Friday 28 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বেরোবিতে ছাত্রলীগ কর্মীদের নিয়ে ছাত্রদলের কমিটি

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২৮ নভেম্বর ২০২৫ ১৬:২৮

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি)। ছবি: সারাবাংলা

রংপুর: রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। প্রতিষ্ঠার ১৭ বছর পর প্রথমবারের মতো ছাত্রসংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির মধ্যে এই কমিটি ঘোষণা ক্যাম্পাসে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। তবে এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শিক্ষার্থীরা বলছেন, রাজনীতি নিষিদ্ধ ক্যাম্পাসে দলীয় কমিটি গঠন হলে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে।

বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির স্বাক্ষরিত ১১ সদস্যের এই কমিটিতে সভাপতি করা হয়েছে মো. ইয়ামিনকে এবং সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে মো. জহির রায়হানকে। কিন্তু কমিটি ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ক্যাম্পাসে ঝড় উঠেছে। ‘ছাত্রলীগের কর্মী দিয়ে ছাত্রদলের কমিটি’-অভিযোগে এই কমিটি প্রত্যাখ্যান করেছেন বঞ্চিত নেতারা। শিক্ষার্থীরা বলছেন, রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও এভাবে দলীয় কমিটি দেওয়া প্রশাসনের নীরব সমর্থন ছাড়া সম্ভব নয়।

বিজ্ঞাপন

কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের চিঠিতে বলা হয়েছে, আগামী ৩০ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে হবে। কমিটির অন্যান্য পদে রয়েছেন— সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. মাইদুল ইসলাম বাপ্পি, সহ-সভাপতি মো. তুহিন রানা, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. রিফাত হোসেন রাফি, সাংগঠনিক সম্পাদক সজীব গাজী, দপ্তর সম্পাদক মো. সুমন হোসাইন প্রচার সম্পাদক মো. মাসুদ রানা, ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক মোছা. আসমা আক্তার খুশি।

কিন্তু কমিটি ঘোষণার পরপরই বেরোবি ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা সাংগঠনিক সম্পাদক ও সদ্য ঘোষিত এই কমিটির শীর্ষ পদপ্রত্যাশী মুরসালিন মুন্না এই কমিটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি ফেসবুকে লেখেন, ‘ছাত্রলীগের কর্মী দিয়ে কমিটি!! এ কেমন ছাত্রদলের কমিটি!! বেরোবির ছাত্রদলের ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের এহেন কাণ্ডজ্ঞানহীন কমিটি আমি এবং আমার সকল সহকর্মী প্রত্যাখ্যান করলাম। বেরোবিতে ছাত্রদলের কি এতই কর্মীর অভাব পড়ছে?’

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারন সম্পাদক ইমরান খাঁন শ্রাবন ফেসবুকে এই ঘটনার ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘অভিনন্দন…..বেরোবি ছাত্রলীগের নতুন কমিটি। ছাত্রদল নামে ছাত্রলীগের পূর্নবাসন সম্পন্ন হলো। এরা সকলেই ছাত্রলীগের প্রথমসারির নেতা ছিল, আজ তারা ছাত্রদলের নেতা। যারা এমন কমিটি দিলেন তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।’

আগেও একই ইতিহাস

২০২১ সালের ১৬ জুন যখন দীর্ঘ ৫ বছর পর বেরোবিতে ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটি দেওয়া হয়েছিল, তখনো একই অভিযোগ উঠেছিল। কমিটিতে শিবিরকর্মী, অছাত্র, চাকরিজীবী ও জেলা নেতাদের স্থান দেওয়া হয়। সেই কমিটির আহ্বায়ক আল আমিন ইসলামকে রংপুর জেলা ছাত্রদলের সহসম্পাদকের পদ দেওয়া হয়েছিল, যা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। এছাড়া সেই কমিটির সদস্য সচিব রাশেদ মন্ডলের বিরুদ্ধে সংগঠনে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলেছিলেন একাধিক ছাত্রদল নেতা। সেই সময় সারাবাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি তার বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তিনি সেসময় বলেছিলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির বাইরে আছি। আমি রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চাই। এ বিষয়ে আমি কেন্দ্রে কথা বলব।’ [পূর্বের নিউজ: https://sarabangla.net/news/post-563068/] পরবর্তীতে আর কমিটি বাতিল কিংবা স্থগিত হয়নি। ৫ আগস্টের পর সেই কমিটি চাঙ্গা হয়ে উঠেছিলো।

এবারও একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে সদ্য ঘোষিত এই কমিটির বিরুদ্ধে। অভিযোগ, ছাত্রলীগের কর্মীরাও ছাত্রদলের কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। কমিটি ঘোষণার পর থেকে ১১ সদস্যের অনেকেরই ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ছাত্রলীগের বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নেয়ার ছবি ফেসবুকে রীতিমতো ভাইরাল এখন। এছাড়া আবু সাঈদ হত্যা মামলায় গ্রেফতার হওয়া ও চার্জশীটভুক্ত আসামী হওয়া শিক্ষকদের সঙ্গেও তাদের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে। যেসব ছবি ভাইরাল হয়েছে সেখানে অধিকাংশ ছবিতেই সভাপতি মো. ইয়ামিন এবং সহ-সভাপতি মো. তুহিন রানাকে দেখা যাচ্ছে। ক্যাম্পাস সূত্রে জানা গেছে, মো. ইয়ামিন এবং তুহিন রানাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের রাজনীতির অতীত রয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে।

তবে এবিষয়ে তাদের দুজনকেই অভিযোগের বিষয়ে ফোন করা হলে তারা বলেন, ‘আমরা সব সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কাজ করব। এটাই আমাদের কাজ। এসব ছবি এডিট করা। এগুলো আমাদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ছড়ানো হচ্ছে। কমিটিতে সকল রানিং শিক্ষার্থী দ্বারাই করা হয়েছে। সবাই খুশী।’

বিতর্কিত ও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার পরও কিভাবে কমিটিতে রাখা হয়েছে এ বিষয়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি, সাধারণ সম্পাদককে একাধিকবার ফোন দিলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি। এজন্য এসংক্রান্ত কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

প্রশাসনের নীরবতা

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ক্যাম্পাসে সব ধরনের ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শওকত আলী সেসময় বারবার বলেছেন, ‘কোনো দলীয় ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম চলবে না।’ কিন্তু ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণার পরও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। উপাচার্য ড. মো. শওকাত আলীর ফোন বন্ধ থাকায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জ্যৈষ্ঠ শিক্ষক নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, ‘প্রশাসনের নীরবতা অস্বাভাবিক। নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে এটা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।’

প্রশাসনের নীরবতা নিয়ে ক্ষোভ

বেরোবি ক্যাম্পাসে ২০২৪ সালের গণ-আন্দোলনের পর থেকে সব ধরনের ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ। ছাত্র সংগঠনের কোনো কার্যক্রম, পোস্টার-ব্যানার, মিছিল-সভা সম্পূর্ণ বন্ধ। অথচ এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা করা হলো। শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন তুলছেন, ‘যদি রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়, তাহলে ছাত্রদলের কমিটি কীভাবে? প্রশাসন কেন নিশ্চুপ?’ বেরোবির শিক্ষার্থীরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, দলীয় কার্যকলাপ না বন্ধ হলে নির্বাচন বয়কটের হুমকি দিচ্ছেন। এই ঘটনা ক্যাম্পাসে নতুন উত্তেজনা তৈরি করেছে, যা ২৪ ডিসেম্বরের ভোটকে প্রভাবিত করতে পারে।

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নুজহাত জাহান নিপা বলেন, ‘যে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং ছাত্রসংসদ নির্বাচনের জন্য দীর্ঘ আন্দোলন চলছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলে কমিটি কীভাবে হয়? প্রশাসন যদি চোখ বন্ধ করে থাকে, তাহলে আমরা আবার রাস্তায় নামব।’

ইংরেজি বিভাগের সুমন ইসলাম বলেন, ‘যারা র‍্যাগিং করে তাদের শাস্তি দেওয়া হয়, কিন্তু যারা নিষেধাজ্ঞা ভেঙে দল গোছাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই। এটা প্রশাসনের দ্বিমুখী নীতি।’ অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বলেন, ‘ছাত্রসংসদ নির্বাচনের আগ মুহূর্তে এভাবে ছাত্রদল কমিটি দেওয়া মানে ভোটকে প্রভাবিত করার চেষ্টা।’

তবে ক্যাম্পাসের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও যদি একটি দল কমিটি করতে পারে, তাহলে অন্য দলগুলোও করবে। এতে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের আগে ক্যাম্পাস আবার অশান্ত হয়ে উঠতে পারে। তাই এখন সবার চোখ উপাচার্যের দিকে; প্রশাসন কি ছাত্রদলের এই কমিটিকে মেনে নেবেন, নাকি নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের অভিযোগে ব্যবস্থা নেবেন–এটি এখন বড় প্রশ্ন।

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর