আমাকে মেরে ফেলা হবে কিনা সে নিয়ে তর্ক হয়েছে
২২ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৪:০৫
সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা: রাজধানীর নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মুবাশ্বার হাসান বলেছেন, তাকে একটি অন্ধকার ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল। নিখোঁজের ৪৪ দিন পর গত রাতে নিজের বাসায় ফেরার পর শুক্রবার দুপুরে সাংবাদিকদের এ কথা জানান এই শিক্ষক ও গবেষক। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
সিজার বলেন, `আমাকে মেরে ফেলবে কি ফেলবে না, সে নিয়ে অপহরণকারীরা নিজেদের মধ্যে তর্কও করেছে।’
এর আগে বৃহস্পতিবার রাত ১টার দিকে একটি সিএনজি অটোরিকশা যোগে বনশ্রীতে নিজের বাসায় ফেরেন সিজার।
মুবাশ্বার হাসান সাংবাদিকদের জানান, অপহরণকারীরা টাকার জন্য অপহরণ করেছিল। তুলে নেওয়ার পর তারা আমার কাছে থাকা নগদ ২৭ হাজার টাকা নিয়ে নেয়। সে সময় তারা বলে, ‘তোর ফ্যামিলিতে টাকাওয়ালা আর কে কে আছে, তাদের নাম বল, ওনাদের কাছ থেকে টাকা চেয়ে নেব।’ তখন আর কারো নাম বলতে পারিনি- যোগ করেন সিজার।
অপহরণের দিনের ঘটনা বর্ণনায় তিনি বলেন, ৭ নভেম্বর আগারগাঁওয়ে এটুআই প্রোগ্রাম শেষে রোকেয়া সরণিতে মোবাইল ফোনে উবারের একটি গাড়ি ডাকি। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই গাড়ি চলে আসে। গাড়িতে উঠে বসেছিলাম মাত্র। এমন সময় কয়েকজন লোক এসে বলেন, ‘এই গাড়িটি চোরাই গাড়ি। এটাতে উঠবেন না।’ তখন আমি ওই গাড়ি থেকে নেমে যাই। নেমে আরেকটা গাড়ির জন্য অপেক্ষা করি। এমন সময় মলমের মতো কীসের যেন একটা গন্ধ নাকে আসে। এরপর আর কিছু বলতে পারি না। এর একদিন পর জ্ঞান ফিরলে দেখি, আমার চোখ বাঁধা আর একটা অন্ধকার ঘরে আটকে আছি।
আবদ্ধ ঘরের বর্ণনা দিতে গিয়ে মুবাশ্বার বলেন, ‘রুমটি বেশি বড় নয়। পাশে একটি বাথরুমও আছে। একটা ময়লা তোষক মেঝেতে ফেলা আছে। ওই তোষকেই ঘুমাতাম। একটি জানালা থাকলে তাও একেবারই বন্ধ করে দেওয়া। পাশে মনে হচ্ছিল আরও এ রকম রুম ছিল। কারণ পাশ থেকে কথা শোনা যাচ্ছিল। একজন খাবার নিয়ে এলেও মুখোশ পরে থাকত। কাউকে দেখতে পারিনি ‘
অপহরণকারীদের বিষয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, ‘অনেক দূর থেকে আওয়াজ আসছিল তাদের। তারা একে অন্যের সঙ্গে তর্ক বিতর্ক করত। কেউ বলে টাকা না দিলে একে মেরে ফেলা হোক। আবার কেউ বলে না তাকে মারা যাবে না। শেষ পর্যন্ত আমাকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, কারণ ওই সময় ওদের একটা লোক মিসিং ছিল বলে মনে হচ্ছিল।’
বিভীষিকাময় ওই সময়ের বর্ণনা দিয়ে বাংলাদেশের জঙ্গি নিয়ে গবেষণা করা এই গবেষক বলেন, যতদিন বন্দী ছিলাম ততদিন ঘুমাতে পারিনি। প্রথম দিকে টর্চার করলেও পরে আর করেনি। ভাবতেও পারিনি আমি প্রাণে বেঁচে ফিরব। পরিবারের কাউকে আবার দেখতে পারব এমন চিন্তাও করিনি। আমার একমাত্র মেয়ে আরিয়ানাকে বার বার মনে পড়ত। আমার মোবাইল ফোনটা কেড়ে নিয়েছিল প্রথম দিনেই। চোখ বেঁধে নিয়ে গেছে আবার চোখ বেঁধেই ফেলে দিয়ে যায় ‘
কীভাবে ঘটল ফেরতের ঘটনা, তার ব্যাখ্যায় মুবাশ্বার বলেন, “হঠাৎ করে একজন বকবক করতে করতে এসে আমার চোখ দুটো বেঁধে ফেলেন। বলেন, ‘এই চল, তুই বাড়িতে যাবি। যেভাবে বলব সেভাবে নেমে যাবি।’ একটি গাড়িতে তুলে কয়েক ঘণ্টা ঘুরে বেড়ায়। এরপর নামিয়ে দেওয়ার সময় বলেন, ‘পেছনে তাকাবি না। নেমে সোজা বাড়ি চলে যাবি।’ চোখ খুলে দেখি তিনি এয়ারপোর্টের রাস্তায়। পকেটে কোনো টাকা না থাকায় সিএনজি ভাড়া করে বাসায় আসি। এরপর বাবাকে ফোন করলে টাকা নিয়ে বাবা নিচে নামেন।”
মুবাশ্বার আরও বলেন, “অনেক দিন পর আজ সূর্যের আলো দেখলাম। বন্ধু, আত্মীয় স্বজন পরিবার পরিজন সবাই আমার জন্য অনেক করেছেন। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এটা যে কত দুঃখ-বেদনাময় কিডনাপ না হলে কেউ তা বুঝতে পারবে না।” এসময় সাংবাদিকদেরও ধন্যবাদ জানান তিনি।
মুবাশ্বারের বোন তামান্না তাসনিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ফিরে আসার পর থেকেই সিজার শুধুই ঘুমাচ্ছেন। ঘুমের মধ্যেও বার বার লাফ দিয়ে উঠছেন। শারীরিকভাবে অতটা অসুস্থ না হলেও মানসিকভাবে খুব বেশি ভেঙে পড়েছেন মনে হচ্ছে। একটু গুছিয়ে নিয়েই তাকে চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তাসনিম বলেন, ‘কারও বিরুদ্ধে আমাদের আর কোনো অভিযোগ নেই। ভাইকে ফিরে পেয়েছি এর চেয়ে বেশি কিছু চাই না।’
মুবাশ্বার নিখোঁজের পর ৭ নভেম্বর রাতে বাবা মোতাহার হোসেন জিডি করেছিলেন। মুবাশ্বার ফিরে আসায় জিডির তদন্তকারী কর্মকর্তা খিলগাঁও থানার এসআই নগেন্দ্র কুমার রায় বাসায় গিয়ে মুবাশ্বারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এসআই নগেন্দ্র কুমার রায় সারাবাংলাকে বলেন, ‘৭ নভেম্বর আনুমানিক সাড়ে ৬টার দিকে তাকে কয়েকজন লোক তুলে নিয়ে যায়। এরপর গতকাল রাতে বাসায় ফিরে আসেন। এর মধ্যে যা কিছু ঘটেছে তার বর্ণনা পুলিশকে দিয়েছেন। উনি যা তথ্য দিয়েছে তা যাচাইয়ের মাধ্যমে তদন্ত করা হবে।’
এক সপ্তাহের ব্যবধানে সাংবাদিক উৎপল দাস ও শিক্ষক মুবাশ্বার হাসান সিজার নিখোঁজের পর ফিরে এলেন। তার আগে গত মাসে অনিরুদ্ধ রায় নিখোঁজ থাকার পর বাসায় ফিরে আসেন। তবে সাবেক কূটনীতিক মারুফ জামান নিখোঁজের প্রায় মাস খানেক হতে চললেও এখনো তার কোনো খোঁজ মেলেনি। এদিকে সম্প্রতি যারা ফিরে এসেছেন তাদের প্রায় একই রকম বক্তব্য পাওয়া গেছে— টাকার জন্য নিয়ে গেছে, টাকা চেয়েছে; চোখ বাঁধা অবস্থায় নিয়ে গেছে, আবার একইভাবে ফেলে দেওয়া গেছে।
সারাবাংলা/উউজে/এমএম/আইজেকে