Sunday 20 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সুবর্ণচরে ধর্ষণের বাড়ি, নির্যাতিতার ভাঙা হাত ও আসামির চেয়ার


১৩ জানুয়ারি ২০১৯ ১৫:২২

।।জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।

নোয়াখালী থেকে ফিরে: নোয়াখালী সদর পার হয়ে অটোতে ঘণ্টাখানেকের পথ সুবর্ণচর। সেখান পাঁচ নম্বর চরজুবলী ইউনিয়নের পাঙ্খারবাজার হয়ে চার নম্বর ওয়ার্ড মধ্যম বাগ্গা গ্রাম। একেবারেই প্রত্যন্ত গ্রাম। সে গ্রামের অপ্রশস্ত রাস্তা থেকে নেমে গেছে আরেকটি সরু পথ। পায়েহাঁটা সে পথ ধরে এগিয়ে গেলে এক ঘরের একটি বাড়ি। সামনে পচা, নীলাভ সবুজ পানির পুকুর। টিনের একচালা তৈরি ঘরটির বেড়ার টিনে সবুজ রঙ। ঘরের মেঝে মাটির। ঘরের সামনের বারান্দায় একপাশে কয়েকটি সুপারির ছড়া। আরেক পাশে একটি বড় চৌকি। সেটি ঘেঁষে বসানো একটি নড়বড়ে টেবিল। তাতে কিছু বই-খাতা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।

বিজ্ঞাপন

এ বাড়ির ছেলে-মেয়েরা এখনো ফেরেনি পড়ার টেবিলে। যে বাড়ির মা ধর্ষণের শিকার হন, সে বাড়িতে কোনো কিছুই খুব সহজে স্বাভাবিক হয় না। বাগ্গা গ্রামের এই বাড়িটিতেও হয়নি।

ঘরের বাম দিকে লাগোয়া কবুতরের খোপে নেই কোনো কবুতর। ‘শান্তির পায়রা’রা উড়ে গেছে। পুরো বাড়িটিতেই এখন নেই কোনো শান্তির ছাপ। তবে সহিংসতার সব চিহ্নই বহাল।

ঘরের চারপাশে টিনের বেড়ায় ধারালো অস্ত্রে বড় বড় কোপের দাগ। দিনের আলোতেও ভেতর ঘরটি অপেক্ষাকৃত অন্ধকার। একটি বাল্ব ছিল, সেটি ভাঙা। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া রান্নাঘরের দিকে তাকিয়েই বোঝা গেলো, চুলো জ্বলেনি বেশ কয়েকদিন। দেখলে মনে হবে কোনো এক পরিত্যক্ত বাড়ি। শীতের হীম বিকেলে চারিদিকটা স্তব্ধ।

অথচ চার সন্তান, স্বামী-স্ত্রী মিলিয়ে ছয়জনের সংসার এটি।

বাইরে থেকে ডাক দিতেই প্রাণহীন বাড়িতে প্রাণের অস্তিত্ব জানান দিয়ে বের হয়ে আসে ১৪ বছরের একটি মেয়ে আর সাত-আট বছরের একটি ছেলে।
চোখে মুখে আতঙ্ক, হতবিহ্বল তাকানো। পরিচয় দিয়ে কথা হয় মেয়েটির সঙ্গে। মেয়েটি মাথায় ওড়না টানে আর চারপাশে তাকায়। কথা বলে খুব নিচু স্বরে।

বিজ্ঞাপন

জানালো, ৩০ ডিসেম্বর ঘটনার রাত থেকেই তারা কেউ আর এ বাড়িতে থাকে না। ছোট দুই ভাই-বোনকে নিয়ে বাবা রয়েছেন হাসপাতালে, তাদের মায়ের কাছে। পাশের বাড়িতে ঠাঁই হয়েছে দুই ভাই-বোনের। সেখান থেকে মাঝে-মধ্যে নিজেদের ঘরে আসে। আবার চলে যায়।

মেয়েটি জানালো, সে হাসপাতালেও যায়। ওই দিনও গিয়েছিল। কিছুক্ষণ আগে বাড়ি ফিরেছে।

কথা বলতে বলতে মেয়েটির চোখে পানি জমে, ওড়না টেনে চোখ মোছে। মেয়েটি এ প্রতিবেদককে সে রাতে তাদের বাড়িতে ঘটে যাওয়া অবর্ণনীয় এক নির্যাতনের কথা জানায়।

কথা বলতে বলতে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ভাইয়ের হাতটি চেপে ধরে রাখে। যেন ওই কচি হাতেও সাহস ও শক্তি খোঁজে।

কিশোরী মেয়েটি জানায় কী এক ভয়ঙ্কর রাত গিয়েছে তাদের!

