Friday 05 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘দাপুটে’ লন্ডনপ্রবাসীকে ছায়া দিয়ে বিতর্কে চট্টগ্রামের ডিআইজি


৬ জুন ২০১৮ ১২:২৯
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লন্ডনপ্রবাসী এক যুবকের পক্ষ নিয়ে জমিজমার বিরোধে জড়িয়ে বিতর্কে পড়েছেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি এস-এম-মনিরুজ্জামান।

চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার দক্ষিণ সারোয়াতলী গ্রামের বেশ কয়েকজন নারীপুরুষ ইতোমধ্যে ইয়াবা-অস্ত্র আইনেসহ বিভিন্ন মামলার আসামি হয়েছেন। কাউকে কাউকে জেলেও যেতে হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, ডিআইজির ইন্ধনে পুলিশ ও লন্ডনপ্রবাসী সঞ্জয় দাশ মিলে তাদের বিভিন্ন মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছেন।

এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হওয়ার পরও থামছেন না ডিআইজি। বরং নিজের অনড় অবস্থানের কথা জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘লন্ডনপ্রবাসী যুবকের জমি তিনি উদ্ধার করবেনই। প্রতিবাদ হলেও তিনি কারও কাছে মাথা নত করবেন না।’ যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তারা সবাই অপরাধী বলেও মন্তব্য করেছেন এই ডিআইজি।

বিজ্ঞাপন

গত ২৭ মে চট্টগ্রাম নগরী থেকে সমর চৌধুরী নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে বোয়ালখালী থানা পুলিশ। পরে দক্ষিণ সারোয়াতলী গ্রামে তার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ৩৬০ পিস ইয়াবা ও একটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয় বলে পুলিশ দাবি করে। ষাটোর্দ্ধ সমর চৌধুরী চট্টগ্রাম আদালতে আইনজীবীর সহকারী হিসেবে কাজ করেন। সমর চৌধুরীর কাছ থেকে ইয়াবা ও অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। প্রতিবাদে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ। মূলত তখন থেকেই লন্ডনপ্রবাসী সঞ্জয় দাশের বিষয়টি গণমাধ্যমে উঠে আসে।

সমর দাশের মেয়ে অলকানন্দা চৌধুরী অভিযোগ করেন, তাদের গ্রামের স্বপন দাশ ও লন্ডনপ্রবাসী সঞ্জয় দাশের মধ্যে জমি নিয়ে বিরোধ আছে। সমর স্বপন দাশকে আইনি সহায়তা দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে সঞ্জয় পুলিশকে ব্যবহার করে প্রথমে সমরকে একটি মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে দেন। এরপর গ্রেফতার করিয়ে অস্ত্র আইনে এবং আরও একটি ইয়াবা উদ্ধারের মামলায় ফাঁসিয়ে দেন।

এ বিষয়ে স্বপন দাশের সঙ্গে সারাবাংলার কথা হয়। তিনি জানান, জমিজমা নিয়ে বিরোধের জেরে গত বছরের ১ মে ডিআইজি এস-এম-মনিরুজ্জামানের অফিসে দু’পক্ষে বৈঠক হয়। সেখানে সঞ্জয়ের জমি ফেরতের কথা বলা হলে স্বপন দাশ আদালতের মাধ্যমে আইনগতভাবে মিমাংসায় রাজি হন। কিন্তু এরপর থেকে তাদের উপর হয়রানি শুরু হয়। একের পর এক পাঁচটি মামলা দায়ের হয়। এর মধ্যে ইয়াবা উদ্ধারের মামলাও আছে। এসব মামলায় গ্রেফতার হয়ে তিনি তিন মাস জেল খাটেন।

এসব মামলায় স্বপন দাশের সঙ্গে তার দুই ভাই রুপন দাশ ও দীপক দাশ গোপন, তাদের বড় ভাইয়ের ছেলে উৎপল দাশ, গোপনের ছেলে রিকি দাশ, স্বপনের ছেলে তন্ময় দাশ, স্বপনের মেয়ের জামাই অভিজিৎ দাশ ও তার বাবা প্রদীপ দাশকে আসামি করা হয়।

এছাড়া স্বপন দাশের ঘরে আশ্রিত দিনমজুর শংকর দত্ত মদনকে গ্রেফতার করে পকেটে ৮০ পিস ইয়াবা দিয়ে মামলা দেওয়া হয়। ওই মামলায় আসামি হিসেবে আছেন স্বপন দাশ এবং সর্বশেষ গ্রেফতার হওয়া সমর চৌধুরীও। মদনের স্ত্রী মঞ্জু দত্তকে লাকড়ি চুরি ও হত্যাপ্রচেষ্টার অভিযোগে দুটি মামলা দিয়ে গ্রেফতার করে জেলে নেওয়া হয়। মঞ্জুর ভাই পংকজ চৌধুরীকেও গ্রেফতার করে জেলে নেওয়া হয়।

বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সুরেশ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘শংকর দত্ত ইয়াবা ব্যবসা দূরে থাক, জীবনে কোনদিন ইয়াবা চোখে দেখেছেন কি না সন্দেহ আছে। মঞ্জু দত্তের মতো একজন সাধারণ গৃহবধূর বিরুদ্ধে কেন মামলা দেওয়া হল? সমর চৌধুরী, স্বপন দাশ উনারা সমাজে ভদ্র মানুষ হিসেবে পরিচিত। অথচ উনাদেরও ইয়াবা মামলার আসামি করা হল। সবকিছু হয়েছে সঞ্জয় দাশের ইন্ধনে। সঞ্জয় গ্রামে গিয়ে ডিআইজির কথা বলে সবাইকে হুমকিধমকি দেন।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে মঙ্গলবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সারাবাংলার সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেন ডিআইজি এস-এম-মনিরুজ্জামান।

সঞ্জয়ের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে ডিআইজি মনিরুজ্জামান বলেন, ‘বৃটিশ হাইকমিশনার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে ফোন করে সঞ্জয়কে সহযোগিতার কথা বলেছিলেন। মন্ত্রী আমাকে বলেছেন। এরপর সঞ্জয় আমার কাছে এসে বলেন, তার মায়ের শ্মশানের জায়গা পর্যন্ত প্রতিবেশী এক খারাপ লোক দখল করে ফেলেছে। সে উদ্ধার করতে গেলে তাকে কেটে টুকরো টুকরো করার হুমকি দিয়েছে। এরপর আমি দুইপক্ষ নিয়ে বৈঠক করে বলেছিলাম, সঞ্জয়দের জায়গাজমি যেন দখল করা না হয়। দখল করা জমি যেন ফেরত দেওয়া হয়।’

সারোয়াতলী গ্রামের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সঞ্জয় গ্রামে গেলে তার নিরাপত্তায় থাকে সাতজন পুলিশ সদস্যের একটি টিম। এছাড়া সঞ্জয় দাশ বাংলাদেশে আসার পর থেকে চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহরে জেলা পুলিশ লাইনে রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্সের রেস্টহাউজে তার থাকার ব্যবস্থা করেছেন ডিআইজি।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে ডিআইজি তাকে পুলিশের রেস্টহাউজে রাখার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘যেহেতু তাকে কেটে টুকরো টুকরো করার হুমকি দেওয়া হয়েছে, সেজন্য আমিই তার থাকার ব্যবস্থা করেছি। তাকে পুলিশের নিরাপত্তা দিয়েছি। একজন বিদেশি নাগরিক হিসেবে তার নিরাপত্তার বিষয়টা খুব সেনসিটিভ হওয়ায় আমাকে এই পদক্ষেপ নিতে হয়েছে।’

স্বপন দাশের অভিযোগ, সঞ্জয় দাশ তাদের বসতভিটাসহ অধিকাংশ জায়গা-জমি পুলিশের উপস্থিতিতে জোরপূর্বক দখল করে নিয়েছে। সঞ্জয় ও পুলিশের ভয়ে তারা এখন বাড়িতেও যেতে পারছে না।

এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিআইজি বলেন, ‘আমি নিজে তাদের (সঞ্জয়ের প্রতিপক্ষ) বোঝানোর চেষ্টা করেছি। আমি ব্যর্থ হয়েছি। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা শ্যামল কুমার পালিত এবং একজন সাংবাদিককে দায়িত্ব দিয়েছিলাম। তারাও ব্যর্থ হয়েছেন। আপোষ মিমাংসার মাধ্যমে জমি উদ্ধারে সঞ্জয় ব্যর্থ হয়েছে। এরপর কিছু হয়ত হয়েছে।’

জানতে চাইলে শ্যামল কুমার পালিত সারাবাংলাকে বলেন, বছরখানেক আগে সঞ্জয় দাশের সঙ্গে আমার একবার কথা হয়েছিল। এরপর আমি বিষয়টি নিয়ে কখনও মাথা ঘামায়নি। ডিআইজি সাহেবও আমাকে কখনো এই ধরনের দায়িত্ব দেননি।
ডিআইজি’র দাবি- সঞ্জয় দাশের প্রতিপক্ষ স্বপন দাশরাও তার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা দিয়েছে। এমনকি ৫০ বছরের এক নারীকে ধর্ষণের মামলাও দিয়েছে। সঞ্জয় জায়গা-জমি ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিলেন। মামলা করার কারণে তিনি বাংলাদেশ ছাড়তে পারছেন না।

তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, সঞ্জয় দাশের বিরুদ্ধে গত এক বছরে ধর্ষণের অভিযোগে কোন মামলা হয়নি। শংকর দত্তের স্ত্রী মঞ্জু দত্ত তাকে মারধর করার অভিযোগে নারী নির্যাতন আইনে একটি মামলা করেছিলেন। পুলিশ গ্রহণ না করায় আদালতে তাকে মামলা করতে হয়েছিল।

কিন্তু শংকরকে গ্রেফতার করে ইয়াবা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তাকে সেই নারী নির্যাতন মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়েছে বলে সারাবাংলাকে জানিয়েছেন মঞ্জু দত্ত।

সাধারণ মানুষকে ইয়াবা-অস্ত্র আইনেসহ বিভিন্ন মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে ডিআইজি সারাবাংলাকে বলেন, ‘এরা কেউ নিরীহ নয়। এরা সবাই পেশাদার অপরাধী। অপরাধ করে কেউ কি নিজে স্বীকার করে? কাউকে ফাঁসানো হয়নি।’

গ্রামের মানুষ তাদের বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসার কোন অভিযোগ করেনি, এমন প্রসঙ্গে ডিআইজি বলেন, ‘ইয়াবা-অস্ত্র পেয়েছে বলেই পুলিশ মামলা দিয়েছে।’

সঞ্জয়ের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে ডিআইজি বিতর্কিত হয়ে পড়ছেন কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যা-ই বলুক। একটা খারাপ লোকের গ্রুপ চাচ্ছে, সঞ্জয়কে তার জমিগুলো ফেরত না দিতে। আমি জমিগুলো উদ্ধার করবই। আমি ডিআইজি। কারও কাছে মাথা নত করব না।’

তবে দক্ষিণ সারোয়াতলী গ্রামে আলোচনা আছে, সঞ্জয় দাশ জোরপূর্বক জমিগুলো উদ্ধার করতে পারলে গ্রাম্য একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট তার কাছ থেকে সেগুলো ক্রয়সূত্রে দখল করবেন। সেখান থেকে পাওয়া বড় অংকের টাকার ভাগবাটোয়ারার লোভেই পুলিশের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছেন সঞ্জয়।

এসব বিষয়ে সঞ্জয় দাশের সঙ্গে কথা বলার জন্য বারবার মোবাইল ফোনে চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

সারাবাংলা/আরডি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর