Tuesday 30 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রসংস্কার নিশ্চিতের আহ্বান টিআইবির

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ ২১:৩৩

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ফাইল ছবি

ঢাকা: জুলাই সনদের আলোকে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বির্নিমাণ ও কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও রাষ্ট্রসংস্কারের ধারাবাহিকতা রক্ষায় গণভোটে ‘হ্যাঁ’ বিজয়ী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

সোমবার (২৯ ডিসেম্বর) সংগঠনটির পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়।

একইসঙ্গে জুলাই সনদের পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার রাজনৈতিক দলগুলো কতটুকু প্রতিপালন করবে এবং গণভোট বিষয়ে তাদের অবস্থান ইশতেহারে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করারও আহ্বান জানিয়েছেন টিআইবির সদস্যরা।

বিজ্ঞাপন

বার্ষিক সভা শেষে এক ঘোষণাপত্রে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা হয়েছে কিন্তু জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত হয়নি, এমন সব সুপারিশসহ আলোচনার বাইরে থাকা সংস্কার কমিশন বিশেষ করে গণমাধ্যম, নারী, শ্রম, স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকারবিষয়ক কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশমালার বিষয় যেন বিস্মৃত হয়ে না যায়, এ ব্যাপারেও নির্বাচনি ইশতেহারে রাজনৈতিক দলগুলোকে অঙ্গীকার ব্যক্ত করার জোর দাবি জানিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে টিআইবির সঙ্গে সম্পৃক্ত সদস্যরা।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঞ্চালনায় বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার সদস্যের অংশগ্রহণে বার্ষিক সভাটি সংস্থাটির ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। সভাটিতে সদস্যরা সশরীরে ও অনলাইনে অংশগ্রহণ করেন। টিআইবি পরিচালিত গবেষণা, অধিপরামর্শমূলক ও প্রচারণাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম এবং সংশ্লিষ্ট আর্থিক হিসাবের সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন নিরীক্ষা প্রতিবেদন সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য এবং সার্বিক কার্যক্রমের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন তারা।

টিআইবির সদস্যরা মনে করেন, আসন্ন নির্বাচনে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হলো, কর্তৃত্ববাদের বিদায়ের মধ্য দিয়ে জনমনে স্বাধীন ও অসঙ্কোচ মত প্রকাশের যে প্রত্যাশার সঞ্চার হয়েছে ভোটাধিকার প্রয়োগে তা পূরণে কার্যকর পরিবেশ সৃষ্টিতে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সকল রাজনৈতিক দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতকরণ। পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনের জনসংযোগ কার্যক্রম যেন কোনোভাবেই অর্থ ও পেশীশক্তির প্রদর্শনের পুরানো চর্চায় পর্যবসিত না হয় সে লক্ষ্যে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রাখতে হবে। ধর্মান্ধ শ্রেণির উসকানিমূলক আচরণ ও রাজনীতিতে পুঁজি হিসেবে ধর্মের অপব্যবহারের ক্রমবর্ধমান প্রবণতায় তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে ধর্মের অপব্যবহার রোধের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার বা প্রত্যয় তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে তুলে ধরার জোর দাবি জানান।

একইসঙ্গে, কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র দেশ যেভাবে একসঙ্গে লড়েছে, একটি সুশাসিত ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে সেই বন্ধন অটুট রেখে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, নারী-পুরুষসহ সকল জেন্ডার, শারীরিক-মানসিক প্রতিবন্ধকতা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও জাতিগত সম-অধিকার, সম্প্রীতি ও সহঅবস্থান বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার বা প্রত্যয় তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে তুলে ধরার আহ্বান জানান তারা।

দেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্রিসংযোগ, নিউ এইজের সম্পাদক নূরুল কবিরের ওপর হামলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট ভাঙচুরের ঘটনাকে টিআইবির সদস্যরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সুরক্ষা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন এবং এ জাতীয় বর্বরোচিত হামলার তীব্র নিন্দা জানান। এরই মধ্যে সংঘটিত বাউল শিল্পীদের ওপর আক্রমণ, আহমদিয়া সম্প্রদায়, আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণাপূর্ণ বক্তব্য ও সারাদেশে বিভিন্ন মাজারে সংঘটিত হামলার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে, উল্লিখিত ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটাতে উগ্রপন্থীরা সাহস করতো না বলে টিআইবি সদস্যবৃন্দ মনে করেন এবং অনতিবিলম্বে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক চর্চা, প্রতিটি ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা রক্ষায় সংঘটিত প্রতিটি ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতে সরকারের প্রতি তারা জোর দাবি জানান।

ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, ‘বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি’ গঠনের সুপারিশ উপেক্ষা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অধ্যাদেশ, ২০২৫ চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়ার মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত পদক্ষেপের উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অপমৃত্যু ঘটানো হয়েছে। টিআইবির ধারাবাহিক পরামর্শ ও সকল রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের পরও এ সুপারিশ বাদ দেওয়া শুধুমাত্র হতাশাজনক নয়, বরং রাষ্ট্র সংস্কারের অভীষ্টের প্রতি সরকারের অঙ্গীকারের প্রতি গভীর সংকট বিদ্যমান এমন মনে হওয়া অমূলক নয়। একইসঙ্গে, দুদকের অভ্যন্তরে দুর্নীতি প্রতিরোধসহ দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে দুদক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুসরণে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় টিআইবি সদস্যরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

তারা আরও জানান, সম্প্রতি গেজেট আকারে প্রকাশিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সংস্কারবিরোধী চক্রের কাছে সরকারের দৃশ্যমান নতজানু অবস্থানের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। দীর্ঘদিনের জনদাবি, অংশীজনদের ধারাবাহিক অধিপরামর্শ এবং রাষ্ট্রসংস্কারের অভীষ্টের আওতায় স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক পুলিশব্যবস্থা গঠনের অন্যতম অনুঘটক হিসেবে স্বাধীন পুলিশ কমিশন প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে পদদলিত করে পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫-এ মৌলিক ধারণাগত, কৌশলগত ও কাঠামোগতভাবে গুরুতর পরিবর্তন ঘটিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। রক্তক্ষয়ী জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পটভূমিতে সূচিত পুলিশব্যবস্থা সংস্কারের যে অভূতপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, এই অধ্যাদেশ তার সঙ্গে রীতিমতো বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করেন টিআইবির সদস্যরা।

একইভাবে, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫-এ যড়যন্ত্রমূলকভাবে মৌলিক পরিবর্তন ঘটিয়ে কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া আমলাতন্ত্রের করায়ত্ত করা হয়েছে বলে মনে করেন টিআইবি সদস্যরা। সরকারি নিয়ন্ত্রণের কর্তৃত্ববাদী চর্চা অব্যাহত রাখতে অধ্যাদেশ প্রণয়ন-প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের অন্ধকারে রেখে বাছাই কমিটিতে ‘মন্ত্রিপরিষদ’ সচিবকে অন্তর্ভুক্ত করায় সরকারি প্রভাববলয়ের বাইরে থেকে কমিশন গঠনের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করে অবিলম্বে উপরোল্লিখিত অধ্যাদেশগুলো সংশোধনের মাধ্যমে ঢেলে সাজাবার জন্য সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান তারা।

চব্বিশের অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একদিকে যেমন নারীর অবদান মূল্যায়ন করা হয়নি তেমনি সামাজিকভাবেও নারীর প্রতি বৈষম্য ও হয়রানিমূলক আচরণ ও সহিংস ঘটনার বৃদ্ধি ঘটেছে বলে মন্তব্য করে টিআইবি সদস্যরা বলেন, ‘একশ্রেণির উগ্র, নারীবিদ্বেষী গোষ্ঠীর অনলাইন ও জনপরিসরের কর্মকাণ্ড, আচরণ ও মন্তব্যের কারণে পথঘাটে নারী হয়রানি ব্যাপকভাবে বেড়েছে, বাজে মন্তব্য করা, ক্ষেত্রবিশেষে শারীরিক ও যৌন হয়রানির ঘটনাও ঘটছে। একইসঙ্গে শোভন কর্মপরিবেশ, চলাচলে নিরাপত্তাহীনতা ও সহিংসতা নারীদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে, যা খুবই উদ্বেগজনক বলে তারা মনে করেন ও নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্যের অবসান ঘটাতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রতিকূলতা দূরীভূত করতে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনের সক্রিয় ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান টিআইবির সদস্যরা।

ঘোষণাপত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রসংস্কারে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তথ্য কমিশন কার্যকর করা ও তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কারের ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজের অনুরোধ ও সুপারিশ প্রদানের পরও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় গভীর হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন টিআইবি সদস্যরা। অনতিবিলম্বে স্বচ্ছপ্রক্রিয়ায় যোগ্য ও স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্ত ব্যক্তিদের কমিশনার নিয়োগ দিয়ে কমিশনের দীর্ঘদিনের অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে তারা সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান।

বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ চিহ্নিত ও জব্দ করে অবিলম্বে দেশে ফেরত আনতে সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া উদ্যোগ আরও জোরদার করার দাবি জানান টিআইবি সদস্যরা। এ ক্ষেত্রে পাচারকৃত সম্পদের গন্তব্য দেশগুলোর নিজস্ব আইনি প্রক্রিয়া সক্রিয়ভাবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি চুরি যাওয়া সম্পদ দেশে ফেরত আনতে পারস্পরিক আইনি, সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও বিশেষায়িত সহায়তার মতো আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করে অর্থ পাচারকারীদের জবাবদিহির আওতায় আনার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অধিকতর সক্রিয় ভূমিকা পালনের পাশাপাশি চলমান অর্থ পাচার প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান তারা। এ ছাড়া, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নিরপেক্ষ, স্বনামধন্য, স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্ত ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংক কমিশন গঠন, রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকিতে দ্বৈত শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিলুপ্তি, ঋণ জালিয়াতি ও প্রতারণাসহ ঘোষণাপত্রে ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তি, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তা ও পরিচালকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার জোর দাবি জানানো হয়।

মহান ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনাকে ধারণ করে সততা, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা, জবাবদিহি চর্চার মাধ্যমে সকল প্রকার শোষণ ও বৈষম্য অবসানের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে গণতন্ত্র, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে সভা শেষ হয়।

সারাবাংলা/ইউজে/এইচআই
বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর