Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

৪২ মিনিট পায়চারি, ২০ মিনিট টয়লেটে, ৩৫ সেকেন্ডে সিকিউরিটি পার


২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৯:২৮

।।বিশেষ সংবাদদাতা।।

ঢাকা: বিমান ছিনতাইয়ের নাটক সাজিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রাণটাই গেছে পলাশ আহমেদ ওরফে মাহিবি জাহান পলাশের। কিন্তু সে নাটক সাজাতে কেমন ছিল তার প্রস্তুতি। সে চিত্র ফুটে উঠেছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের সিসি ক্যামেরা ফুটেজে।

তাতে দেখা গেছে, বিমান উড্ডয়নের প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা আগে তিনি পৌঁছে যান বিমান বন্দর এলাকায়। সেখানে পৌঁছেই তিনি বিমানবন্দরে ঢুকে পড়েননি। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ধরে পায়চারি করেছেন টার্মিনালের বাইরের এলাকায়। পার্কিং এরিয়া, প্রবেশ পথ, বহির্গমন জোনের বাইরে তাকে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। পরে বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকেও পলাশকে দেখা যায় ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে।

এক পর্যায়ে তিনি ঢুকে পড়েন টয়লেট জোনে। সেখানে প্রায় ২০ মিনিট ছিলেন ক্যামেরার আওতার বাইরে। আবার ক্যামেরার আওতায় দেখা যায় পলাশ আহমেদকে। সিকিউরিটি চেকিং পার করে সহজেই ঢুকেও পড়লেন ফ্লাইটে ওঠার জন্য।

পরে এই পলাশ আহমেদ উড়োজাহাজে চেপে বসেন। উড্ডয়নের পরপরই তাতে ছিনতাই নাটক করেন। জরুরি অবতরণ করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ। যাত্রীদের নামানো হয়। এরই মধ্যে নানা গল্পের শেষ পর্যন্ত কমান্ডো অপারেশনে মারাও পড়েন। কিন্তু তার কাছ থেকে উদ্ধার হয় খেলনা পিস্তল। আত্মঘাতী হামলার নকল ভেস্ট।

পলাশের কাছ থেকে উদ্ধার হয় খেলনা পিস্তল ও নকল সুইসাইড ভেস্ট

এরই মধ্যে তার কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া পিস্তলটিকে খেলনা পিস্তল বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ। আর শরীরে বাঁধা বোমার মতো দেখতে বস্তুটিতেও কোনো বিস্ফোরক ছিল না বলে জানিয়েছে র‌্যাব। তবে লাল টেপ মোড়ানো কিছু পাইপের সঙ্গে সার্কিট তার, এমনকি টাইম বোমার মতো ঘড়িও সংযুক্ত ছিল।

বিজ্ঞাপন

এতকিছু পলাশ কেন করলেন? সে প্রশ্নের উত্তর মিলতে দেরি হবে। কিংবা হয়তো মিলবেই না, কিন্তু কিভাবে করলেন, সে প্রশ্নেরও উত্তরে রয়ে যাচ্ছে অনেক ধোঁয়াশা।

পিয় পাঠক, আসুন আমরা পুরো ঘটনাটি দেখে নেই সিসি ক্যামেরার লেন্সে চোখ ফেলে।

বেলা ১টা ৫৪ মিনিট

একটি মোটরসাইকেলের পেছনে চেপে মাহিবি জাহান ওরফে পলাশ আহমেদ ঢোকেন বিমানবন্দর এলাকায়। তার পরনে কালো ন্যারো কাট প্যান্ট বা ট্রাউজার। গায়ে কালো রঙের রাউন্ড নেক টি-শার্টের ওপর অ্যাশ-সাদায় মিশেল একটি ঢিলেঢালা জ্যাকেট (ট্র্যাকস্যুটের ওপরের পার্ট)। জ্যাকেটের চেইন গলার কাছাকাছি পর্যন্ত লাগানো। পীঠে কালো রঙের চারকোনা আকারের একটি ব্যাকপ্যাক।

