শুধু ট্রাফিক পুলিশে নয়, হিজড়াদের জন্য অন্য কাজের সুযোগও দিতে হবে
২৭ জুন ২০১৯ ২২:০১
ঢাকা: ২০১৩ সালে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে নাগরিক হিসেবে কিন্তু আমরা মনে করি কেবল স্বীকৃতিটাই যথেষ্ট নয়, তাদের জন্য আরও অনেক কাজ করার আছে। হিজড়া জনগোষ্ঠীকে ট্রাফিক পুলিশের কাজ দেওয়া হবে বলে ঘোষণা আছে। কিন্তু কেবল ট্রাফিক পুলিশে নয়, তাদের জন্য আরও অনেক কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা।
বুধবার ( ২৬ জুন) রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত লিঙ্গ বৈচিত্য জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে অবদানের স্বীকৃতির জন্য একটি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে শীপা হাফিজ এ সব কথা বলেন।
পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়াার সোসাইটি (বন্ধু)। গত দুইদশক ধরে বন্ধু বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের অবদানের স্বীকৃতির জন্য এই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার জুলিয়া নিবলেট এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত উইনি ট্রাপ পিটারসেন।
লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য দশ ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলেন রাজশাহীর দিনের আলো হিজড়া সংঘের সভাপতি পলি হিজড়া, পুলিশের এআইজি ( ল্যান্ড অ্যান্ড অ্যাসেট) বিধান ত্রিপুরা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকী, স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শামিউল ইসলাম, নৃত্যপরিচালক কবিরুল ইসলাম রতন, ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড, জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা, আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং চ্যানেল আই।
অনুষ্ঠানে শীপা হাফিজা বলেন, ‘যখন জানা গেল তাদেরকে (হিজড়া জনগোষ্ঠী) ট্রাফিক পুলিশের কাজ দেওয়া হবে তখন আমার ভয় হলো। কারণ, ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বপালন তুলনামূলক কঠিন। অনেক সময় মানুষ তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, এটি খুব কঠিনভাবে হ্যান্ডেল করতে হয়। কিন্তু যারা জন্মগতভাবে হিজড়া তাদের জীবনটা এমনিতেই কঠিন। মানুষ তাদেরকে গ্রহণ করেন না। পিতা-মাতা নিজের সন্তানকে গ্রহণ করেনি, সন্তান হিজড়া হবে এটি বুঝতে পারার পর তাকে লুকিয়ে ফেলি কিংবা সরিয়ে ফেলি। সেখানে ওভার বার্ন্ডেন জীবনের ওপর ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন কেন করতে হবে? বরং তাদের নিয়ে অন্য কিছু ভাবা যায়। কারিগরি ট্রেনিং বাড়ানো দরকার, তারা যেন উচ্চশিক্ষা পায় সেই সুযোগ দেওয়ার বিষয়েও ভাবতে হবে।’
হিজড়া জনগোষ্ঠীর মোট সংখ্যা কত সে নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, দেশে মোট কত হিজড়া রয়েছেন সেই সঠিক তথ্যটা এখনও আমরা জানতে পারছি না। এই হিজড়া জনগোষ্ঠী দেশে এখনও ‘আনটাচড এবং আন অ্যাটেনন্ডেন্ট পিপল হিসেবে রয়ে গেছে। কিন্তু তাদের অনেক যোগ্যতা, মেধা রয়েছে যদি তারা সুযোগ পায় তাহলে তারা তাদের যোগ্যতা ও মেধাকে কাজে লাগাতে পারে। রাস্তা-ঘাটে তাদের চাঁদাবাজি নিয়ে বিরক্ত সবাই, অথচ তারা কীভাবে জীবন চালাবে, কেন তারা এটা করতে বাধ্য হয় সে নিয়ে আমরা কতটুকু ভাবি? বলেও প্রশ্ন করেন শীপা হাফিজা।
তিনি বলেন, ‘এই জনগোষ্ঠীর মানুষ কাজের সুযোগ চায়, উপার্জনের পথ চায়। তারা যেন আমাদের মতো নিজের আয় নিজে করতে পারে সে স্বাধীনতাটুকু তারা যেন পায় এটিই তাদের আর্জি।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শামিউল ইসলাম বলেন, ‘যারা হিজড়াসহ ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠী রয়েছেন তারা আমাদের সমাজেরই অংশ। তাদের উপযুক্ত চিকিৎসার বিষয়টি আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। তাদের জন্য যদি আমাদের সরকারি হাসপাতালকে না রাখতে পারি, সরকারি ব্যবস্থাপনায় তাদের স্বাস্থ্যসেবা যদি নিশ্চিত না করতে পারি তাহলে হয়ত আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না।’
ডা. শামিউল ইসলাম বলেন, ‘হিজড়ারা তাদের মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়েই মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একত্রিত হবে, তারা তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করবে। আমি আশা করি তাদেরকে আলাদা করে আর বলার সুযোগ থাকবে না।’
‘কোনো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কোনো ধরনের বৈষম্য করা যাবে না বলে আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞান শিখিয়েছে। আমরা সেই শপথ নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি’ বলেন ডা. সামিউল ইসলাম।
জাতীয় আইনগনত সহায়তা প্রদান সংস্থার উপপরিচালক আবেদা সুলতানা বলেন, ‘বন্ধু ওয়েলফেয়ার সোসাইটি (বন্ধু) আমাদের পুরস্কার দিচ্ছে। যেটি আমাদের জন্য অনেক বেশি কাজের অনুপ্রেরণা হবে। এই পুরস্কার আমাদের কাজকে আরও বেগবান করবে।’
অনুষ্ঠানে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সভাপতি আনিসুল ইসলাম হিরু অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন। পরে মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার বলেন, ‘বর্তমান পৃথিবী সহিংসতা ও অপরাধে জর্জরিত। একটি শান্তিপূর্ণ এবং বাসযোগ্য পৃথিবী তৈরি করা তরুণদের প্রজন্মেরই দায়িত্ব।’
আশা প্রকাশ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘যখনই আমরা অবিচার দেখব, তখন নীরব না থেকে প্রতিবাদের পথ বেছে নেব।’
বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনার জুলিয়া নিবলেট বলেন, অস্ট্রেলিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানেন যে অধিকার রক্ষা করা কঠিন। তাই বন্ধুর কাজগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি বলেন, ‘এই জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় গণমাধ্যমসহ অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোকে একযোগে কাজ করা উচিৎ।’
ডেনিশ রাষ্ট্রদূত উইনি ট্র্যাপ পিটারসন বলেন, ‘সমাজের কাউকে পেছনে ফেলে উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই সবাইকে সঙ্গে নিয়ে একত্রে এই জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কাজ করতে হবে। বন্ধু ওয়েলফেয়ার সোসাইটি এক্ষেত্রে সমাজসচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী ভূমিকা পালন করছে।’
এরপর বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সালেহ আহমেদের বক্তব্য এবং বন্ধুর নৃত্যদল ‘সত্তা’র পরিবেশনার মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি শেষ হয়।
সারাবাংলা/জেএ/একে