ঢাকা: আপসের বদলে যিনি সংগ্রামকেই করেছিলেন জীবনের ব্রত। গণতন্ত্রের জন্য যে মহীয়সী নারী নিজের ঘর-সংসার, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, সন্তানের মায়া ত্যাগ করে দেশের ভাগ্যাহত মানুষদের স্বজন ভেবে বাংলাদেশের মাটি আঁকড়ে বেঁচে ছিলেন, আজ তার চলে যাওয়ার দিন। তিনি চলে যাবেন পৃথিবী ছেড়ে, আমাদের ছেড়ে। তবে এটা তার শারীরিক প্রস্থান। তিনি তার মানবিক ও ‘আপসহীন’ নেত্রীর অভিধা নিয়ে থেকে যাবেন মানুষের মন ও মননে।
হ্যাঁ, আজ গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী বেগম খালেদা জিয়ার অনন্তযাত্রার দিন। মহাকাশ থেকে যেন একটি ধ্রুবতারা ঝরে পড়ল। সারাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ শোকে স্তব্ধ ও বাকরুদ্ধ হয়ে আছে। সবার চোখ অশ্রুসিক্ত। দিনমজুর, রিকশাওয়ালা, পথচারী থেকে শুরু করে আপামর জনসাধারণ আপনজন হারানোর বেদনায় মর্মাহত।
দৃঢ়চেতা এই নারীকে আজ বিদায় জানাচ্ছে সমগ্র জাতি। খালেদা জিয়ার মহাপ্রয়াণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ও ৩১ ডিসেম্বর সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছেন। বিএনপিও সাত দিনের শোক কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। কর্মসূচির অংশ হিসেবে গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে শোক বই খোলা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন, জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ এবং বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন। তার মৃত্যুর খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়েছে।
খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে শোক জানাতে এবং শেষকৃত্যে অংশ নিতে ভারত, পাকিস্তান, ভুটান, মালদ্বীপসহ কয়েকটি দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের প্রতিনিধিরা ঢাকায় আসছেন। এ ছাড়া চীন, ভারত, পাকিস্তান, জার্মানি, ইরান, ওমান, আলজেরিয়া, কাতার, ফ্রান্স, নরওয়ে, সুইডেন, ব্রুনাই, ফিলিস্তিন, স্পেন, মরক্কো, ভুটান ও ব্রাজিলসহ বহু দেশের কূটনীতিক এরই মধ্যে শোক বইয়ে সই করেছেন।
খালেদা জিয়াকে বিদায় জানাতে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে লাখো প্রাণের সম্মিলন, নেমেছে শোকার্ত মানুষের ঢল। কালো পোশাক ও ব্যাজ পরে, দলীয় পতাকা হাতে খালেদা জিয়ার জানাজাস্থলে জড়ো হয়েছেন লাখো মানুষ। ৩১ ডিসেম্বর বাদ জোহর আনুমানিক বেলা ২টার দিকে জাতীয় সংসদ ভবনের ভেতরের মাঠ, বাইরের অংশ এবং পুরো মানিক মিয়া অ্যাভিনিউজুড়ে অনুষ্ঠিত হয় জানাজা। জানাজার পর বেলা সাড়ে তিনটার দিকে শহিদ রাষ্ট্রপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের পাশে বেগম খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমহিত করা হবে।
৮০ বছরের বর্ণাঢ্য ও গৌরবময় জীবনের ৪৫ বছরই অতিবাহিত করেছেন রাজনীতিতে। গণতান্ত্রিক বিশ্বে একজন অনন্য রাজনীতিবিদ হিসেবে সবার মন জয় করেছিলেন। সারা জীবন তিনি নিজের ও পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা চিন্তা না করে দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য অকুতোভয় সৈনিকের মতো বিরামহীন কাজ করে গেছেন। তার কঠিন-ইস্পাত অনমনীয় মনোভাব দেশের স্বার্থে কোনো কিছুর বিনিময় না করে আপসহীন থেকে যে কষ্ট ও বেদনা নিজের উপর বহন করেছেন, তা জাতি সব সময় মনে রাখবে। তার উপাখ্যান ইতিহাসের পাতায় অমর ও অক্ষয় হয়ে থাকবে।
গৃহবধূ থেকে দেশের তিনবারের সকল প্রধানমন্ত্রী। দেশের প্রথম এবং পৃথিবীতে দ্বিতীয় মুসলিম নারী প্রধানমন্ত্রী। তার চলাফেরা, আচার-আচরণ, বাচনভঙ্গি এবং সুশাসক জনবান্ধব উদার মন-মানসিকতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞাই ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আদর্শিক বিষয়বস্তু। তিনি ছিলেন গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক ও অসম্ভব ব্যক্তিত্বের অধিকারী, যা তাকে মহীয়সী ও মহীয়ান করে অসীম মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। খালেদা জিয়া ছিলেন দেশ ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সর্বদা আপসহীন। তিনি ছিলেন নিষ্ঠা ও সততার প্রতীক। তিনি যেমন জীবন্ত ইতিহাস, তেমনি মরণেও ইতিহাস হয়ে রইলেন।