মুজিববর্ষের জ্বালানি নিরাপত্তা দিবসে সমৃদ্ধির প্রত্যয়
৯ আগস্ট ২০২১ ০৭:৫৯
ঢাকা: ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট। ব্রিটিশ তেল গ্যাস কোম্পানি ‘শেল অয়েল’-এর কাছ থেকে ৪৫ লাখ পাউন্ড তথা তখনকার মূল্যমানে ১৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকায় পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র কিনে নিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই পাঁচ গ্যাসক্ষেত্র রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আনার মাধ্যমেই দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার গোড়াপত্তন হয়। এরপর ঘাতকের বুলেট জাতির পিতার পথচলাকে থমকে দেয়। পঁচাত্তর পরবর্তী সরকারগুলোর নীতিমালাতেও জ্বালানি নিরাপত্তা প্রাধান্য পায়নি। পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ফের জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। তারই সূত্র ধরে দেশ জ্বালানি নিরাপত্তার দিকে অনেকটাই এগিয়ে গেছে।
এমন প্রেক্ষাপটেই আজ সোমবার (৯ আগস্ট) সারাদেশে পালন হতে যাচ্ছে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস। ২০১১ সাল থেকে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘মুজিববর্ষে জ্বালানি খাত, সমৃদ্ধিতে এগিয়ে যাক’।
জাতির জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জ্বালানির নতুন নতুন উৎস অনুসন্ধানসহ জ্বালানির সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে জ্বালানি নিরাপত্তা দিবসের যাত্রা শুরু। তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে গত বছর ভার্চুয়াল সেমিনারের মাধ্যমে দিবসটি পালন করা হয়। এ বছরও জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের পক্ষ থেকে একইরকম কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। এদিকে দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলাদা বাণী দিয়েছেন।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গবন্ধুর কেনা তিতাস, বাখরাবাদ, রশিদপুর, হবিগঞ্জ ও কৈলাশটিলা— এই পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র কিনে নেওয়া ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের জন্য এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জ্বালানি খাতে এই সিদ্ধান্তকে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পরবর্তী সময়ে এই গ্যাসক্ষেত্রগুলো জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তার বড় নির্ভরস্থল হয়ে ওঠে। নতুন গ্যাসক্ষেত্র কেনার পাশপাশি বঙ্গবন্ধু গুরুত্ব সাগরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানেও গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কাঁচা তেল আমদানি নীতি ও তরল জ্বালানির সাশ্রয়ী ব্যবহারের বিধিবিধান প্রণয়ন ও অনুসরণও করা হয় তার সময়েই।
জ্বালানি খাতের সংশ্লিষ্টদের অভিমত, বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে আজ দেশের জ্বালানি খাত বহু দূর এগিয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্প কারখানায় তেলের বদলে গ্যাসের ব্যবহার বাড়ছে। তেল সাশ্রয় করে গ্যাসের ব্যবহার বাড়ানো এবং সাগরের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করা সরকারের কাছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে।
এদিকে, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ের সরকারগুলো জ্বালানি নিরাপত্তাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। অন্য সব খাতে এই সময়ে যেমন জাতীয় সক্ষমতার বিকাশ খুব একটা হয়নি, একই পরিস্থিতি ছিল জ্বালানি খাতেও। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর কিছু কাজ শুরু করলেও ২০০১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় সেই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে। পরে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ফের সরকার গঠন করলে জ্বালানি খাতে বিশেষ নজর দেওয়া হয়। এরপর টানা এক যুগ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে এই খাতকে অনেকটাই এগিয়ে নিয়েছে। এই এক যুগে জ্বালানি খাতে দেশের অর্জনও ব্যাপক।
জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সূত্র অনুযায়ী, ২০০৯ সালে নতুন স্ট্রাকচার আবিষ্কারের সংখ্যা ছিল তিনটি (বাপেক্স)। ২০২০ সালে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২টিতে। অনুসন্ধ্যান কূপের সংখ্যা ২০০৯ সালে ছিল দুইটি— একটি বাপেক্সের, অন্যটি আইওসি’র। ২০২০ সালে এই সংখ্যা হয়েছে ১৮টি— বাপেক্সের ১২টি, এসজিএফএলের দুইটি ও আইওসি’র চারটি। অন্যদিকে ২০০৯ সালের চারটি ওয়ার্কওভার কূপের জায়গায় ২০২১ সালে ওয়ার্কওভার কূপের সংখ্যা ৪১টি। এর মধ্যে বাপেক্সের ৩৭টি।
শুধু তাই নয়, ২০০৯ সালে একটিমাত্র গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত ছিল দেশে। বর্তমানে এই সংখ্যা চারটি এবং সবগুলোই বাপেক্সের। দেশের গ্যাস ক্ষেত্রগুলো থেকে ২০০৯ সালে দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ছিল ১২০০ থেকে ১৫৫০ এমএমসিএফডি, ২০২০ সালে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭৪৪ থেকে ২৭৫২ এমএমসিএফডিতে। ২০০৯ সালের ৭৩ কিলোমিটার থেকে গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২০৯ দশমিক ০৬ কিলোমিটারে।
এদিকে, কয়লার উৎপাদন ২০০৯ সালে ছিল ৬ দশমিক ৯৬ লাখ মেট্রিক টন। এখন এর পরিমাণ ১১৭ দশমিক ৩০ লাখ মেট্রিক টন। গ্রানাইটের উৎপাদন ২০০৯ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৬৯ লাখ মেট্রিক টন, যা এখন হয়েছে ৫৫ দশমিক ১৭ লাখ মেট্রিক টন। অন্যদিকে জ্বালানি তেল ২০০৯ সালে ছিল ৪০ দশমিক ৪৯ লাখ মেট্রিক টন, যা ২০২০ সালে ছিল ৮৬ দশমিক ৩২ লাখ মেট্রিক টন। তখন তেলের মজুত সক্ষমতা ছিল ৯ লাখ মেট্রিক টন, যা এখন ১৩ দশমিক ২৮ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে।
শুধু তাই নয়, ২০০৯ সালে এলপিজি সরবরাহ ছিল ৪৫ হাজার মেট্রিক টন, যা বর্তমানে বেড়ে হয়েছে ৭ লাখ মেট্রিক টন। ওই সময়ে রি-গ্যাসিফাইড তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) কোনো সরবরাহই ছিল না দেশে। সেখানে বর্তমান সরকার ৭২৩ এমএমসিএফডি এলএনজি আমদানি করেছে। এছাড়াও সরকার গ্যাসের গ্রাহকদের প্রিপেইড মিটারের আওতায় এনেছে। এরই মধ্যে ২ লাখ ৭৩ হাজার ১০০টি প্রিপেইড মিটার স্থাপনও করা হয়েছে। এর বাইরেও নতুন চারটি রিগ কেনা হয়েছে। কম্প্রেশার স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে তিনটি— মুচাই, আশুগঞ্জ ও এলেঙ্গায়।
এদিকে, জ্বালানি নিরাপত্তা দিবসের বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো.আবদুল হামিদ জীবাশ্ম জ্বালানির উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে জোরদার প্রচেষ্টা চালানোর জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সূচকের ঊর্ধ্বগতি নিশ্চিত করতে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানির জোগান গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। সেটি অনুধাবন করেই জাতির পিতা শেল অয়েলের কাছ থেকে পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র কিনে রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা এবং দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ভিত্তির সূচনা করেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, বাংলাদেশের শিল্প কারখানার অন্যতম প্রধান জ্বালানি প্রাকৃতিক গ্যাস। দেশের অব্যাহত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের সমন্বয় থাকা আবশ্যক। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার দেশের স্থলভাগে ও সমুদ্রসীমায় তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলন, সঞ্চালন ও বিতরণের নানাবিধ কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। এছাড়া সৌরশক্তিসহ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে সরকারের প্রচেষ্টাও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেছেন। গ্যাস ও কয়লার উৎপাদন বাড়ানো, দেশে গ্যাসের বর্ধিত চাহিদা মেটাতে এলএনজি আমদানি করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা, স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণসহ গ্যাস উত্তোলন, প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ কয়লার মজুত নির্ধারণ, আহরিত জ্বালানি সম্পদ ব্যবহারের নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত এবং সংশ্লিষ্ট আবকাঠামো উন্নয়ন সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সংযোজনের উদ্যোগগুলোর কথা তুলে ধরেন তিনি।
শেল অয়েলের কাছ থেকে জাতির জনকের পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র কেনাকে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করেন প্রধানমন্ত্রী। তার জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নীতি অনুসরণ করেই আওয়ামী লীগ সরকার বর্তমানে তেলের মজুত সক্ষমতা বাড়াচ্ছে এবং সরবরাহ ও বিতরণে আধুনিকতা এনেছে বলেও উল্লেখ করেন। গ্যাস সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার এবং গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে সুসংহত রূপদানের পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব ও অন্যান্য বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার এবং জ্বালানির অপচয় রোধ করে সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ দিবসটি অনুপ্রেরণা জোগাবে বলেও আশাবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সারাবাংলা/জেআর/টিআর
জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