শিক্ষকের ছুঁড়ে মারা লাঠিতে চোখের আলো হারালো হাবিবা!
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৪:৫৮
ঢাকা: রাজধানীর আগারগাঁওয়ের জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালের ৫ম তলার তিন নম্বর ওয়ার্ডের বিছানায় ছোট ভাইয়ের সঙ্গে খেলছিলো হাবিবা। আট বছরের মেয়েটির চোখে কালো চশমা। কারণ তার বাম চোখে অস্ত্রোপচার হয়েছে। সে চোখে এখন আর কোনও আলো নেই। নেই কোনও দৃষ্টিশক্তি।
শিক্ষকের ছুঁড়ে মারা বেত বাম চোখে আঘাত করলে এখন জীবনের এই করুণ পরিণতির মুখোমুখি হাবিবা। চিকিৎসকরা বলছেন, ওই চোখে আর কোনদিন আলো ফিরবে না শিশুটির।
হাবিবার চিকিৎসা তদারকির দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক ডা. সাইফুল্লাহর সঙ্গে কথা হচ্ছিলো সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের। চিকিৎসক জানান, শিশুটির চোখ থেকে লাঠির একটি টুকরো বের করা হয়েছে। আঘাতে তার বাম চোখটি পুরোপুরি আলো হারিয়েছে। এই চোখ দিয়ে আর দেখার সম্ভাবনা নেই।
ওর চোখের মনিটি গলে গেছে। ধীরে ধীরে তা শুকিয়ে যাবে। ফলে আর কখনোই দেখতে পাবে না, বলেন এই চিকিৎসক।
তবে চোখের স্বাভাবিক সৌন্দর্যের জন্য কিছুদিন পর তার চোখে পাথর লাগানো যাবে বলে জানান তিনি।
https://youtu.be/TF_21czCmUE
হাবিবার পাশে বসে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন মা রুবিনা আক্তার। চোখে মুখে দুশ্চিন্তা আর কষ্টের ছাপ। তিনি জানালেন, ছোট্ট শিশুটির ওপর নেমে আসা এই করুণ পরিণতির বিবরণ।
‘সেদিন বেলা ১১ টার দিকে জানতে পারি, হাবিবাকে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। তার চোখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। কোনো কিছু না বুঝেই হাসপাতালে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি মেয়ের এমন অবস্থা,’ বলেন রুবিনা আক্তার।
সহপাঠী ও রুবিনার কাছে থেকে তিনি জেনেছেন, দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাস চলছিল। ক্লাসের এক শিক্ষার্থীকে আকাশমনি গাছের ডালের একটি লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছিলেন স্কুল শিক্ষক নিরঞ্জন দেবনাথ। হাবিবা ও কয়েক বন্ধু কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো। হঠাৎই শিক্ষক তার হাতের লাঠিটি ওদের দিকে ছুঁড়ে মারেন ও সেখান থেকে সরে যেতে বলেন। লাঠিটি সরাসরি এসে আঘাত করে হাবিবার বাম চোখে। সাথে সাথে তার চোখ দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করে।
রুবিনা জানান, ওই শিক্ষক নিজেই তখন একটি ন্যাকরা দিয়ে হাবিবার চোখ চেপে ধরে হাসপাতালে নিয়ে যান।
হাবিবার মা বলেন, ‘হাবিবাকে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে কোনো চিকিৎসা না দিয়েই সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে বলেন চিকিৎসকরা। আমরা তখন সিলেটে না গিয়ে ঢাকার জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালে নিয়ে আসি।
সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১২ টায় জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালে হাবিবার চোখে অস্ত্রোপচার শুরু করে বিকেল চারটার দিকে শেষ হয়। সন্ধ্যা সাতটার দিকে তার জ্ঞান ফেরে।
অপারেশনের পর ডাক্তার বলেছেন- হাবিবার বাম চোখের আলো নেই। সে আর কোনোদিন বাম চোখ দিয়ে দেখতে পারবে না। এমনকি চোখ পরিবর্তন করলেও হবে না, বলেন রুবিনা আক্তার।’
‘আমার মেয়েটা বড় হয়ে পুলিশ অফিসার হতে চেয়েছিল,’ বলে ডুকরে কেঁদে ওঠেন এই মা।
এখন কী করবেন? এই প্রশ্নে রুবিনা বলেন, আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। মেয়ের চোখ চাই। ও অনেক ছোট, এখন হয়তো ও বুঝতে পারছে না। বড় হলে ওর কি হবে? একটা মেয়ের চোখ না থাকলে তার জীবনটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। কাজেই আমার মেয়ের চোখ কীভাবে ভালো হবে সেটাই আমি জানতে চাই।
ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে হবিগঞ্জ সদর থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন জানিয়ে রুবিনা বলেন, তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক সেটাই চাই।
তার স্বামী শাহীন তালুকদার দুবাইয়ে থাকেন জানিয়ে রুবিনা বলেন, ‘ছেলে মেয়ের ভালোর জন্য ওদের বাবা বিদেশে থেকে কষ্ট করছেন। কাজেই টাকা চাই না। চোখ চাই, চোখের আলো চাই। মেয়ে যাতে আমার দেখতে পারে। সেটাই চাই।’
হাবিবার সঙ্গেও কথা হয় এই প্রতিবেদকের। শিশুটি বললো, ‘বাম চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। সারাদিন চশমা পড়ে থাকতে ভালো লাগে না। বিছানায় শুয়ে থাকতেও ভাল লাগে না। চোখটা খুব চুলকায়।’
হাবিবার মা জানালেন, বেত ছুঁড়ে মারা শিক্ষক নিরঞ্জন দেবনাথও হাবিবাদের সঙ্গে হাসপাতালে এসেছেন। পরে তার সঙ্গেও কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
তিনি বলেন, ‘বড় ভুল হয়ে গেছে। আমার জন্য বাচ্চাটার চোখ নষ্ট হয়ে গেলো। ঘটনার দিন থেকেই হাবিবার সাথে হাসপাতালে আছি। যতদিন থাকতে হয় থাকব। যেখানে নিয়ে চিকিৎসা করাতে হয় সেখানেই নিয়ে যাব। পরিচিত-অপরিচিত সকলের সাথেই কথা বলছি- কোথায় নিয়ে গেলে হাবিবার চোখের ভালো চিকিৎসা হবে। সে আবার চোখ দিয়ে দেখতে পারবে।’
হাসপাতালের নার্স আমেনা বেগম বলেন, ‘অপারেশনের পর শিশুটি কথা বলছে, তার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে খেলছে। হাসি খুশি থাকার চেষ্টা করছে। তবে ওষুধ খাওয়াতে বা ইনজেকশন দিতে গেলে হাবিবা জানতে চায়- আমি কি সত্যিই বাম চোখ দিয়ে আর দেখতে পারব না? তার কথার উত্তর দিতে পারি না। শুধু বলি, মন দিয়ে পড়ালেখা কর। অনেক বড় হতে পারবে।
দৃষ্টিশক্তি শিক্ষকের ছোঁড়া বেত শিক্ষকের বেত শিক্ষার্থীকে শাস্তি হাবিবা