মোটরসাইকেল থেকে নেমে সরাসরি এয়ারপোর্টে ঢুকলেন না পলাশ। এরপর টানা ৪২ মিনিট তাকে বিমানবন্দরের বাইরের চত্বরে পায়চারি করতে দেখা যাচ্ছিলে। কখনো বন্দরের সামনের অংশে, কখনো পার্কিং এরিয়ায় ঘোরাঘুরি করছিলেন তিনি।

বেলা ২ টা ৩৮ মিনিট

টার্মিনালে ঢোকার মুখে একবার পেছনে ফিরে তাকালেন। সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ে গেটের মুখে দাঁড়িয়ে পলাশ। তার আশে-পাশে আরও অন্তত পাঁচজনকে দেখা গেলো। তবে তাদের কেউ তার সঙ্গের বলে মনে হলো না। বাইরের দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে কিছু একটা দেখছিলেন পলাশ।

শাহজালাল বিমানবন্দর টার্মিনালে ঢোকার আগে পলাশ

এরপর টার্মিনালের ভেতরে ঢুকে পড়েন। সেখানে ওয়েটিং জোনে তাকে কখনো পায়চারি করতে আবার কখনো বসে থাকতে দেখা যাচ্ছিল।

এক পর্যায়ে ওয়েটিং এরিয়া থেকে টয়লেট জোনে ঢুকে পড়লেন পলাশ আহমেদ। ওই এলাকা সিসি ক্যামেরা জোনের বাইরে। এরপর সিসি ক্যামেরার ফুটেজের আওতায় তাকে ফের দেখা গেল ২০ মিনিট পরে। তিনি সরাসরি সিকিউরিটি চেকিং জোনের দিকে এগিয়ে গেলেন। তার পরনে একই পোশাক তবে জ্যাকেটের চেইন এবার খোলা। আর ব্যাকপ্যাকটি এবার হাতে ঝোলানো।

বিজ্ঞাপন

এতটা সময় টয়লেট জোনে কী করছিলেন পলাশ? সে প্রশ্নের উত্তর জানা সময়সাপেক্ষ। কিন্তু সিসি ক্যামেরার ফুটেজে রয়েছে তার আর্চওয়ে দিয়ে বোর্ডিং জোনে ঢুকে পড়ার দৃশ্য। আসুন দেখা যাক কী হলো সেই সময়টিতে।

সেই ৩৫ সেকেন্ড

এখানে প্রায় ৩৫ সেকেন্ড সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায় পলাশকে। প্রথমে দেখা গেলো তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীটি সিকিউরিটি চেকিংয়ের জন্য নিজের মালামাল একটি নীল রঙের ট্রেতে দিয়ে এগিয়ে গেলেও পলাশ তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ওই যাত্রীটি পলাশকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে গেলে তখন পলাশের সামনে আর কেউ ছিল না। এরপরও প্রায় ৪/৫ সেকেন্ড পলাশকে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো। তার সামনে সিকিউরিটি চেকিং টেবিলের ওপর দুটি নীল রঙের ট্রে পড়ে থাকলেও সেদিকে নয়, তার দৃষ্টি সিকিউরিটি চেকিংয়ের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের দিকে। বিশেষ করে স্ক্যানিং মেশিনের পেছনে যেখানে মনিটর বসানো সেখানটাতে।

এবার টেলিলের দিকে এগিয়ে গেলেন পলাশ। চৌকা ছোট আকারের ব্যাগটি বাম হাতে তুলে টেবিলের ওপর যেভাবে রাখলেন, তাতে সেটা ভারী হবে বলে মনে হলো না। ব্যাগ রেখেই একটি ট্রেও টেনে নিলেন নিজের দিকে। সেটির ভেতর কিছু একটা রাখলেন (মোবাইল ফোন হতে পারে)। এসব করছেন তবে তার নড়াচড়ায় তাড়ার ভাব নেই।

কিউতে পরের যাত্রীটি (বোরখা পরিহিত নারী) একটি কালো রঙের ব্রিফকেস হাতে নিয়ে একবার পলাশের ব্যাগ ও ট্রের পেছনে রাখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার ধীর গতি দেখে তাকে টপকে এগিয়ে গেলেন ওই নারী। হাতের ব্রিফকেসটি পলাশের ব্যাগের সামনে নিয়ে রাখলেন। সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিটি টেবিলের অন্যপ্রান্তের দিকে দাঁড়িয়ে। তিনি ওই নারীর রাখা ব্রিফকেসটি যখন স্ক্যানিং মেশিনের ভেতরের দিকে ঢেলে দিচ্ছিলেন, তখন হঠাৎই তাড়াহুড়ো করতে দেখা গেলো পলাশকেও। তিনি তার নিজের ব্যাগ ও ট্রেটি সামনে ঠেলে দিলেন। কিন্তু নারী যাত্রীটি তার কাছে থাকা একটি ব্যাকপ্যাকও রাখলেন পলাশের ব্যাগের সামনে। সিকিউরিটি চেকিংয়ের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিটি এবার প্রথমে নারীটির ব্রিফকেস, এরপর তার ব্যাকপ্যাক, পরে পলাশের ব্যাগ ও সবার পরে তার ট্রেটি সাজিয়ে একসঙ্গে স্ক্যানিং মেশিনের দিকে ঢেলে দিলেন।

এদিকে, ওই নারী যাত্রী, যিনি পলাশের আগে ব্যাগ জমা দিলেন তিনি আর্চওয়ের দিকে না গিয়ে পেছনে সরে আসলেন। ধারণা করা যাচ্ছে, পলাশের পেছনে তখন যিনি ব্যাগ স্ক্যানিংয়ে দেওয়ার অপেক্ষায়, তিনি ওই নারীর সহযাত্রী। তিনি পিছিয়ে একবার ওই যাত্রীটির কাছে এসে ফের আর্চওয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন কিন্তু বডি স্ক্যানিংয়ে গেলেন না। সেখানে পাশে দাঁড়িয়ে সহযাত্রীর জন্য অপেক্ষা করলেন। তখন পলাশ তাকে পাশ কাটিয়ে দ্রুতই আর্চওয়ের ভেতর গিয়ে দুই হাত দুই দিকে তুলে দাঁড়ালেন। চেকিংয়ের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিটি তার ঠিক পীঠে হ্যান্ড স্ক্যানার বুলিয়ে ছেড়ে দিলেন। এভাবে দুই সেকেন্ডে তল্লাশি শেষ করে পলাশ গিয়ে দাঁড়ালেন তার স্ক্যানড হয়ে যাওয়া ব্যাগের অপেক্ষায়।

পলাশ যখন আর্চওয়ে পার হচ্ছিলেন ঠিক তখনই অন্যদিকে থেকেও একজন যাত্রী আর্চওয়ে পার করছিলেন। সেদিকটায় নজর দিলে দেখা যাবে, সেখানে চেকিংয়ের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিটি প্রথমে তার দুই হাত, পরে পুরো শরীরে হাত বুলিয়ে দেখে, সম্পূর্ণ সতর্কতায় পার করছেন। আর এদিকে পলাশ পার হয়ে গেলেন মাত্র দুই সেকেন্ডে।

প্রিয় পাঠক, এ তো ছিল পলাশ তখন কী করছিলেন বা তার ক্ষেত্রে কী ঘটেছিল, তার বর্ণনা। চলুন বোর্ডিং জোনে যাওয়ার জন্য এই সিকিউরিটি চেকিংয়ের পুরো চিত্রটি তখন কেমন ছিল, তা দেখে নেওয়া যাক।

পলাশ যখন সিকিউরিটি চেকিং জোনে পৌঁছান তখন জোনের দুই দিকে দুটি আর্চওয়ে দিয়েই যাত্রীরা ভেতরে ঢুকছিলেন। পলাশ ঢুকছিলেন বাম দিকের পথটি দিয়ে। এই অংশে দুই জন পোশাকধারী সিকিউরিটির দায়িত্বপ্রাপ্তকে দেখা যাচ্ছিলো। যার একজন ব্যস্ত ছিলেন যেসব ব্যাগ জমা হচ্ছে সেগুলো স্ক্যানারের ভেতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। অন্য একজন তখন হাঁটাহাঁটি করছিলেন। এবার তিনি এগিয়ে গেলেন স্ক্যানিং মেশিনের যেদিকে মনিটর, সেখানে। একবার গিয়ে উবু হয়ে কিছু একটা করলেন, এরপর মনিটর জোন থেকে বিমানবন্দরের ভেতরের দিকটায় বের হয়ে গেলেন সিকিউরিটির দ্বিতীয় ব্যক্তিটি।

অন্যদিকের যাত্রীদের ব্যাগ স্ক্যানারে দিতে একজন দায়িত্ব পালন করছিলেন। ঠিক সেই মূহূর্তের অবস্থাটি এমন ছিল, উল্টো দিকে একজন পোশাকধারী সিকিউরিটির লোক। এদিকেও (যেদিকটা দিয়ে পলাশ ঢুকছিলেন) একজন সিকিউরিটির লোক। তবে উল্টো দিকে একটি নিচু চেয়ারে বসে একজনকে দেখা যাচ্ছিল, যার মাথাটিই কেবল ক্যামেরায় ধরা পড়ে। তিনি উল্টোদিকের স্ক্যানিং মেশিনের দিকে মুখ করে বসে রয়েছেন। ধরে নেওয়া যেতে পারে স্ক্যানিং মেশিন দিয়ে যা কিছু যাচ্ছে, তা যে স্ক্রিনে ভেসে ওঠে সেটাই পরীক্ষা করছিলেন তিনি।

তাহলে এই অংশের স্ক্যানিং মনিটরের দায়িত্বে কে? গোটা দৃশ্যে তেমন কাউকেই তখন দেখা যাচ্ছিল না।

তাহলে কি পলাশের ব্যাগটি যখন স্ক্যানড হলো, তখন তাতে কী ছিল, তা দেখার কেউ ছিলেন না? তাতেই কি পলাশ সহজে পার করে নিয়ে গেলেন একটি খেলনা পিস্তল, সুইসাইড ভেস্টের নকল সব যন্ত্রপাতি নিয়ে? যা দিয়ে পরে বিমান ছিনতাইয়ের নাটক সাজিয়ে বেঘোরে প্রাণ হারালেন।

সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা একজনের গতিবিধি

এই সিকিউরিটিকর্মীর গতিবিধি কেমন ছিল? ছবি: সিসি ক্যামেরা ফুটেজ থেকে

গোটা ভিডিওতে সিকিউটির একজন পোশাকধারীর গতিবিধি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। এই ব্যক্তিকে ভিডিওচিত্রে বেশ ইতস্তত দেখা গেছে। আর পলাশের চোখও ছিল তার দিকেই। তিনি একবার এদিক, একবার ওদিক করে, মনিটর জোনে নিচু হয়ে কিছু একটা অকারণে বের করে আবার সেখানে ঢুকিয়ে, বোর্ডিং জোনের ভেতর দিয়ে আর্চওয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। আর তিনি দাঁড়ানোর পরপরই পলাশ আর্চওয়ের দিকে এগিয়ে যান। সেখানে তার নামমাত্র তল্লাশি হয়। এটিও ভেবে দেখার মতো।

সারবাংলা/এমএম

পলাশ আহমেদ বিমান ছিনতাই চেষ্টা মাহিবি জাহান সিকিউরিটি সিমলা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর