Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এখনো মেলেনি কিষাণীর শ্রমের স্বীকৃতি


১৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ১০:৩৬

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঘরের কোণে শাকসবজি। সবুজে ভরে উঠে বাড়ির চারদিক। পুকুর পাড়ে বাহারি ফলের গাছ। এর সবটুকুই করছেন একজন নারী। এমনকি মাছের পরিচর্যাও। এ ছাড়া অনেক অঞ্চলেই নারীরা ধান কেটে ঘরে তুলে আনছেন এমন দৃশ্যও চোখে পড়ে হরহামেশায়। শুধু তাই নয়, বীজ বপন থেকে শুরু করে ধান উৎপাদনের ২৫টি ধাপের মধ্যে অন্তত ২০টিতেই নারীর অবদান আছে। বিশ্বব্যাংকের এক জরিপের তথ্যমতে, দেশের কৃষিতে নারীর অবদান ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ।

বিজ্ঞাপন

আর এভাবেই প্রতিনিয়ত কৃষিতে যখন নারীর অবদান বেড়ে চলছে তখন ফসলের মাঠে যেতে নারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয় কুষ্টিয়ায়। ফসলের ক্ষতি ও অসামাজিক কার্যকলাপের ধোঁয়া তুলে কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ ইউনিয়নের কল্যাণপুর জামে মসজিদের মাইক ব্যবহার করে ধর্মের নামে ওই ফতোয়া জারি করা হয়। গণমাধ্যমে এই সংবাদ প্রচার হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

বিষয়টি নিয়ে কথা হলে কৃষি সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আর মানবাধিকার কর্মীরা বলেছেন সচেতনতা বৃদ্ধির কথা।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আব্দুল আজিজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশের অনেক অঞ্চলেই নারীদের কাজে এখনো সামাজিক কিছু বিধিনিষেধ আরোপ রয়েছে । আমরা আশা করব, অজ্ঞতা আর অসচেতনা থেকে বেরিয়ে এসে নারীদের কাজের মূল্যায়ন করা হবে।’

এই ঘটনাকে সাময়িক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রান্তিক এলাকায় মাঠ দিবসের অনুষ্ঠানে কিন্তু ৩০ শতাংশ নারী । ভবিষ্যতে এই সংখ্যা বাড়বে বলে প্রত্যাশা করছি।’

আর কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘কৃষি ক্ষেত্রে যদি ধান উৎপাদনের কথা বলি তবে ২৫টি ধাপের মধ্যে অন্তত ২০টি কাজ নারীরা এককভাবে করছে। বাকিগুলোর পুরুষদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে। তবে এ কথা ঠিক আমাদের নারীরা যতটুকু বিনিয়োগ করে কৃষিকে উন্নত করছেন, সমৃদ্ধ করছেন; তারা সেভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছে না।’

বিজ্ঞাপন

কৃষিতে নারীর অবস্থা: দেশে প্রথমবারের মতো ১৯৯৫-৯৬ সালের শ্রম জরিপে নারীকে কৃষক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কৃষিতে নারী শ্রমিকের সংশ্লিষ্টতার এটিই ছিল প্রথম স্বীকৃতি। আর ২০০৫-০৬ সালের শ্রম জরিপে বলা হয়, ১৫ বছরের ওপরের জনশক্তির ৪৮ দশমিক ১ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত। ওই জনশক্তির ৪২ শতাংশ পুরুষ এবং ৬৮ শতাংশ নারী। এসব নারীরা প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ কিংবা সরাসরি কৃষি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পূর্বের ওই জরিপ অনুযায়ী কৃষিতে নারীর অবদান পুরুষের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি।

২০০৮ সালে বিশ্বব্যাংকের আরেক জরিপের তথ্য থেকে জানা গেছে, দেশের কৃষিতে নারীর অবদান ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ। তবে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নারী শ্রমিকের অবদান অন্তভুর্ক্ত করা হয়নি। তাদের নিয়ে নেই আলাদা কোনো পরিসংখ্যানও। কৃষি ক্ষেত্রে কর্মরত নারী শ্রমিকেরা একই পরিশ্রম করে মজুরি পায় অর্ধেক।

কৃষকদের নিয়ে কাজ করা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হাতে কৃষাণীদের নিয়ে কোনো তথ্য নেই। খোদ এই অধিদফতরের কাছ থেকেও নারীর অবদান নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। তবে একাধিক তথ্যমতে, গত এক দশকে অবৈতনিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখের ৫০ লাখই নারী। যাদের ৭৭ শতাংশ কৃষি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

দেশের কৃষি গবেষণার শীর্ষ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি)। নারী বিজ্ঞানী হিসাবে প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসে প্রথমবারের নির্বাহী চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন ড. ভাগ্য রাণী বণিক। বিষয়টি নিয়ে কথা হলে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরা যারা গবেষণায় আছি, গবেষণা করতে গিয়ে মাঠের সঙ্গে আমাদের সব সময় সম্পৃক্ত থাকতে হয়। কৃষকদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে তাদের যে সমস্যা তা আমরা দেখি এবং সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আমাদের গবেষণা এগিয়ে চলে। সবার সম্মিলিত প্রয়াসেই বর্তমানে কৃষির এই অবস্থা।’

কুষ্টিয়ায় নারীদের মাঠে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যে কথাটা আজ নতুন করে এসেছে এই মুহূর্তেই সেই কথাটা থাকার কথা না। ছোটবেলায় দুই একটা কথা শেনা গেছে— নারীরা সেভাবে মাঠে যায় না, পানের বরজে নারীদের ঢুকতে দেওয়া হয় না। এই মুহূর্তে কৃষির সঙ্গে আমরা এত বেশি সম্পৃক্ত যে মাঠে গেলে দেখা যায়, নারীরা ধান লাগাচ্ছে। তাদের কাজটাকে সবাই পছন্দ করে। সে যে কাজই করুক শতভাগ মন দিয়ে করে। চায়ের বাগানের দিকে যদি তাকাই, সেখানে দেখতে পাব আদিকাল থেকেই নারীরা চা পাতা উঠাচ্ছে। আজকে যদি নতুন করে কোনো রকমের প্রতিবন্ধকতা আসে তাহলে তা সমাজের জন্য উন্নয়নমূলক কাজ হবে না। এটি অবশ্যই নেতিবাচক।’

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) মহাপরিচালক ড. আবুল কালাম আযাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘নারীদের হাত ধরেই কিন্তু কৃষির উৎপত্তি। বর্তমানে কৃষির অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীরাই সম্পৃক্ত।’

তিনি বলেন, ‘চাষাবাদ পুরুষ করে থাকলেও কৃষির অন্যান্য কাজকর্মে নারীদের অংশগ্রহণ ৫০ শতাংশের বেশি। আমি মনে করি মোট দেশজ উৎপাদনে নারীর অবদান অর্ধেকেরও বেশি।’

ফতোয়া প্রসঙ্গে কথা হলে মানবাধিকার কর্মী এলিনা খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘কিছু লোক আছে না বুঝে অনেক কথা বলে। দেশের হাইকোর্ট একটা পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। তবে এই পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে সবাই জানে না। কে বা কারা ফতোয়া দিতে পারবে এটি ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে সকল জায়গায় প্রচার করা উচিত।’

তিনি বলেন, ‘সচেতনার অভাবে এই লোকগুলো ফতোয়া দিচ্ছে। আর এই ফতোয়বাজদের কারণে মেয়েরা শিকার হচ্ছে। অথচ এদের ফতোয়া দেওয়ার এখতিয়াত নেই। সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা উচিত।’

প্রসঙ্গত,কুষ্টিয়ায় নারীদের মাঠে যাওয়া নিয়ে ফতোয়ার ঘটনায় এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছে ছয় ফতোয়াবাজ।

সারাবাংলা/ইএইচটি/আইজেকে/জেডএফ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

সিনিয়র সাংবাদিক বদিউল আলম আর নেই
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৬:৩১

সম্পর্কিত খবর