চট্টগ্রাম ব্যুরো: জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের তাদের দলের নাম পরিবর্তন করে রাজনীতি করার অনুরোধ করেছেন কবি ও রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহার।
শনিবার (১৯ জুলাই) দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি জামায়াতের নেতাদের উদ্দেশে এ কথা বলেন।
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী দলটাকে আমি অসম্ভব পছন্দ করি, অসম্ভব ভালোবাসি তাদের নেতাদের। তাদের প্রথমদিন থেকেই বলেছি যে, ভাই আপনারা কিন্তু বাহাত্তর সালের পরে আপনাদের জামায়াত ইসলামী নামটা রেখে দিয়েছেন, এটা অন্যায় হয়েছে। কারণ একাত্তর সালে আপনাদের যে ভূমিকা, এটা বাংলাদেশ নামে যে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, সেই স্পিরিটের পক্ষে যায় না।’
জামায়াত নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘ইসলামী আইডোলজি থেকে ডেমোক্রেটিক লীগ করেছিলেন, তারপর আবার জামায়াতে ইসলামী নামে কেন ফেরত আসলেন ? আমাদের অপমান করার জন্য ? আপনি যদি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে ক্রমাগত অপমান করতে থাকেন, আপনি আবারও কিন্তু শেখ হাসিনাকে আনবেন। আপনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অপমান করলে ওই ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাই কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবেন।’
‘এখনও আপনাদের আমি বিনয়ের সঙ্গে বলি, হাতজোড় করে বলি- এটা খুব ভালো সময় জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে, আপনারা আপনাদের নামটা পরিবর্তন করেন। এটা প্রথমত বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে একটা বাধা, দ্বিতীয়ত ইসলামের প্রতি তরুণদের যে আগ্রহ আর চেতনা সেক্ষেত্রেও এটা বাধা হয়ে আছে। আপনাদের একাত্তর সালের ভূমিকার জন্য লোকজন ইসলামকে দায়ী করে। এটা আমাদের নিজেদের গঠনের ক্ষেত্রেও মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে।’
ইসলাম উদার এবং মানবতাবাদী একটা ধর্ম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে অনেকে আছেন যারা মনে করেন গান-বাদ্য করা হারাম। অনেক প্রাজ্ঞ ব্যক্তি আছেন, তারা আমাকে বলেন যে- কোরআনের কোন সূরার মধ্যে আছে গান-বাদ্য করা হারাম ? এই যে কথাটা বলা হয়, এর উত্তর বাংলাদেশে বহু আগে দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রামে যতগুলো মাজার আছে, দুই-একটা ছাড়া আর যে মাজারেই আপনি যাবেন, সেখানেই বলা হয়, গান-বাদ্য করা হারাম, আমরা গান করতে পারবো না। কোথায় পেয়েছেন এসব?’
‘ফতোয়া দিতে পারেন, ইসলামে ফতোয়া দেবার অধিকার আছে, কিন্তু সেটাকে প্রয়োগ করবার অধিকার ইসলাম দেয়নি। এই যে, গণঅভ্যুত্থানের পরে আমাদের দেশে যতগুলো মাজার ভাঙ্গা হয়েছে, তার বিচার কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করেনি, ড. ইউনুস করেননি। টেলিভিশনে তো প্রকাশ্যে বলা হয়েছে, যারা আমাদের কথা শোনে না, তাদের হত্যা করবো। এদেরকে তো গ্রেফতার করা হয়নি।’
চট্টগ্রাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য হারিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই চট্টগ্রাম একটা আদর্শ ছিল। মহেশখালীতে একটা মন্দির আছে, যেখানে এখনও শিবলিঙ্গে মুসলমান বাড়ির গরুর দুধ দিতে হয়। কিন্তু আমরা দেখছি সেই চট্টগ্রামে এখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নেই। অবাক করার মতো ব্যাপার। এখানে এখন গেরুয়া বসন দেখলে আমরা বলি, এটা সন্ত্রাসী। একটা সনাতন ধর্মাবলম্বী, তাকে কিন্তু বলা হচ্ছে ভারতের দালাল। আগে মুসলমান দেখলে জঙ্গি বলা হতো, আমেরিকানরা এটা শিখিয়ে দিয়েছিল।’
‘আপানারা কিন্তু সেটাই আবার চর্চা করে যাচ্ছেন যে, একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী মানেই ভারতের দালাল, দিল্লীর দালাল, র-এর এজেন্ট। এই চট্টগ্রামকে তো আমি চিনি না। এই চট্টগ্রাম থেকেই অনেকক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয়েছে। গত ১৬-১৭ বছরের যে ফ্যাসিস্ট সরকার, এর প্রভাব সেটা এখনও রয়ে গেছে।’
সেক্যুলার এবং ধর্মীয়- উভয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা- এ তিনটির বিরুদ্ধে লড়াই হয়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে। এ লড়াই কিন্তু শেষ হয়নি। ফ্যাসিবাদের নানারকম চরিত্র আছে। তার একটি সেক্যুলার চরিত্র আপনারা দেখেছেন। তার ভিন্ন আরেকটি চরিত্র হতে পারে, যেটা ধর্মের নামে। এর বাইরে আরও নানারকম বাহানা নিয়ে ফ্যাসিবাদ আসতে পারে। সুতরাং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সকল ধরনের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে- সেটা হোক সেক্যুলার ফ্যাসিবাদ কিংবা ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ। আবু সাঈদ-মুগ্ধ, এরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে জীবনটা দিয়েছে।’
‘সাংবাদিকদেরও মনে রাখতে হবে যে, ফ্যাসিবাদ মানে শুধু সেক্যুলার ফ্যাসিবাদ নয়, একইসঙ্গে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদও আছে। আমাদের সেক্যুলার এবং ধর্মীয়- সব ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। এরপর ফ্যাসিবাদ যে বিভিন্ন শক্তিরূপে হাজির হয়, তাদের এক্সপোজ করা, তাদের ধরিয়ে দেয়া- এটা করতে হবে। আমাদের যে ধর্মবিশ্বাস, আমাদের যে ধর্মীয় ঐতিহ্য, এটাকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে হাজির করতে হবে, পরকালের চর্চা দিয়ে নয়। ধর্ম আমাদের কি কি শেখায় ? আমরা যেন নৈতিক হই, আমরা যেন নৈরাজ্যবাদী না হই, অপরের প্রতি বে-ইনসাফি না হয়। ইসলামে সাম্য বলে একটা ধারণা আছে। ইসলামে মানবিক মর্যাদা, ইনসাফ বা ন্যায়বিচারের ধারণা আছে। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাই তো ছিল- সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার।’
বাংলাদেশে আর কখনো ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা যেন ফিরে না আসে, সেজন্য নতুন গঠনতন্ত্র প্রনয়ণের লড়াইয়ে সাংবাদিকদের অগ্রণী ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘সাংবাদিকদেরও উচিৎ একথাটা জোরেশোরে তোলা যে, একটা নতুন গঠনতন্ত্র বাংলাদেশে লাগবেই। এর বিরুদ্ধে যারা বলে, তারা পুরনো ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে চায়। সাংবাদিকদের এখন প্রধান কাজ হচ্ছে জনগণকে বোঝানো যে, আমাদের একটা নতুন গঠনতন্ত্র লাগবে যাতে আর কখনো ফ্যাসিবাদ না আসে, আর কখনো ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রশক্তি না আসে, টুপি-দাড়ি পরা লোক দেখলে যেন জঙ্গি বলা না হয়, কোনো সনাতন ধর্মাবলম্বীকে দেখলেই যেন ভারতের দালাল বলা না হয়, নাগরিক অধিকারটা সবার একই হবে।’
বিএনপির নির্বাচন দাবির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইউনূসের যে সরকার, এটাও কিন্তু নির্বাচিত সরকার। অনেকেই বলেন- না, এটা নির্বাচিত সরকার নয়, ভোট দিলেই নির্বাচিত সরকার হবে। তাহলে রক্ত দিয়ে কি নির্বাচিত সরকার হয় না ? রক্ত দিয়েই তো জনতা ইউনূসের সরকারকে নির্বাচিত করেছে। কিন্তু তারা বলে শুধু নির্বাচন আর নির্বাচন মানেই পুরনো সংবিধান অর্থাৎ হাসিনা থেকে যাবে। আমি বিএনপির বিরোধিতা করছি না, তাদের সততার সঙ্গে বোঝানোর চেষ্টা করছি। আমি বিএনপির বড় বড় নেতাদের সামনে বলেছি, কাল যদি নির্বাচন দিয়ে আপনাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়া হয়, আপনাদের মতো মন্ত্রী হওয়ার লোকও নেই। আগে আপনারা দলকে গোছান। আমাদের সামনে এখন প্রধান কর্তব্য কি- একটা গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা।’
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যারা বাইরের দেশের স্বার্থ রক্ষা করে, তারা কিন্তু সাংবাদিক না, এটা একদম পরিস্কার থাকা দরকার। সাংবাদিকদের মধ্যে যারা ফ্যাসিবাদের দোসর, আমাদের কাজ হচ্ছে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাদের চিন্তার পরিবর্তন করা অথবা তাদের সঙ্গে পলিটিক্যাল ফাইটে যাওয়া। জুলাই অভ্যুত্থানের পরে আমাদের কর্তব্যটা বুঝতে হবে।’
চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে না দিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করার তাগিদ দেন ফরহাদ মজহার।
মতবিনিময় সভায় আরও বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মঈনুদ্দিন কাদেরী শওকত, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুল হক, অধ্যাপক আর রাজী ও সহকারী অধ্যাপক সাইমা আলম, অবসরপ্রাপ্ত মেজর মো. ফেরদৌস, দৈনিক কালের কণ্ঠের ব্যুরো প্রধান মুস্তফা নঈম, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সালেহ নোমান, বাসসের জ্যেষ্ঠ্য সাংবাদিক মিয়া মোহাম্মদ আরিফ, দৈনিক এই বাংলার নির্বাহী সম্পাদক ওয়াহিদ জামান এবং বৈশাখী টিভির ব্যুরো প্রধান গোলাম মওলা মুরাদ।