Wednesday 09 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দক্ষিণের সুখ-অসুখ: এখানে নদী মরে লোভ আর নির্যাতনে


৫ মার্চ ২০১৮ ১১:৩৮ | আপডেট: ৫ নভেম্বর ২০১৮ ১৯:৪৩
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

পিরোজপুর ও বাগেরহাট থেকে ফিরে: বলেশ্বর নদ মরে যাচ্ছে। লোভ আর নির্যাতনে নদী গুটিয়ে নিয়েছে তার প্রবাহ । উত্তরে মধুমতি নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে দু’পাশের লোভী-প্রভাবশালী লোকগুলো দখল করছে জমি। কোথাও কোথাও আগবাড়িয়ে চলছে নদী শাসন। নদীর বুকেই এখন গড়ে উঠছে বসতবাড়ী, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আর দখলের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসাবে মসজিদ-মন্দিরও।

পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার ১নং মাটিভাঙ্গা ইউনিয়নের চরবানিয়ারি গ্রামটির কথাই ধরুন। এক সময়ের প্রমত্তা বলেশ্বর নদ এখন এই জনপদে বিলীন।

লোকেরা বলেন, একসময় বলেশ্বরে বিলীন হয়েছে জনপদ। সে ছিলো প্রকৃতির বিধান। এখন জনপদে বিলীন হচ্ছে নদ। প্রকৃতির বিরুদ্ধেই প্রতিশোধে এ এক মনুষ্যসৃষ্ট সংকট।

বিজ্ঞাপন

বলেশ্বরের ক্ষীণধারা যতটুকু আছে তাতেও থাবা বসেছে দখলের। দুপাশে মাছের ঘের বানিয়ে নদীটিকে একেবারে কোনঠাসা করে ফেলা হয়েছে।

যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে কৃষি, মৎস্যসহ সামগ্রিক জীব-বৈচিত্র্যে। তাকে আবার প্রকৃতির পাল্টা প্রতিশোধ বলছেন কেউ কেউ।
উত্তর বানিয়ারি গ্রামের মাঝ দিয়ে ছিলো বলেশ্বরের একটি ছোট্ট শাখা নালা। সেটিতে কোনো পানি নেই সেই কবে থেকেই। তার পাশেই প্রায় ৮ কাঠা জমিতে বালু ভরাট করে, খুঁটি গেড়ে সাইনবোর্ড ঝুলছে- ‘মসজিদ নির্মাণের জন্য নির্ধারিত’।

পাশেই বুনো শাক তুলছিলেন রোকেয়া বেগম। বানিয়ারির এক গৃহবধু।

সারাবাংলাকে জানালেন, তার শ্বশুর খালেক খাঁ (৮০) এই জমির মালিক। দূরের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে কষ্ট হয়, তাই এখানে মসজিদ করার জন্য জমিটুকু দান করেছেন তিনি।

নদী তীরের জমির মালিক তিনি কি করে হলেন- এমন প্রশ্নের জবাব নেই রোকেয়ার কাছে। মাটির সরু রাস্তার ওপারের বাড়িটি দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘ওইটা আমার শ্বশুরের বাড়ি। বাড়ির সামনে চর জেগেছে। এ জায়গাতো আমার শ্বাশুরেরই।’
তবে এ নিয়ে আর বেশিদূর কথা এগোলো না।

বাড়িতে গিয়ে খালেক খাঁকে পাওয়া গেলো না। তাই ‘ভাল কাজে’ জমি দানের বিষয়ে জানা গেলো না বিশেষ কিছু। তবে এভাবে নদী তীর ধরে যতোদূর এগোনো যায়, দখল আর শাসনের চিহ্নই দেখা যাবে।

নানা খানে নানা উপায়ে নদীর মরে যাওয়ার দৃশ্য খুবই বেদনাদায়ক।

পিরোজপুর ও বাগেরহাট জেলার মাঝখান থেকে বয়ে যাওয়া বলেশ্বরের তীরে মাটিভাংগা, বাংলাবাজার, বাবুগঞ্জ, তারাবুনিয়া, কালিগঞ্জ, গজালিয়া, ভাসাসহ বেশকিছু পূরণো হাটবাজার। এসব বাজার এলাকায় নদী দখল হয়েছে ভয়াবহ রকমের। প্রভাবশালীরা গড়ে তুলেছেন ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও মাছের ঘের।

দখলকে কেন্দ্র করে হামলা-মামলা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামাও কম হয়নি, জানালেন এলাকাবাসী।
দেড় দশক আগেও খরস্রোতে বহমান ছিলো বলেশ্বর। তারাবুনিয়া বাজার হয়ে পশ্চিমে বাগেরহাটের চিতলমারী কিংবা পিরোজপুরের নাজিরপরসহ এ এলাকায় নৌযান চলতো।

সে কথাই বলছিলেন, বরইবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা হারুনুর রশীদ। তিনি বলেন, ক’বছর আগেও বলেশ্বরের মিষ্টি পানিতে নৌযান চলতো। দুপাশে হোগলার বনে হরেক রকম পাখির অভয়ারণ্য ছিলো। সারাবছর নদীতে মাছ ধরতো জেলেরা। গবাদিপশুর খাদ্য ছিলো নদীর তীরে। কিন্তু এর সবই এখন দুঃখময় অতীত। দখলে হারিয়ে গেছে প্রিয় বলেশ্বর। তার মতে, সরকার উদ্যোগ নিলে এখনও বলেশ্বরের প্রবাহ ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

এ নিয়ে এ এলাকার সাধারাণ মানুষের বক্তব্য, নদী যতোটা না মরছে। তার চেয়ে বেশি মেরে ফেলা হচ্ছে। নদীর বুকে বাঁশ দিয়ে ঘের দিয়ে প্রথম দিকে মাছের ঘের (ঝাইল) দেওয়ার পর নদীতে চর পড়ে যায়। এরপর বিভিন্ন স্থানে বাঁশের সাকো বানিয়ে কচুরিপানা আটকে রাখাায় নদীর এখন এই হাল।

বাজার কেন্দ্রিক ব্যবসায়ীরা নদী দখল করলেও বলেশ্বরের পুরো অববাহিকায় আধিপত্য রাজনীতিকদের। বিগত দুই দশক আগেও চর এলাকায় যেখানে প্রভাব ছিলো আঞ্চলিক প্রভাবশালীদের এখন তার দখল নিয়েছেন রাজনীতিকরা। বিগত দেড় দশক ধরে রাজনীতিকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দখলদারিত্বে বলেশ্বর কেবল দখলই হয়নি ভৌগলিক পরিচয়ও পাল্টে গেছে কোথাও কোথাও।
বলেশ্বরের তীরে কালিগঞ্জ বাজারের বলেশ্বর সেতু এলাকায় পৌঁছতে সন্ধ্যা নেমে গেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে কথা হয় মফিজুর নামের একজনের সঙ্গে। সামনের চর দেখিয়ে তিনি বললেন, ওই যে ওপারে যে ঘের-জমি দেখছেন তার মালিক ‘চেয়ারম্যান সাব’। সামনের ইটভাটাসহ বিশাল এলাকা এখন তার দখলে। তার বাড়ি খুলনা বিভাগে পড়েছে তাই বরিশালের মধ্যে এসব চর হলেও তিনি এখন ওই এলাকাকে খুলনার মধ্যে নিয়ে নিয়েছেন।

 

মফিজুরের কথা সত্যতা পাওয়া গেলো তারও কিছুক্ষণ পর। ব্রিজ পার হয়ে সন্ধ্যার পর এপারের নাজিরপুরের দক্ষিণ বানিয়ারি বাজারে যেতে যেতে কথা হয় দুই অচেনা পথিকের সঙ্গে। তারা ওপারের কালিগঞ্জ বাজার থেকে বাজার করে ফিরছিলেন। কথায় কথায় তারাও জানালেন, এক নতুন ছিটমহলের কথা। তাদের কথায়, বিশাল এ নদীর বুকে যে চর জেগেছে তা এখন রীতিমত একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। এই গ্রামের দখল নিতে এ এলাকায় একাধিকবার দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়েছে। দুই বিভাগের প্রশাসনও সে সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। একবার ওপারের (খুলনা) লোকজন এসে এপারের (বরিশাল) লোকদের অনেক বাড়ি-ঘরও পুড়িয়ে দিয়েছে। সেই থেকে ওই এলাকার নিয়ন্ত্রক এখন চিতলমারী উপজেলা চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান শামীম। তবে এ বিষয়ে চেয়ারম্যান শামীমের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায় নি।

এদিকে বলেশ্বর দখল হয়ে যাওয়ার কারণে এ এলাকার জীববৈচিত্র্য পড়েছে মারাত্মক হুমকির মুখে। বলেশ্বরের উত্তর এবং দক্ষিণের বিভিন্ন স্থানে পানি প্রবাহ একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পূর্ব-পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত নদীগুলোও মরে যাচ্ছে। নাজিরপুরের সাতকাছেমিয়া নদী তারাবুনিয়া বাজারের পাশ দিয়ে বলেশ্বরে পড়েছে। সেটিও এখন দখল হয়ে যাচ্ছে কোথাও কোথাও। বিশেষ করে বাজারকে কেন্দ্র করে এর দখল হয়েছে ভয়াবহভাবে। নদীর পাশে মাদরাসা-মসজিদের পাশাপাশি রয়েছে স্থানীয় ক্লাব। আর ব্যবসায়ীরাতো এ নদীর দখলে রীতিমত প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। ফলে সেচভিত্তিক কৃষি হুমকিতে পড়েছে। স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, সাতকাছেমিয়া নদীর প্রবাহ বন্ধ হলে এ এলাকায় লবণাক্ততা যেমন বাড়বে তেমনি কৃষি ও জীববৈচিত্র্য মারত্মকভাবে হুমকিতে পড়বে।

বলেশ্বরের দখল নিয়ে চিন্তিত পরিবেশবাদিরাও। এ নিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার পিরোজপুর শাখা ঢাকায় বড় ধরণের আন্দোলন করার চেষ্টা করে। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্রতিরোধে তা সম্ভব হয়নি। এছাড়া পিরোজপুর বাপার সভাপতি রুহুল আমিন সম্প্রতি মারা যাওয়ায় সে আন্দোলন বর্তমানে থমকে আছে বলে জানালেন সংস্থার সভাপতি আব্দুল মতিন।
সারাবাংলাকে তিনি জানান, বলেশ্বর ভয়াবহ রকমের আগ্রাসনের শিকার। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় প্রভাবশালীরা একে দখল করছে প্রতিদিন। এতে কৃষি ও জীববৈচিত্র্যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।

জাতীয়ভাবে এ নদী নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন, এমন মত দিয়ে এই পরিবেশবাদি নেতা বলেন, স্থানীয়রা এ গিয়ে না এলে দক্ষিণের এ প্রাণপ্রবাহও একদিন বন্ধ হয়ে যাবে বলেই তার শঙ্কা।

এ বিষয়ে সারাবাংলার কথা হয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমোডর মোহাম্মদ মোজাম্মেল হকের সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, নদী দখলমুক্ত করে ও নদী খননের বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে রাজধানী ঢাকার চারপাশের নদীগুলো দখলমুক্ত করতে কয়েকদফা অভিযানও চালানো হয়েছে। সেইসঙ্গে দেশের বেশকিছু নদীকে ড্রেজিংয়ের আওতায়ও আনা হচ্ছে।

মোজাম্মেল হক বলেন, ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের আওতায় দেশের নদীবন্দর কেন্দ্রিক নদীগুলোকে আনা হচ্ছে। বলেশ্বরকেও এর আওতায় আনা হবে।

সরকার চায় দেশের নদী কেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা আবার সচল হোক, বলেন তিনি।

দক্ষিণের সুখ-অসুখ: খাবার পানি নিয়ে বাড়ছে কলহ-বিভেদ!

সারাবাংলা/এমএস/এমএম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর