Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তিনি ছিলেন মৃত্যুভয়হীন এক মহাপ্রাণ


১৪ আগস্ট ২০১৮ ২১:৩৪

।।মাহমুদ মেনন, নির্বাহী সম্পাদক।।

… পাকিস্তান সামরিক জান্তার কমান্ডো বাহিনী আমার বাড়িটি ঘেরাও করেছিলো। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলো। আমার কাছে তথ্য ছিলো, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে ওরা আমাকে হত্যা করবে এবং প্রচার করে দেবে যে, তারা যখন আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আপোসের আলোচনা করছিলো, তখন বাংলাদেশের চরমপন্থীরাই আমাকে হত্যা করেছে। আমি বাড়ি থেকে বেরুব কী বেরুব না ভাবছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম, পাকিস্তানীরা বর্বর বাহিনী। আমি এও জানতাম, আমি আত্মগোপন করলে ওরা দেশের মানুষগুলোকেই হত্যা করবে। বড় ধরনের হত্যাযজ্ঞ চালাবে। তাই আমি স্থির করলাম, আমি মরি তাও ভালো… তবুও আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক।…

বিজ্ঞাপন

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে তাকে গ্রেফতার করে নেওয়ার সময়টির কথা এভাবেই বর্ণনা করেছিলেন। কথাগুলো তিনি বলেছিলেন প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড প্যারাডাইন ফ্রস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। ফ্রস্টকে বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন- যে মানুষ মরতে রাজি থাকে তাকে কেউ মারতে পারে না। আর আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারবেন। কিন্তু সে তো তার দেহ। তার আত্মাকে আপনি হত্যা করতে পারবেন না? কেউ তা পারে না। এটাই আমার বিশ্বাস।

মৃত্যুর জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ২৫ মার্চের সেই রাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটিতে কী ঘটেছিল তার বর্ণনায় বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর হাজী মোহাম্মদ গোলাম মোরশেদ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন এভাবে। সেরাতে অনেকেই এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। তিনিও ছিলেন। সর্বশেষ গিয়েছিলেন তৈয়বুর রহমান (ছাত্রলীগ নেতা, পরবর্তীকালে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরিচালক)। তিনি বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ”মুজিব ভাই পালান, ওরা আপনাকে মেরে ফেলবে।” বঙ্গবন্ধু ইংরেজিতে বললেন—If they do not get me they will massacre all my people and destroy the city.

বিজ্ঞাপন

এমনই মৃত্যুভয়কে জয় করা এক মহাপ্রাণ ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই গ্রেফতারের আগেই তিনি ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করে যান। নিজের মৃত্যু নিশ্চিত মেনে নিয়ে সেদিন তিনি আরও বলেন- ”এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উত্খাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক। ”

কেবলই কী গ্রেফতারের সময়! গ্রেফতারের পরেও তিনি জানতেন করাচীর কারাগারে তাকে হত্যারই সব চেষ্টা চলছে। ১৯৭১’র ১৯ জুলাই সে কথা স্পষ্টই করেছিলেন সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান। লন্ডনের ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে তার দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন খুব শিগগিরই শেখ মুজিবের বিচার শুরু হবে। বিচার হবে মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে আর তার চার্জশিটে মৃত্যুদণ্ডের ধারাও থাকবে। সর্বোচ্চ শাস্তি ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু। সেদিনগুলোতেও বঙ্গবন্ধুর বুঝতে সমস্যা হয়নি- বিচারের নামে প্রহসন চলছে। সাজানো মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু তিনি ছিলেন নির্বিকার। মৃত্যুকে বঙ্গবন্ধু ভয় পাননি কোনো কালেই। সদা মনে করতেন ফাঁসির মঞ্চেই হবে তার জীবন নাটকের শেষ দৃশ্যের চিত্রায়ন। আর তাই মাঝে মধ্যেই বলতেন- ‘ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও আমি বলব, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা, জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা।’

অন্যত্র বলেছিলেন- ‘আমার দেশবাসীর কল্যাণের কাছে আমার মতো নগণ্য ব্যক্তির জীবনের মূল্যই -বা কতটুকু? মজলুম দেশবাসীর বাঁচার জন্য সংগ্রাম করার মতো মহান কাজ আর কিছু আছে বলিয়া মনে করি না।’

‘দেশ থেকে সর্বপ্রকার অন্যায়, অবিচার ও শোষণ উচ্ছেদ করার জন্য দরকার হলে আমি আমার জীবন উৎসর্গ করব,’ এমন মন্তব্যও উচ্চারিত হয়েছে তার কণ্ঠে। পাশাপাশি এও বলেছেন, ‘যারা এই অত্যাচার করে তারা কিন্তু নিজ স্বার্থ বা গোষ্ঠীর স্বার্থের জন্যই করে থাকে। সকলেই তো জানে একদিন মরতে হবে। তবুও মানুষ অন্ধ হয়ে যায় স্বার্থের জন্য। হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। পরের ছেলেকে যখন হত্যা করে, নিজের ছেলের কথাটি মনে পড়ে না। মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়।’

নিজের মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করেই কেবল নয়, এমন এক জাতি তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যারা অকুতোভয়। দেশের জন্য যারা প্রাণ দিতে প্রস্তুত। আর সে প্রমাণ যখন পেয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না…।’ তিনি জানতেন এই জাতি নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে কতটা প্রস্তুত। তাইতো তার মুখে উচ্চারিত হয়- ‘মানুষকে ভালোবাসলে মানুষও ভালোবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্য জীবন দিতেও পারে। ’

দেশ স্বাধীনের পর যখন সবার প্রাণের বাংলাদেশ হলো তখনও মৃত্যুর জন্যই প্রস্তুত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেছিলেন, ‘এখন যদি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়, তাহলে সে স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্যে মুজিব সর্ব প্রথম তার প্রাণ দেবে।’

তবে বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েই তিনি মরতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমি যদি বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে না পারি, আমি যদি দেখি বাংলার মানুষ দুঃখী, আর যদি দেখি বাংলার মানুষ পেট ভরে খায় নাই, তাহলে আমি শান্তিতে মরতে পারব না। জীবন ও জন্মকে তুচ্ছজ্ঞান করতেন তিনি। মানুষকে শোষণ ও অত্যাচার মুক্ত করাই ছিলো তার ব্রত। বলেছিলেন- ‘জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এই কথা মনে রাখতে হবে। আমি বা আপনারা সবাই মৃত্যুর পর সামান্য কয়েক গজ কাপড় ছাড়ালে সাথে আর কিছুই নিয়ে যাব না। কেন আপনারা মানুষকে শোষণ করবেন, মানুষের ওপর অত্যাচার করবেন?’

নিজের জন্মদিনটিও পালন করতে চাইতেন না। জন্ম কিংবা মৃত্যু কোনওটাই তার কাছে গুরুত্ব পায়নি। পেয়েছে তার দেশ, তার জনগণ। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘আমি আমার জন্মদিনের উৎসব পালন করি না। এই দু:খিনী বাংলায় আমার জন্মদিনই-বা কি আর মৃত্যুদিনই-বা কি?’

আর সেভাবে চলতে চলতে একদিন তার দুয়ারে এসে হানা দিলো সেই মৃত্যু। এবারও তার মৃত্যুভয় ছিলো না সামান্য। বরং দেশের প্রতিটি সন্তানের ওপর ছিলো অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘ওরা আমারই সন্তান। আমাকে কেন হত্যা করবে?’

যে মানুষটি জীবনের নানা পর্যায়ে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে দেশের মানুষের কথাই ভেবে গেছেন, দেশের মানুষের ওপরই রেখে গেছেন তার সকল আস্থা দেশকে যিনি ভুলেননি কোনও দিন- সেই স্বদেশভূমিতেই সেই বত্রিশ নব্বরেই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট তার বুকের রক্ত প্রবাহিত হলো ঘাতকের বুলেটে। খাঁচা ছেড়ে পালালো এক মৃত্যুহীন প্রাণ। কিন্তু মৃত্যু কী তার হলো? হবেই কী কোনও কালে?

সত্যিইতো তাকে কেউ মারতে পারেনি। মৃত্যুভয়কে জয়করা এক মহাপ্রাণ টিকে রয়েছে আজও সবার স্মৃতিতে অমলিন হয়ে। কিন্তু এই মৃত্যু বাঙালিকে যেমন কাঁদিয়েছে, তেমনি কাঁদিয়েছে বিশ্ববাসীকেও।

কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো তাই বলেছিলেন, শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।

ফিলিস্তিনের নেতা ইয়াসির আরাফাত বলেছিলেন- আপোষহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।

ইন্দিরা গান্ধী লিখেছিলেন- তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তার অনন্যসাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।

জাম্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কেনেথ কাউন্ডা বলেছিলেন- শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বিশ্বের তাবত জনগণের অনুপ্রেরণা। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পথে প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর।

জার্মান সংবাদপত্র লিখেছিলো- শেখ মুজিব তার দেশের জনগণের কাছে এতটাই প্রিয় ছিলেন যে, রাজ চতুর্দশ লুইয়ের মতো তিনিও দাবি করতে পারতেন, আমিই রাষ্ট্র।

শেখ মুজিবুরের মত তেজী, গতিশীল নেতা আগামি দুই দশকে এশিয়া মহাদেশে আর পাওয়া যাবে না এমন কথা বলেছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার।

তবে সেদিন এই বাঙালি জাতিকে ধিক্কার দিতেও ছাড়েনি বিশ্ব। যে জাতির জন্য একটি স্বাধীন দেশ এনে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, তারই কোনো কোনো সন্তান তাকেই হত্যা করেছে, সেটা মেনে নিতে পারেননি অনেকেই। নোবেল বিজয়ী জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্টের মুখে সেদিন উচ্চারিত হয় ধিক্কার। তিনি সেদিন বলেছিলেন, মুজিব হত্যার পর বাঙালীদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যারা মুজিবকে হত্যা করেছে তারা যে কোন জঘন্য কাজ করতে পারে।

১৫ আগস্ট ১৯৭৫’র সেই রাতেই বিবিসির খবরে বলা হয়- শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পাকিস্তানিরাও সংকোচবোধ করেছে, অথচ তিনি নিজের সেনাবাহিনীর হাতেই নিহত হলেন।

ঘাতকেরা জানতো না, শেখ মুজিবুর রহমানদের মৃত্যু হয় না, হয়নি কোনও কালে। তারা এও জানতো না, বুলেট শুধু প্রাণটাই কেড়ে নিতে পারে। একজন মৃত্যুভয়হীন মানুষকে কখনোই মেরে ফেলা যায় না। যে মানুষ মরতে রাজি থাকে তাকে কেউ মারতে পারে না।

তাইতো অন্নদা শংকর রায়ের কলমে রচিত হয়েছে সেই অমোঘ বাণী- ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।

সারাবাংলা/এমএম

আওয়ামী লীগ জাতির জনক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু মৃত্যুভয় হত্যাকাণ্ড

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর