Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এম এ মোমেন’র নিবন্ধ- একাত্তরের যুদ্ধদিনে মার্কিন সাড়া


২৫ মার্চ ২০১৮ ২১:১৫

মার্কিন সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছে। কিন্তু স্টেট ডিপার্টেমেন্টে পাঠানো কোনো গোপন টেলিগ্রামেই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্ভ্যুদয় নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়নি। এমনকি ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স নভেম্বরেই হিসাব করে দেখিয়েছে, যুদ্ধে চার থেকে ছয় সপ্তাহের বেশি পাকিস্তান টিকে থাকবে না। হারটা হবে পূর্ব পাকিস্তানেই।

মার্কিন সরকারের প্রতি পাকিস্তানের নিঃশর্ত বন্ধুত্ব কিংবা দাসত্ব যা-ই বলা হোক নিক্সন হাত বাড়িয়েছিলেন, তা গুটিয়ে নিয়েছেন। সপ্তম নৌবহর এসে পরিস্থিতি রাতারাতি বদলে দেবেÑ ইয়াহিয়া খানের সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। পাকিন্তান সেনাবাহিনীর অহঙ্কার লুটিয়ে পড়ে ঢাকার মাটিতেই। এই সংক্ষিপ্ত রচনাটিতে মার্কিন সাড়ার কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা হবে।

বিজ্ঞাপন

ওয়াশিংটন থেকে নয়াদিল্লির টাইমস অব ইন্ডিয়ায় পাঠানো প্রতিবেদনের শিরোনাম- পূর্ববাংলার জন্য মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির সাত দফা।

রেডক্রস আন্তর্জাতিক কমিটির প্রতিনিধিদের শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়ার জন্য যেন পাকিস্তানে ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয় সে নিয়ে সিনেটে শরণার্থীবিষয়ক জুডিশিয়ারি সাব কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর এডওয়ার্ড এম কেনেডি নিক্সন প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

শরণার্থী শিবিরে কেনেডি
কেনেডি বলেন, ইসলামাবাদ সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর প্রতীকী নেতৃত্ব শেখ মুজিবের। এই সংকটের যেকোনো রাজনৈতিক সমাধানে তাঁর প্রতি ন্যায়বিচার ও তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার গুরুত্ব সর্বাধিক। পূর্ববাংলা ও ভারতের সংকট নিয়ে সিনেটর কংগ্রেসে যে সাতটি সুপারিশ করেন এটি তার একটি, যা গতকাল (১ নভেম্বর ১৯৭১) পেশ করা হয়।
অপর সুপারিশগুলো হচ্ছে-
১। দক্ষিণ এশিয়ার সংকটের মূল কারণ যুক্তরাষ্ট্রকে খতিয়ে দেখতে হবে।
২। দক্ষিণ এশিয়ার জন্য প্রেসিডেন্টকে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন বিশেষ প্রতিনিধি নিয়োগ করতে হবে।
৩। দক্ষিণ এশিয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক সাহায্যের পরিমাণ অবশ্যই বৃদ্ধি করতে হবে।
৪। স্টেট ডিপার্টমেন্টের আওতায় প্রেসিডেন্টকে একটি মানবিক ও সমাজসেবা ব্যুরো প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৫। জাতিসংঘের জরুরি সেবা কার্যক্রম প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রকে বিশেষ সমর্থন জোগাতে হবে।
৬। পূর্ববাংলার ট্র্যাজেডি অবশ্যই জাতিসংঘের সামনে উপস্থাপন করতে হবে এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে তা অন্তর্ভুক্তির বর্তমান প্রচেষ্টাকে যুক্তরাষ্ট্রের উৎসাহিত করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

কেনেডি বলেন, ভারতে শরণার্থীর অব্যাহত বিশাল জোয়ার এবং দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধের হুমকি, ওদিকে পাকিস্তান সহিংসতা ও দাবিয়ে রাখার নীতি অনুসরণ করছে পূর্ববাংলার মানুষ এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। ইসলামাবাদ সেনা সরকারের সংবেদনশীলতার প্রতি আনুগত্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে এটাকে তুচ্ছ জ্ঞান করছে।

এন্ডমন্ড মাস্কির চার দফা
ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এখন বিচার করার সময় নয়। এখন সময় যুদ্ধ শেষ করার, পূর্ববাংলার মানুষের ভোগান্তি শেষ করার, যুধ্যমান এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি স্থাপন করার। এই ভূমিকা দিয়ে সিনেটর মাস্কি (ডেমোক্র্যাট এই সিনেটর জিমি কার্টার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর সেক্রেটারি অব স্টেটের দায়িত্ব গ্রহণ করেন) যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে চার দফা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখতে আহ্বান জানান:


১। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা এবং পশ্চিম সীমান্ত থেকে ভারত ও পাকিস্তানের সেনা প্রত্যাহার।
২। পূর্ববাংলা থেকে অবিলম্বে ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা প্রত্যাহার এবং শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য জাতিসংঘ শান্তিসেনা মোতায়েন; তারা একই সঙ্গে শরণার্র্থী প্রত্যাবাসন ও ত্রাণ তৎপরতা পরিচালনা করবে।
৩। পশ্চিম পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেবে। ১৯৭০ সালের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি ও অন্যদের নিয়ে ইস্ট বেঙ্গল লিডারশিপ গ্রুপ তৈরি করবে।
৪। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধি বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপের বাইরে সমান অবস্থানে থেকে দুই সত্তা পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করবে।

এডমন্ড মাস্কির প্রস্তাব যখন আসে ততদিনে পাকিস্তানের ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছে। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট নিক্সন যখন বড় গলায় ‘চরম নিরপেক্ষতা’র কথা বলছেন তখন পশ্চিম পাকিস্তানের সওদাগরি জাহাজে বোঝাই করা হচ্ছে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ।
এডমন্ড মাস্কি বলেন, আসল সমস্যা পূর্ববাংলার ভবিষ্যৎ। সেখানকার মানুষ যদি একটি নিশ্চিত ও ন্যায্য ভবিষ্যৎ দেখতে না পায় তাহলে এ যুদ্ধ শেষ হওয়ার নয়।

মে ২৬, ১৯৭১ প্রেসিডেন্ট নিক্সনের জন্য মেমোরেন্ডাম

পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি এখন এমন এক পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে, আমাদের বিশ^াস তা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারে। আর এ ধরনের সংঘর্ষ ঘটলে ভারত সীমান্তে চীনের চাপ আর এর ফলশ্রুতিতে ভারতকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বর্ধিত সামরিক সহায়তার বিষয়টি বাদ দেবার উপায় নেই।

তিনটি বিষয় যুদ্ধের বিপদাশঙ্কা সৃষ্টি করেছে: পূর্বে পাকিস্তানের নিরবচ্ছিন্ন সামরিক নিপীড়ন, অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং রাজনৈতিকভাবে সংকট সমাধানে ব্যর্থতা।

যতদিন পূর্ব পাকিস্তান সংকটের সুরাহা না হচ্ছে, যুুদ্ধের হুমকি রয়েই যাবে। রাজনৈতিক সমাধান কতটা জরুরি এটা প্রসিডেন্ট ইয়াহিয়া নিজে যতক্ষণ না বুঝবেন, আমরা মনে করি ততক্ষণ তিনি কোনো ধরনের পদক্ষেই নেবেন না। আমরা তাকে এ পরিস্থিতি বুঝতে বাধ্য করতে পারি না- কাজেই আমাদের সহায়তার সাথে রাজনৈতিক শর্ত জুড়ে দিতে পারছি না। যা হোক আমরা তেমন কিছু করা থেকে বিরত থাকব যা ভেতর থেকে তার ওপর চাপ সৃষ্টি করে কোনো পদক্ষেপ নিতে বাধ্য না করে।


ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা ও আতঙ্ক দূর করতে আমরা পর্যায়ক্রমিক কিছু কাজ করে যাচ্ছি। তালিকাটি সংযুক্ত হলো।

আমরা এখানে [ওয়াশিংটন] এবং ইসলামবাদের তিনটি মুখ্য বিষয়ের ওপর জোর দিচ্ছি।
প্রথমত, পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণকার্য পরিচালনার জন্য তারা যেন আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহযোগিতা পেতে থাকে। এতে পাকিস্তান সম্মত বলেই মনে হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ অবস্থা ফিরিয়ে আনা, ভারতে চলে যাওয়া শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নেওয়া সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তান স্বীকার করেছে, এটা করা দরকার। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কেবল ‘খাঁটি পাকিস্তানি ’নাগরিকদের প্রত্যাবর্তনের ঘোষণা দিয়ে বিষয়টিকে বিতর্কিত করে ফেলেছেন।
তৃতীয়ত, রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে আমরা জোর দিয়ে যাচ্ছি, যদিও এ পর্যন্ত তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।

ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং ও হেনরি কিসিঞ্জারের বাংলাদেশ আলোচনা
কিসিঞ্জার বলেছেন, ‘আমরা যেভাবে দেখছি, পূর্ব পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত স্বাধীন হবে।’ তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রদূত কিটিংয়েরও একই মত। এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑ ‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধাবে কে?
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার জন্য আামাদের প্রেসিডেন্টের একটি বিশেষ অনুভূতি রয়েছে।

কিসিঞ্জার বললেন, প্রেসিডেন্টের একটি বিশেষ উদ্বেগের জায়গা হচ্ছেÑ সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া থেকে ভারতকে নিরুৎসাহিত করা।
রাষ্ট্রদূত কিটিং বললেন, চল্লিশ লক্ষ শরণার্থী সমস্যার মানবিক দিক বিবেচনা করা ছাড়াও তিনি পাকিস্তনের সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে কথা বলতে চেয়েছেন।
তিনি বললেন, তিনি মনে করেন, ‘যেখানে ওরা পূর্ব পাকিস্তানিদের এখনও হত্যা করে চলেছে এবং শরণার্থীরা সীমান্ত পথে পালিয়ে আসছে, সেখানে সামরিক সহায়তা দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।’
কিসিঞ্জার বলেন, প্রেসিডেন্ট নিক্সন চান ‘পাকিস্তান সাফল্য লাভ করুক।’
কিটিং জানালেন, যতদিন পূর্ব পাকিস্তানে হত্যাযজ্ঞ চলবে ততদিন পাকিস্তানের জন্য সামরিক সহায়তা বহাল করা সে প্রেক্ষাপটে একটি ভুল কাজ হবে। ঢাকা এখন মোটামুটি শান্ত, যদিও ঢাকা শহরের কেবল অর্ধেক লোক দৃষ্টি নিবদ্ধ করছে হিন্দু জনগণের ওপর। প্রথম দিকে যারা সীমান্ত ডিঙিয়ে ভারতে গিয়েছে তাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের অনুপাত পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু-মুসলমান জনসংখ্যার অনুপাতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু এখন যারা সীমান্ত পেরোচ্ছে তাদের ৯০ ভাগই হিন্দু।
রাষ্ট্রদূত মনে করেন, ভবিষ্যতের যে কোনো আর্থিক সহায়তার সাথে কতগুলো শর্ত জুড়ে দিতে হবে:
[১] পূর্ব পাকিস্তানে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে হবে।
[২] শরণার্থী প্রবাহ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে এবং এমন একটি পরিস্থিতির সূচনা করতে হবে যা ভারতে চলে যাওয়া শরণার্থীদের পূর্ব পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের সূচনা করবে।
[৩] পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতির রাজনৈতিক সমাধানের পদক্ষেপ নিতে হবে।
আবশ্য তিনি বললেন, কেমন করে তা শুরু হবে কিংবা আদৌ তা শুরু হবে কি-না তিনি জানেন না।
ফারল্যান্ডের গোপন টেলিগ্রাম


হেনরি কিসিঞ্জারের সাথে রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড

ইসলামাবাদে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জারের উদ্দেশ্যে একটি টেলিগ্রাম পাঠান। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি একটি দিক-নির্দেশক পত্র।

আমাদের বিবেচনায় পূর্ব পাকিস্তান হারানোর পর ইয়াহিয়ার সামনে দুটো পথ খোলা :
ক) পাকিস্তানের সকল সামর্থ প্রয়োগ করে পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া যাতে কাশ্মীরের উল্লেখযোগ্য অংশ দখলে নিয়ে যেতে পারে যা ভারতের সাথে দরকষাকষি করার শক্তি যোগাবে এবং পূর্ব রণাঙ্গনে পরাজয়ের ক্ষতে প্রলেপ লাগাতে কিছুটা সাহায্য করবে। পাকিস্তানের জাতীয় সম্মান ও সেনাবাহিনীর গৌরব পুনরুদ্ধারে এ ধরণের পথ বেছে নেওয়া উত্তম। পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে বেকায়দার একটি বিষয় হচ্ছে ভারতের সৈন্যসংখ্যা পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি। এদিকে পূর্ব রণাঙ্গনে শত্রুতার অবসানের সাথে সেখানকার সেনাদল পশ্চিমে এনে ভারত তার সামরিক শক্তি-আরও বাড়িতে ফেলতে পারবে। কিন্তু এই কর্মকৌশলের ঝুঁকির দিক হচ্ছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতের কাছে উল্টো মার খেয়ে যেতে পারে- যার ফলে পশ্চিমে যখন যে সামরিক নেতৃত্ব বহাল রয়েছে তা ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করে তুলবে। আর পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর বিপর্যয় ঘটলে পশ্চিম পাকিস্তানে নিঃস্ব ও দরিদ্র বনাম ধনাঢ্য শ্রেণির দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যাবে সেই সাথে শুরু হবে বালুচ পশতু এবং এমনকি সিন্ধি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন।

খ) পূর্ব পাকিস্তান হারানোর ক্ষতি মেনে নেওয়া এবং পশ্চিমে আরও যুদ্ধে না জড়িয়ে তা থামানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এই কর্মকৌশল হজম করতে পাকিস্তানের সমস্যা হবে কিন্তু তা আর একবার যুদ্ধ’ করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে প্রস্তুত করতে এবং কিছুটা হলেও সেনাবাহিনীর বিশেষ সুযোগ ও মর্যাদা ধরে রাখতে সক্ষম হবে।

যে পাকিস্তান মার্চের ভুল হিসেব এবং ডিসেম্বরের হঠকারী অভিযানের পর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে তাকে আমাদের বলতে হবে ভারতকে পশ্চিমের হাতে তুলে দেওয়া একটি ভ্রান্ত ও অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন কাজ হয়েছে।

উভয় দেশের আবেগময় সম্পৃক্ততা বিবেচনায় এনে আমরা অন্যদের সাথে কার্যকরভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারব কি না তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সম্ভবত চীন, ইরান এবং বন্ধুভাবাপন্ন আরব দেশগুলোকে এই চর্চায় এগিয়ে আনা যায়।

সীমিত যুদ্ধের পর যদি ধরা হয় সেনাবাহিনীর কোনো ক্ষত হয়নি, কিন্তু তারা যে ক্লান্ত এতে তো বিতর্ক নেই, আমরা দেখতে পাচ্ছি- পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের তিক্ত গালাগালের একটি সময় পার করছি। আমরা মনে করি ইয়াহিয়া ধীরে ধীরে অবসরে চলে যাবে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তান সরকারকে কথা শোনাবার মত অসাধারণ সুযোগ রয়েছে। আমরা আশা করব ভবিষ্যতেও যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তান সরকারের নেতৃবৃন্দ ও ভুট্টোর কাছে প্রবেশধিকার অব্যহত রাখবেÑ জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অবস্থান এবং সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যুক্তরাষ্টের ভূমিকা এই সুযোগ সৃষ্টি করেছে। অবশ্য এই প্রবেশাধিকারকে, পাকিস্তান যাকে তার জাতীয় স্বার্থ মনে করেছে তার বিনিময়ে প্রাপ্য মনে করলে চলবে না। বিষ্ময়কর ঘোরের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের পরাজয় তাদের তাড়া করে ফিরবে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মুখ্য ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে যেন পশ্চিম পাকিস্তান কোনোদিকে চরমভাবে ঝুঁকে না পড়ে- বামে কিংবা ডানে।

পশ্চিম পাকিস্তান চীনকে প্রধান মিত্র হিসেবে বিবেচনা করে যাবে যদিও সামরিক শক্তি নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে ব্যর্থতার কারণে চীনকে অনেক কটু-কাটব্যও শুনতে হবে।

আমাদের বিশ্বাস বাংলাদেশের প্রথম দিককার নৈরাজ্যের মধ্যে চীনারা ভবিষ্যতের চীনপন্থী রাজনীতির/গেরিলা আন্দোলনের বীজ বপন করবে যাতে সোভিয়েত প্রভাব সীমাবদ্ধ থাকে এবং ভারত বিব্রত হয়।

রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের পত্র স্পষ্টভাবেই দেখিয়ে দেয় বাংলাদেশের জন্য মার্কিন জনগণের যত সমর্থনই থাক, মার্কিন সরকার বরাবর পাকিস্তানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়াটা ছিল অনিবার্য। সপ্তম নৌবহর নিয়ে ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানের পুরনো মানচিত্র অক্ষত রাখার স্বপ্ন যারা দেখেছেন, হতাশ হয়েছেন তাদের সবাই। কার্যত এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে ইতিমধ্যেই ‘পরাজিত শক্তি’ ভাবতে শুরু করেছে।

প্রেসিডেন্ট নিক্সনের জন্য হেনরি কিসিঞ্জারের স্মারক আগস্ট ১৮, ১৯৭১


যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকৌশল
– শরণার্থীর নতুন জোয়ার যে দুর্ভিক্ষাবস্থা সৃষ্টি করলে ত্রাণ সহায়তা দিয়ে তার মোকাবেলা করা এবং ভারতীয় হস্তক্ষেপের আরও ঘনীভূত অজুহাত এড়ানো জরুরি, কিন্তু
– প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যদি সামরিকভাবে পূর্ণনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে কিংবা রাজনৈতিকভাবে গেরিলাদের দমন করতে সমর্থ না হন তাহলে এই খাদ্য বিতরণও ব্যর্থ হয়ে যাবে।

আমাদের জন্য একমাত্র কর্মকৌশল হতে পারে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নেতৃত্বে থেকে দুর্ভিক্ষের দিকে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করা- তাতে আশা করা যায় ভারতকে সামরিক হস্তক্ষেপের অজুহাত সৃষ্টি করা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায় এবং কিছু রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে ইয়াহিয়ার মুখ বাঁচানো যায়।

স্বাভাবিক অবস্থা আবার প্রতিষ্ঠা করতে ইয়াহিয়া যদি সামরিক নিয়ন্ত্রণের চেয়ে রাজনৈতিক পদক্ষেপের ওপর বেশি নির্ভর করেন তাহলে কিছু ব্যবস্থা তাকে নিতে হবে।

এই পর্বে চীনের ব্যাপারে আমাদের ভূমিকা: পূর্ব পাকিস্তানের স্বশাসনের সিদ্ধান্তে সায় দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যদি পাকিস্তানকে দু’খ- করে ফেলতে উদ্যোগী হয়, পিকিংয়ের দৃষ্টিতে তার প্রভাব পড়বে তাইওয়ান ও তিব্বতের ওপর। আমরা চীনের বিরুদ্ধে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে জোট বেঁধেছি চীন যাতে এমন মনে না করে সেটাও লক্ষ্য রাখতে হবে।

সে কারণে এখন এটা জরুরি যে ভারতের ব্যাপারে আমরা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে দু’কদম পিছিয়ে থাকি, যদিও দীর্ঘমেয়াদে ৬০ কোটি ভারতীয় ও বাঙালিদের সরিয়ে দেয়াতে আমাদের লাভের কিছু নেই।

একই সঙ্গে আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে যেন পাকিস্তান আক্রমণ করার কোনো অজুহাত ভারত খুঁজে না পায়। ভারতের কাছে আমাদের যে অবস্থান তা কোনোভাবেই আমরা হারাতে চাই না অথবা সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীন কোনোদিকে ঝুঁকে পড়তে চাই না। যদি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যায় তবে আমাদের চীনচর্চা একটি যন্ত্রণাদায়ক বিষয়ের ওপর নিবদ্ধ হবে- তা হচ্ছে চীনের ভারত আক্রমণ।

ভারতের ওপর আমাদের হাত কতটা জোরদার তার অনিশ্চয়তা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। ভারতীয়রা চাইবে যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে একটি ভারসাম্য রক্ষা করে চলুক, আপাতদৃষ্টিতে তা স্ববিরোধী মনে হলেও পাকিস্তানের ওপর আমাদের এতটা প্রভাবের কারণেই ভারত এটা চাইছে।

আমি ভারত থেকে যে সাড়া পেয়েছি তা হচ্ছে ‘আপনারা তো বলেন আপনাদের নীতি পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বজায় রাখা, বেশ তাই করুন।’

আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো হতো সমস্যা সমাধানের জন্য সবকিছু মিলিয়ে ইয়াহিয়ার কাছ থেকে একটি প্যাকেজ প্রস্তাব- যার কৃতিত্ব নয়াদিল্লিও প্রদান করত এবং আমাদের কংগ্রেসও। তখন আমরা ভারতীয়দের একথা বলতে পারব:
ক) তাদের শরণার্থীর যে বোঝা তা বহন করতে আমরা ভারতকে পুরো খরচই দিয়ে দিচ্ছি।
খ) শরণার্থী সমস্যাই যদি ভারতের উদ্বেগের প্রধান কারণ হয়ে থাকে তাহলে তাদের উচিত পাকিস্তানের সঙ্গে সহযোগিতা করে শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করা, ভারতের পক্ষে তা সম্ভব।

ইয়াহিয়ার সাড়া পেলেই ভারতকে নিরস্ত্র করতে আমরা নতুন করে উদ্যোগ নেব, তবে এ মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের কর্মসূচির মানোন্নয়নে মনোযোগ দেয়াই সঠিক কাজ হবে।

সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির গোয়েন্দা স্মারক: ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতি প্রতিবেদন ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা
নয়াদিল্লিতে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ সংক্রান্ত সংবাদ স্থানীয় সংবাদ-মাধ্যম যেভাবে প্রকাশ করেছে তা হচ্ছে :

ক) পূর্বাঞ্চলে সকল সশস্ত্র পাকিন্তানি বাহিনীকে ভারত ও বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর ভারতীয় কমান্ডার ইন চিফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে;
খ) এই আত্মসমর্পণে সকল পাকিস্তানি সেনা ও নৌবাহিনী এবং প্যারামিলিটারি ফোর্স অংশ নেবে;
গ) এই বাহিনী বর্তমানে যেখানে আছে সেখানে অস্ত্র সমর্পণ করে নিকটস্থ নিয়মিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে;
ঘ) তখন পাকিস্তানি পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড জেনারেল অরোরার হুকুমের আওতায় চলে আসবে, আত্মসমর্পণের শর্তের ব্যাখ্যায় তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।

অরোরা আশ্বাস দিয়েছেন আত্মসমর্পণকারীদের সঙ্গে মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করা হবে, যারা তার কাছে আত্মসমর্পণ করবেন তাদের সবার নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেওয়া হবে। তিনি সব বিদেশি নাগরিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং যাদের উৎস পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

১৬ ডিসেম্বর সকালে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি পাকিস্তান সরকারের ওপর শর্তসমূহ আরোপের জন্য ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকবের কাছে হস্তান্তর করেন।
ক) শেখ মুজিবকে নিরাপদে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করতে হবে।
খ) পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালিদের বাংলাদেশে নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের অনুমতি দিতে হবে।
গ) পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থারনত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নিরাপদে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ দিতে হবে এবং পূর্ব বাংলায় অবস্থানরত সকল পাকিস্তানি সৈন্য ভারত-বাংলাদেশ যৌথ মিলিটারি কমান্ডের কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সমর্পণ করবেন।
ঘ) পাকিস্তানের ঘোষিত প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিন ও অন্যান্য দেশদ্রোহীদের বিচারের জন্য বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে হবে।

পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ও পশ্চাদপসারণের কারণে সেনা কর্মকর্তারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। পশ্চিম পাকিস্তানে ভারী যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করে আক্রমণ পরিচালনা করতে না দেওয়ায় তারা ইয়াহিয়াকে দোষারোপ করছে। কমিউনিস্ট চীন পাকিস্তানের পক্ষে সামরিক হস্তক্ষেপ করবে এ আশায় বসে থাকা এবং সোভিয়েত হস্তক্ষেপ নিয়ে অতিরঞ্জিত ভীতি সঞ্চারের দায় তারা ইয়াহিয়াকে দিচ্ছে।

সারাবাংলা/এমএম

স্বাধীনতা দিবস. ২৬ মার্চ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর