‘রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি না থাকায় পাস হচ্ছে না তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন’
১৮ নভেম্বর ২০২৩ ২০:৫৬
ঢাকা: রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে সংশোধিত ধূমপান এবং তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইনটি পাস হচ্ছে না। পাশাপাশি তামাকজাত পণ্য তৈরিকারী কোম্পানিগুলোও নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে।
শনিবার (১৮ নভেম্বর) বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘নারী মৈত্রী’র আয়োজনে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করার লক্ষ্যে গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা উঠে আসে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ আলোচক ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস বাংলাদেশ (সিটিএফকে)’র প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. আব্দুস সালাম মিয়া বলেন, ‘তামাকের পক্ষে বলার মতো একটি শব্দও নেই। তামাক পরিবেশ, অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। টোব্যাকো এটলাস ২০১৮- এর তথ্য মতে তামাক ব্যবহারজনিত রোগে প্রতিবছর বাংলাদেশে ১ লক্ষ ৬১ হাজার মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মানে প্রতিদিন ৪৪২ জন মানুষ প্রাণ হারান। জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় ও জীবন রক্ষায় দ্রুততম সময়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করতে হবে এখনই। আইন শক্তিশালী করবার এই পদক্ষেপ বেগবান করতে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করতে পারেন আমাদের গণমাধ্যমের বন্ধুগণ,যাদের সবচেয়ে বড় শক্তি তাদের লেখনি ও গণমাধ্যম ব্যবহার করে মানুষের কাছে পৌছানোর কৌশল।’
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি না থাকায় তামাক বিরোধী আইন পাস হচ্ছে না। বরং সংসদে সিগারেটের পক্ষে লবিং করা হয়।’
তাছাড়া প্রয়োগ না করলে আইন দিয়েও বা কী হবে? আইন তো আগেও ছিল। তামাকে ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার কথা থাকলেও দেখা যাচ্ছে সর্বোচ্চ করদাতা হিসেবে বিড়ি উৎপাদক গাউস মিয়াকে সম্মাননা দেওয়া হয়। আইন পাসের জন্য সামগ্রিক সুশাসন জরুরি।
আরেক বিশেষ অতিথি প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হোসেন বলেন, ‘সরকার চাইলে অতি দ্রুত আইন পাস করা হয়, যার প্রমাণ আমরা দেখেছি সাইবার নিরাপত্তা আইনের সময়। আমাদের তামাকের ভয়াবহতা সম্পর্কে আরও সোচ্চার হতে হবে। পাশাপাশি তামাক কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করতে হবে।’
প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি)র অধ্যয়ন ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক শাহ শেখ মজলিশ ফুয়াদ বলেন, ‘তামাকের কারণে সৃষ্ট রোগ ও মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য। সেটি তখনই সম্ভব যদি বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করা হয়। তাই আমাদের একটাই দাবি আগামী প্রজন্মকে বাঁচাতে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করা হোক।’
তামাক কোম্পানিগুলো নানামুখী অপ-কৌশলে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে এপি’র ঢাকা ব্যুরো প্রধান জুলহাস আলম বলেন, ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের অধিকতর সংশোধনী আনার যে উদ্যোগ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় নিয়েছে তা নিঃসন্দেহে একটি সময়োচিত এবং জনবান্ধব উদ্যোগ। তবে বেশ কিছু ধাপ পার হলেও আইনটিকে চূড়ান্ত রূপ পেতে হলে আরও কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করতে হবে। এখনও এটি পাসের অপেক্ষায় রয়েছে। এটিকে আইনে রূপান্তরের পথে নানা রকম বাধা আসার আশঙ্কা রয়েছে, বিশেষ করে সংশোধনীর বিপক্ষে তামাক কোম্পানিগুলো নানামুখী অপ-কৌশল ও অপ-তৎপরতা চালাচ্ছে। তারা নানা বিভ্রান্তিমূলক তথ্য মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার করে জনবিভ্রান্তি তৈরি করছে। এক্ষেত্রে আমাদের সাংবাদিক বন্ধুদেরকে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে।’
ঢাকা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক রিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘একটা সময়ে নিউজরুম, অফিসকক্ষ, পাবলিক প্লেসে ধুমপান অনেক স্বাভাবিক ছিল। এখন তা কমে এসেছে। অনেককিছুই বলা হয় কিন্তু বাস্তবে কতটুকু মানা হয় সেটিই বিবেচ্য। আর তার জন্য আইন ও পলিসি তৈরির আগে আমাদের মতামত নিতে হবে।’
নারী মৈত্রীর তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে ডিবিসি টেলিভিশন সম্পাদক প্রণব সাহা বলেন, ‘তামাক অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে শুধু অবগত হলেই চলবে না, যার যার অবস্থান থেকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে যাতে করে আইন শক্তিশালীকরণের পদক্ষেপ বেগবান হয়।’
দৈনিক সমকালের প্রধান প্রতিবেক লোটন একরাম বলেন, ‘তামাকের ভয়াল ছোবল থেকে আমাদের সন্তান এবং প্রিয়জনকে রক্ষা করতে সিগারেট এর খুচরা বিক্রি বন্ধ করা সত্যিই প্রয়োজন, সেই সঙ্গে প্রয়োজন এর দাম বাড়িয়ে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া যেন তা আমাদের সন্তাসহসহ সবার নাগালের বাইরে চলে যায়। এ জন্য আমাদের একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।’
জাতীয় প্রেস ক্লাবের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য শাহনাজ বেগম পলি বলেন, ‘তামাক নীরব ঘাতক আমরা বলি কিন্তু এর অর্থনৈতিক, সামাজিক, ও পারিবারিক প্রভাব জোরালোভাবে উঠে আসে না। ধুমপান করলে ক্যানসার হয় সবাই বলে কিন্তু সেটির বাস্তবতা আমরা অনুধাবন করি না। তাই ধূমপান প্রতিরোধে ঘরে ঘরে সচেতনতা তৈরিতে উদ্যোগ নিতে হবে।’
হেলথ রিপোর্টার্স ফোরাম এর সভাপতি রাশেদ রাব্বি বলেন, ‘তামাক জনস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। শ্বাসকষ্ট, ক্যানসার, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকসহ নানান রকম জটিল রোগের সৃষ্টি হয় তামাক সেবনের কারণে। তামাক সেবন না করেও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে অধূমপায়ীরা। তাই জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে সব ধরনের ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান নিষিদ্ধ করা উচিৎ। সেক্ষেত্রে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করার পাশাপাশি এসব রোগের কারণে দেশে কত মানুষ আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণ করছে তার কোনো জরিপ হয় না। আমরা বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার জরিপের ওপর নির্ভর করি যা দেশের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে না।’
সভাপতির বক্তব্যে নারী মৈত্রীর নির্বাহী পরিচালক শাহীন আকতার ডলি বলেন, ‘বর্তমানে তরুণরা ই-সিগারেট এর প্রতি বেশি আসক্ত হয়ে পড়ছে। তাদের এই আসক্তি থেকে বের করে আনতে ই-সিগারেট বাজারজাত বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরি। শুধু তাই নয় বন্ধ করতে হবে সিগারেট এর খুচরা শলাকা বিক্রি। পাশাপাশি তামাকজাত পণ্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর আকার ৫০% থেকে ৯০% এ বৃদ্ধি করা এবং বিক্রয় স্থানে তামাকজাত দ্রব্যের প্রদর্শন বন্ধ করতে হবে।’
প্রধান অতিথি জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল (এনটিসিসি) এর সমন্বয়কারী (অতিরিক্ত সচিব) হোসেন আলী খোন্দকার বলেন, ‘তামাকের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি বিষয়ে সাধারণ মানুষকে অবহিত করতে হবে। তামাক থেকে সরকারের যে রাজস্ব আয় আসে তার চেয়ে তামাক ব্যবহারজনিত কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা বাবদ ব্যয় ২৭% বেশি। রাজস্ব আয় প্রায় ২২ হাজার ৮১০ কোটি এবং চিকিৎসা ব্যায় প্রায় ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। তামাকের কারণে বার্ষিক ক্ষতি প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা (ক্যান্সার সার্ভে-২০১৮)। সুতরাং মানুষের ভ্রান্ত ধারণা দূর করার পাশাপাশি প্রয়োজন তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করা। তামাকের বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে।’
অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নারী মৈত্রীর প্রোজেক্ট কো-অর্ডিনেটর নাছরিন আকতার। এ ছাড়াও সভায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।
সারাবাংলা/আরএফ/একে