হামলাকারীরা প্রথমে ঘরের চারিদিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাতে থাকে। পরে ঘরে ঢুকে বাবা-মাকে লাঠি দিয়ে পেটায়। এরপর তাদের হাত-পা বেঁধে ফেলে। মাকে ঘর থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে পুকুর পাড়ের দিকে নিয়ে যায়।

চৌদ্দ বছরের মেয়েটি সব বুঝতে পারে,  কী এক হিংস্রতার শিকার হয়েছে তার মা।

৩০ ডিসেম্বর ছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রকাশিত খবর মতে,  ধানের শীষে ভোট দেওয়ার কারণে সেই রাতে স্বামী-সন্তানদের বেঁধে রেখে সুবর্ণচরের ৪০ বছরের এক নারীকে দলবেঁধে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। পরদিন তার স্বামী নয় জনের নাম উল্লেখ করে চরজব্বর থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় এ পর্যন্ত হুকুমদাতা রুহুল আমিন, এজাহারভুক্ত ছয়জন এবং তদন্ত ও ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে নাম আসা পাঁচজনসহ মোট ১২ জন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরমধ্যে সাতজন আসামি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে এখনও পলাতক রয়েছে ২ নম্বর আসামি হানিফ, ৪ নম্বর আসামি চৌধুরী ও ৮ নম্বর আসামি মোশারফ। গণধর্ষণের শিকার নারীটি এখন নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ইতোমধ্যেই ডাক্তারি পরীক্ষায় গণধর্ষণের আলামত মিলেছে।

ধর্ষণের শিকার ওই নারীর বাড়ি পৌঁছানোর পথে পাঙ্খারবাজারে কথা হয় স্থানীয়দের সঙ্গে। অপরাধীরা যতই ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী হোক না কেন, তারা এর বিচার চান।

এলাকার হারিছ চৌধুরীর বাজারে (আট কাপালিয়া বাজার) কথা হয় ৭০ বছরের আবুল কালামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আগে এই এলাকা পুরোটাই ছিল দস্যুদের কবলে। ধীরে ধীরে দস্যুমুক্ত হলে এখানে আশেপাশের বিভিন্ন এলাকার মানুষেরা এসে বসবাস শুরু করে, বাড়ি করে, থাকতে শুরু করে। নির্যাতিতা নারী ও তার পরিবারটিও তেমনই একটি। তবে চার সন্তানের এই মা ওই অঞ্চলে অনেকের কাছে আগে থেকেই ছিলেন পরিচিত।’

এখানে বসতি স্থাপনকারী ভূমিহীনদের সঙ্গে এলাকাবাসীর একটি বিরোধ আগে থেকেই ছিল জানিয়ে  আবুল কালাম  বলেন, ‘ভূমিহীন এসব মানুষদের পক্ষে কথা বলে অনেক আগে থেকে নির্যাতিত নারী স্থানীয় অনেকের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছেন। এলাকায় তিনি প্রতিবাদী নারী হিসেবে অনেকের কাছেই যেমন জনপ্রিয়, তেমনি অনেকের কাছে শত্রুসমও।’ তিনি আরও বলেন, ‘কেবল তা-ই নয়, সবশেষ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে রুহুল আমীনের প্রতিপক্ষ ইব্রাহীম খলিলের হয়ে কাজ করেছেন এই নারী, যে নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন রুহুল আমীন। সেখান থেকেও রুহুল আমীনের সঙ্গে নির্যাতনের শিকার এই নারীর রয়েছে একধরনের বিরোধপূর্ণ  সর্ম্পক।’  এসব কারণে, কেবল নির্বাচনে ভোট দেওয়াই নয়, পূর্ব শত্রুতার জেরেও গত ৩০ ডিসেম্বর রাতের নৃশংসতা ঘটতে পারে বলে মনে করেন স্থানীয় এই বয়োঃবৃদ্ধ।

তার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছেন স্থানীয় আরও অনেকে। তারা বলছেন, পূর্বশত্রুতার সঙ্গে যোগ হয়েছে ধানের শীষে ভোট দেওয়ার ঘটনাও। আর তাতেই এত নৃশংসতার শিকার ওই নারী।

মামলার প্রধান আসামি রুহুল আমিন যে নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, তা বলেছেন এলাকার অনেকেই। তারা বলেন, মূলত রুহুল আমিনের উত্থানের পর থেকেই সুবর্ণচরের এই অংশে নানা ধরনের রাজনৈতিক সংঘাত, সহিংসতা শুরু হয়। তার আগে এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান সমস্যা ছিল জলদস্যুতা। যা এখন নেই বললেই চলে।

হারিছ চৌধুরীর বাজারেই কথা হয় ২৮ বছরের খলিলুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রুহুল আমীনের রাজনৈতিক পরিচয়ের আগে এই এলাকায় কখনোই কোনো নির্বাচনে কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। রুহুল আমীন এলাকায় এর আগেও বিভিন্ন অপকর্ম করেছেন, যার সাক্ষী পুরো এলাকাবাসী।’

রুহুল আমীন বাহিনী নামে একটি বাহিনীও রয়েছে যারা বাজারে বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়, জানান একাধিক এলাকাবাসী।

নৃশংসতার শিকার ওই নারীর প্রতিবাদী মনোভাবের কারণে আগে থেকেই রুহুল আমিনের সঙ্গে নানা বিষয়ে বিরোধ তৈরি হয়। এখন ভোটকে ‘উছিলা’ দেখিয়ে পূর্বশত্রুতার ‘প্রতিশোধ’ নেওয়া হয়েছে বলেই মনে করেন অধিকাংশ এলাকাবাসী।

ধর্ষণের শিকার নারীর বাড়ি থেকে পায়ে হেটে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে রুহুল আমীনের বাড়ি। সে বাড়ির সামনে গেলে দেখা যায়, যে চেয়ারে বসে রুহুল আমিন তার দাপট দেখিয়ে আসছেন, সেটি খালি পড়ে আছে। তবে তার অনুসারীদের অনেকেরই দেখা মিললো সেখানে। এক পর্যায়ে এই প্রতিবেদককে ঘিরে ধরেন তার অনুসারীরা। তাদের ভাষায়, এলাকার যত উন্নয়ন হয়েছে, সবই হয়েছে রুহুল আমীনের হাত ধরে। কোনোভাবেই এ ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িত নন।

রুহুল আমীনের সমর্থকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মিডিয়া এই ঘটনাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি না করলে রুহুল আমীন গ্রেফতার হতেন না, মিডিয়ার চাপেই প্রশাসন তাকে গ্রেফতার করেছে। আর তাই মিডিয়ার প্রতি আর কোনো আস্থা নেই, বিশ্বাস নেই। সাংবাদিকরা তাদের শত্রু বলেও মন্তব্য করেন রুহুল আমিনের অনুসারীরা।

পরে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতারের নির্দিষ্ট কেবিনে কথা হয় নির্যাতিত নারী, তার মা ও স্বামীর সঙ্গে। তার ডান হাতে ব্যান্ডেজ, বাম হাতে স্যালাইন চলছে।

এখনো ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। কথা বলার সময় একটু পরপর ডুকরে কেঁদে উঠছিলেন। জানালেন, তার পুরো শরীরে এখনো পেটানোর দাগ, বেঁধে রাখার দাগ।

এ ঘটনায় মামলার বাদি ওই নারীর স্বামী সারাবাংলাকে জানান, এলাকার কারও সঙ্গে তার কোনো শত্রুতা নেই, অটো চালিয়ে সংসার চালান। ছোট একটি টিনের ঘরে থেকে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমি কাউকে সমর্থ ( সমর্থন) করি না, দল করি না। কিন্তু আমার ঘরেই এ কী ঘটে গেলো!’

এসময় পাশের বেডে শুয়ে থাকা নির্যাতিত নারী আবার কেঁদে ওঠেন। কেঁদে ওঠেন মেয়ের মাথার পাশে বসে থাকা মাও। তিনি বলতে থাকেন, ‘এত বড় ডাকাতি, এত বড় ডাকাতি, আল্লায় সইবো না।’

ভুক্তভোগী এই পুরো পরিবারের অভিযোগ এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাই চরজুবলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য রুহুল আমিনের লোক। কিন্তু মামলার এজাহারে প্রথম রুহুল আমীনের নাম ছিল না। সেটা জানিয়ে কারণ জানতে চাইলে ভুক্তভোগীর স্বামী বলেন, ‘আমি মুখখো (মূর্খ) মানুষ, পুলিশ কী লেখছে, কী লেখে নাই, সেইটা তো আর আমি কইতে পারুম না। কিন্তু আমি একবার না, একশোবার রুহুল আমিনের নাম বলছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমারে জিগাইছে, এক নম্বর আসামি কে? আমি কইছি, হুকুমদাতা রুহুল আমিন, তারা রুহুল আমিনের কাজ করে।’

হুকুমদাতা রুহুল আমিন সেটা কী করে বুঝলেন? জানতে চাইলে ভুক্তভোগীর স্বামী বলেন, ‘হেতে (সে) সবারে মারধোর করে, লুট করে, ঘর বাড়িতে আগুন জ্বালায়- চোখে দেখছি। হের লাইগাই হের কতাতে তার মানুষে আমার এই সর্বনাশ করছে’।’

ভোট কেন্দ্রে সেদিন কী হয়েছিল? জানতে চাইলে ধর্ষণের শিকার নারী সারাবাংলাকে বলেন, ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোটারের স্লিপ চাইলে প্রথমে স্লিপ নেই বলে  জানানো হয়। তখন তিনি স্লিপ নেওয়ার জন্য কথা কাটাকাটি হয়। এসময় তার কাছে কোনো মার্কায় ভোট দেবেন বলেও জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘আমি কইছি-আমার যারে মনে চায়, তারে দিমু। আমার ভোট আমি ধানে দিমু, পরে ধানে ভোট দিয়া চইলা আইছি।’  তিনি আরও জানান, সে সময় বেচু (মামলার অন্য আসামি) তাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন।

নির্যাতিত নারী বলেন,  ‘হে কয়, আচ্ছা, ভোট দিছেন, যান-খবর হইবো রাইতে।’

এরপর রাত ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার দিকে হামলা ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।

কারা হামলা করেছে? এমন  প্রশ্নের জবাবে এই নারী বলেন, ‘সোহেল, বেচু, চোধরী ( চৌধুরী), মোশারফ, হেঞ্জু, স্বপন, জসিম। এই আসামিগুলোরে আমি চিনি।’ আসামিদের চিনলেন কী করে? জানতে চাইলে বলেন, ‘ওরা যেইখানের আমিও সেইখানের। ছোট থেইক্যা এদের বড় হইতে দেখছি। ‘ওরা রুহুল আমীনের ওয়াডার ছাড়া কিচ্ছু করে না, এই বাহিনী রুহুল আমীন মেম্বরের।’

তিনি কোনো রাজনীতি করেন না, দাবি করে নির্যাতিতা নারী বলেন, ‘আমিতো কারও ক্ষতি করি নাই। আমি অনেক কষ্টে সংসার চালাই। মাঠে কাম করি।আমার এই দুঃখের সংসারে আরও দুঃখ। আমি কেবল বিচার চাই, আমি ওদের ফাঁসি চাই। আর কিছু চাই না।’

‘আমি আল্লার কাছে বিচার চাই, এমুন অইত্যাচার করে-আল্লা তোমার কাছে বিচার চাই। আল্লা তুই কেমনে এইডা সহ্য করছো?,’ বলে আর্তনাদ করতে থাকেন পাশেই বসে থাকা নির্যাতিতার বৃদ্ধা মা।

সারাবাংলা/জেএ/এমএম/এমএনএইচ

ধর্ষণ নির্বাচন নোয়াখালী ভোট সুবর্ণচর

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর