ঢাকা: ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার তিনটি আপিল আবেদন নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নামঞ্জুর করেছিলেন নুরুল হুদা কমিশন। এতে করে তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ওই নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। খালেদা জিয়ার আপিল নামঞ্জুরের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দিনের ভোট রাতে করার অন্যতম কারিগর তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা। ২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বর নির্বাচনে কমিশনের আপিল শুনানিতে এই রায় দিয়েছিলেন নূরুল হুদা কমিশন। যদিও এই রায়ের বিরোধীতা করে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছিলেন খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে কোন বাধা নেয়নি। কিন্তু তা আমলে নেয়নি আওয়ামী পন্থী সিইসিসহ বাকি তিন কমিশানার।
জানা গেছে, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার তিনটি আসনের আপিল আবেদন গ্রহণের পক্ষে মত দিয়েছিলেন তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। অন্যদিকে ভিন্ন মত পোষণ করেন কমিশনার রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাহাদাত হোসেন। এরপর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদাও এই তিন নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। ফলে নির্বাচন কমিশনের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে খালেদা জিয়ার আপিল খারিজ হয়ে যায়। পরবর্তীতে উচ্চ আদালতেও ইসির নির্দেশনা বহাল থাকায় একাদশ জাতীয় নির্বাচনে খালেদা জিয়া অংশ নিতে পারেননি।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বর সকালে রাজধানীর আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে আপিল শুনানিতে অংশ নিয়ে খালেদা জিয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছিলেন তার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী। পরে শুনানি মুলতবী রেখে বিকেল ৫টায় পুণরায় শুনানির কথা জানিয়ে দেয় কমিশন। এরপর প্রায় পৌনে ১ ঘণ্টা সিইসিসহ পাঁচজন কমিশনার সিইসির দফতরে বৈঠকে বসেন। সন্ধ্যায় খালেদার মুলতবি শুনানি আবার শুরু হয়। এ সময় খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী, জয়নুল আবেদীন ও মাহবুব উদ্দিন খোকন যুক্তিতর্কে অংশ নেন। তারা আইনের ধারা উল্লেখ করে খালেদা জিয়ার পক্ষে রায় দাবি করেন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের বিপক্ষে মত তুলে ধরেন।
শুনানির একপর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। তখন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলেন, ‘রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক যথাক্রমে বগুড়া-৬, ৭ ও ফেনী-১ আসনে খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিলের বিরুদ্ধে যে আপিল দায়ের করা হয়েছে, তা আইনগত বিশ্লেষণ করে আমার রায় এই আপিল মঞ্জুরের পক্ষে। আমি এই আপিল মঞ্জুর করলাম।’ এ সময় নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘এই রায় পূর্ণাঙ্গ নয়, এটি মাত্র একজনের রায়।’ তখন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম মাইক্রোফোন নিয়ে বলেন, ‘সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দণ্ডপ্রাপ্তরা নির্বাচন করতে পারেন না। আপিল মঞ্জুর করা যায় না। এ কারণে খালেদা জিয়ার আপিল নামঞ্জুর করা হলো।’ এরপর কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আপিল নামঞ্জুর করা হলো।’
পরে কমিশনার কবিতা খানমও এই দুই কমিশনারের পক্ষে মত দিয়ে বলেন, ‘খালেদা জিয়া দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হয়ে কারাগারে আছেন। সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে নৈতিক স্খলনজনিত কারণে দণ্ডিত। তার দণ্ড স্থগিত হয়নি। মনোনয়নপত্র বাতিল করে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসাররা যে আদেশ দিয়েছেন, তার স্পিরিট বিবেচনা করে আপিল নামঞ্জুর করছি।’
সব শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলেন, ‘আমি আমার কমিশনার রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও শাহাদাত হোসেন এই তিনজনের পক্ষে রায় দিলাম। এই আপিল আবেদন মঞ্জুর হয়নি।’
এর পরপরই ইসি সচিব বলেন, ‘খালেদা জিয়ার আপিল গৃহীত হয়নি। ৪-১ ভোটে এই আপিল নামঞ্জুর হলো। ফলে বিএনপি চেয়ারপারসন ভোটে অংশ নিতে পারছেন না।’
রায় ঘোষণা শেষে ব্যারিস্টার খন্দকার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আর কোনো আইনগত বাধা নেই। গত তিন দিন আমরা দেখেছি, আপিল শুনানি শেষে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কখনো সিইসি, কখনো অন্যান্য কমিশনার রায় ঘোষণা করেছেন। তারা কমিশনের সবার পক্ষ থেকেই রায় ঘোষণা করেছেন। সবাই ধারণা করেছিল মাহবুব তালুকদারের রায় সবার রায়। একবার রায় ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর, দ্বিতীয়বার রায় ঘোষণার কোনো সুযোগ নেই।
উল্লেখ্য ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে ভোটের আগের রাতেই ব্যালটে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে সিল মারার অভিযোগ রয়েছে। নির্বাচনে ২৯৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট পায় ২৮৮টি এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট পায় মাত্র আটটি আসন। রাতের ভোটের নির্বাচনের অন্যতম কারিগর বলা হয় সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদাকে। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি সব নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলেও তিনি নিজেকে সফল দাবি করেছিলেন। অথচ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অস্বাভাবিক ভোট পড়ে। কমপক্ষে ১৯৭টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ে। আর অন্তত ১ হাজার ৮৮৯টি কেন্দ্রে ভোট পড়ে ৯৫ থেকে ৯৯.৯৯ শতাংশ। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে দায়িত্ব ছাড়ার তিন বছর পর গতকাল ২২ জুন সিইসিতে এক মামলায় গ্রেফতার করে পুলিশ।