাহার করে গেছেন। ফলে প্রত্যাহার করা স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে কাউকে সাজা দেওয়া যায় না। এমনকি যে আসামি স্বীকারোক্তি দিয়েছেন উনি যদি বেঁচে থাকতেন, তার বিরুদ্দেও এটা প্রযোজ্য হত না।
আইনজীবী এস এম শাহজাহান বলেন, আদালত দ্বিতীয় অভিযোগপত্র বেআইনি ঘোষণা করেছেন। দ্বিতীয় অভিযোগপত্র নিয়ে আইনের যে বিধান আছে, অফিসার ইনচার্জ নতুন কোনও সাক্ষ্য-প্রমাণ পেলে সম্পূরক অভিযোগপত্র দিতে পারেন। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, দ্বিতীয় অভিযোগপত্রটি পাবলিক প্রসিকিউটরের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দাখিল করা হয়েছে। এ কারণে আদালত দ্বিতীয় অভিযোগপত্রটি অবৈধ ঘোষণা করেছেন।
জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী আরও বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগ আমলে না নিলে দায়রা আদালতে সরাসরি অভিযোগপত্র দাখিল করা যায় না। এখানে এই কার্যবিধির ১৯৩(১) ধারা পালন করা হয়নি।
তিনি বলেন, পাবলিক প্রসিকিউটরের আবেদনটি মঞ্জুর করে আদালত যখন মামলাটি পুনঃতদন্তের জন্য পাঠালেন, পুনঃতদন্তের প্রতিবেদন আসার পর সেই অভিযোগপত্র আবার কোনও ম্যাজিস্ট্রেট গ্রহণ করেননি। সরাসরি এটি মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়, মহানগর দায়রা আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৩ ধারা অনুসারে আমলে নিয়েছেন। হাইকোর্ট রায়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, দ্বিতীয় অভিযোগপত্রটি আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে ১৯৩(১) ধারা অনুসরণ করা হয়নি।
আইনজীবী শাহজাহান বলেন, এ মামলায় প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ছিল না। আদালতে দেওয়া ২২৫ জন সাক্ষীর কেউই বলেননি, আমি গ্রেনেড ছুড়েছি বা ছুড়তে দেখেছি। ফলে, প্রকৃত খুনি কে সেটি নাই। এক্ষেত্রে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুসারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না।
মামলার অভিযোগপত্র, আসামির দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং প্রত্যক্ষ সাক্ষী না থাকার পরও সর্বোচ্চ সাজাসহ অন্যান্য দণ্ড দেওয়ায় বিচারিক আদালতের রায়টি হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেছেন। এ কারণে যারা বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে যারা আপিল করেননি, তাদেরসহ হাইকোর্ট সব আসামিকে খালাস দিয়েছেন। এর ফলে তারেক রহমান, কায়কোবাদসহ যারা আপিল করেননি তাদের খালাস দেওয়া হয়েছে। অর্থ্যাৎ এই মামলাটি নথিশুদ্ধ খালাস হয়েছে।
তবে ২১ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিন্দা জানান জানিয়ে আইনজীবী শাহজাহান বলেন, অপরাধের গুরুত্ব বা নৃসংশতা যতটাই হোক না কেন, আসামিকে সাজা দিতে হলে তার সম্পৃক্ততা দেখতে হবে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এই মামলার তদন্ত হয়ে যে অভিযোগপত্র আসলো, যে বিচার ১৬ বছর ধরে চললো তার নিষ্পত্তি হলো আজ। আর এ মামলায় আপিলকারী এবং যারা আপিল করতে পারেননি তাদের সবাইকে খালাস দিয়েছেন আদালত। অর্থ্যাৎ এ মামলাটি নথিসুদ্ধ খালাস হয়েছে।
আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, এ মামলায় রুল যথাযথ ঘোষণা করে সকলকেই খালাস দেওয়া হয়েছে। (রায়ে) বলা হয়েছে, নিম্ন আদালত যে ট্রায়ালটা করেছে, এই ট্রায়ালটা ছিল অবৈধ, কারণ আইনের ভিত্তিতে এই ট্রায়ালটা সংঘটিত হয় নাই। এবং মামলায় কোনও সাক্ষীর সঙ্গে কোনও সাক্ষীর কোলাবরেশন নাই। শোনা সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে এই সাজা দেওয়া হয়েছে। এজন্যই সকলের আপিল একসেপ্ট (গ্রহণ) করে, ডেথ রেফারেন্স রিজেক্ট (বাতিল) করে সকল আসামিকে খালাস দিয়েছেন। আদালত তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সকলকেই এই মামলায় বেকসুর খালাস দিয়েছেন।
আইনজীবী শিশির মনির বলেন, কোর্ট পর্যবেক্ষণে বলেছেন, এই মামলায় সাক্ষীদের পরস্পর কেউ দেখেছে, কেউ সচক্ষে দেখেছে, এ ধরনের কোনও এভিডেন্স নেই। যাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে, তা টর্চার করে নেওয়া হয়েছে। এ মামলায় মুফতি হান্নান দুটি স্বীকারোক্তি জবানবন্দি দিয়েছেন। আমরা সাবমিশনে বলেছিলাম,ভারতীয় সাবকন্টিনেন্টে ৪০০ বছরের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে দ্বিতীয় স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে কাউকে সাজা দেওয়া হয়েছে, তার কোনও নজির নেই। আজকে আদালত বলছেন, মুফতি হান্নান দ্বিতীয় স্বীকারোক্তি যেটা করেছিলেন, এটাও পরবর্তীতে তিনি প্রত্যাহার করেছেন। এজন্য এই স্বীকারোক্তির আইনগত কোনও মূল্য নেই।
আইনজীবী কায়সার কামাল সাংবাদিকদের বলেন, একই মামলায় দুটি অভিযোগপত্র এবং মুফতি হান্নানের দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রায়ে আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই মামলায় তারেককে আসামি করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আব্দুল কাহার আকন্দকে (যিনি আওয়ামী লীগ থেকে এমপি পদে নির্বাচন করেছেন) তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করে তার চার্জশিটে তারেক রহমানকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এ মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আদালত বলেছেন, মুফতি মান্নানের দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতে যে চার্জশিট দেওয়া হয়, সেই চার্জশিটটি আইন পরিপন্থি ছিল। ফৌজদারি কার্যবিধি এবং সাক্ষ্য আইনে এই চার্জশিটের আইনগত ভিত্তি নেই। এজন্য আদালত আসামিদের খালাস দিয়েছেন।
ব্যারিস্টা কায়সার কামাল বলেন, তারেক রহমান সাহেব আজকের এই রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার পেয়েছেন। আজকে প্রমাণিত হয়েছে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তারেক রহমান সাহেবকে যে মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছিল, সেই মামলায় আইগতভাবে মোকাবেলার মাধ্যমে তিনি বেকসুর খালাস পেয়েছেন।
তিনি বলেন, আমরা ও দেশবাসী মনে করেন তারেক রহমান সম্পূর্ণভাবে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রোপাগান্ডার শিকার হয়েছিলেন।
রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান বলেন, হাইকোর্টের রায় দেখে ও সরকারের নির্দেশনা নিয়ে আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। তবে আমি মনে করি, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা উচিত।
সারাবাংলা/কেআইএফ/এসআর