Tuesday 30 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হার না মানা সাহসী নেত্রী ‘খালেদা জিয়া’

ফারহানা নীলা স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৯:০০ | আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ ১০:৩৮

সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি

ঢাকা: বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিছু নাম আছে, যেগুলো কেবল ব্যক্তি নয়-একটি সময়, একটি সংগ্রাম, একটি ধারার প্রতীক। বেগম খালেদা জিয়া তেমনই এক নাম। তিনি শুধু তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নন, শুধু একটি দলের চেয়ারপারসন নন-তিনি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির দীর্ঘ ও রক্তাক্ত পথচলার এক জীবন্ত দলিল।

মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) ভোরে তার মৃত্যুসংবাদ যখন আসে, তখন কেবল একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জীবনাবসান ঘটেনি-একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে।

শৈশব থেকে ‘শান্তি’ নামের গল্প

ডাকনাম ‘পুতুল’। উত্তরবঙ্গের সবুজ মাঠ, পুকুরপাড়, পারিবারিক আবহ- সেই সরল জীবনের ছাপ শেষ বয়স পর্যন্ত তার আচরণে থেকেছে। রাজনীতির নির্মমতা তাকে কঠোর করেছে, কিন্তু নির্মম নয়।

বিজ্ঞাপন

সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী থেকে রাষ্ট্রনায়কের পথে

মাত্র ১৫ বছর বয়সে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তরুণ কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিয়ে ছিল তার জীবনের প্রথম বড় বাঁক। সেনাপরিবারের শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন, ঘন ঘন বদলি, নিঃসঙ্গতা-এই অভিজ্ঞতাই তাকে পরবর্তী সময়ে মানসিকভাবে দৃঢ় করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ। জিয়াউর রহমান তখন সেক্টর কমান্ডার। যুদ্ধের ভয়াবহতা তিনি দেখেছেন খুব কাছ থেকে, একজন যোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে, একজন নারীর অসহায়তা নিয়ে। সেই অভিজ্ঞতা তার ভেতরে রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর প্রতি এক গভীর আবেগ তৈরি করে, যা পরবর্তী জীবনেও বারবার প্রকাশ পেয়েছে।

স্বামীর শাহাদাৎ ও রাজনীতিতে প্রবেশ

১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর খালেদা জিয়া হঠাৎই হয়ে ওঠেন ইতিহাসের কেন্দ্রে থাকা এক নারী। তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা প্রায় শূন্য ছিল। কিন্তু দায়িত্ব ছিল অসীম। অনেকে ভেবেছিলেন, তিনি হয়ত একটি প্রতীক হয়েই থাকবেন। কিন্তু সময় খুব দ্রুত সে ভুল ভেঙে দেয়। ১৯৮৩ সালে বিএনপির নেতৃত্ব নেওয়ার পর, তিনি কেবল উত্তরাধিকার রক্ষা করেননি, দলকে নতুন করে সংগঠিত করেছেন।

স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রথম বড় লড়াই

১৯৮৬ সালের নির্বাচন ছিল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তার প্রথম বড় রাজনৈতিক পরীক্ষা। তখনও তিনি নবীন, কিন্তু আপসহীন। সেই সময় থেকেই তিনি স্পষ্ট করে দেন, ক্ষমতার জন্য নয়, রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য তিনি লড়বেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানে চূড়ান্ত রূপ নেয়। সেই আন্দোলনের ফলেই ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ ফেরে সংসদীয় গণতন্ত্রে এবং খালেদা জিয়া হন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী।

ক্ষমতা ও বিরোধী রাজনীতির ২ মেরু

তিনি যেমন ক্ষমতায় ছিলেন, তেমনি দীর্ঘ সময় ছিলেন বিরোধী রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন, এক মাসের সরকার, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন সবখানেই তার উপস্থিতি ছিল বিতর্কিত, কিন্তু অনিবার্য। ২০০১ সালে চারদলীয় জোটের মাধ্যমে তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়া তার রাজনৈতিক দক্ষতার প্রমাণ। সেই সময়ের অর্জন যেমন আছে, তেমনি সমালোচনাও আছে এবং ইতিহাস সেটিই স্বীকার করে।

বালুর ট্রাকের অবরোধ ও নিঃসঙ্গতা

রাজনীতির নির্মম অধ্যায় আসে ক্ষমতা হারানোর পর। তার বাসভবন বালুর ট্রাক দিয়ে অবরুদ্ধ করা হয়। মাসের পর মাস তিনি কার্যত গৃহবন্দি ছিলেন। কিন্তু এই অবরোধ তাকে ভাঙতে পারেনি। ২০০৭–২০০৮ সালের জরুরি অবস্থায় তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। দল ভাঙার চেষ্টা চলে। বিদেশে পাঠানোর প্রস্তাব আসে। কিন্তু তিনি যাননি, বরং জেল, মামলা ও অপমানের ঝুঁকি নিয়েই দেশে থেকেছেন।

কারাবাস, অসুস্থতা ও আপস না করা

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজা, দীর্ঘ কারাবাস, গুরুতর অসুস্থতা- সবকিছু সত্ত্বেও তিনি শর্ত মেনে দেশ ছাড়েননি। নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেলেও বিদেশে চিকিৎসার শর্ত মানেননি বহুদিন। এই একগুঁয়েমিই তার রাজনৈতিক চরিত্রের মূল। আপসহীনতা-যা তাকে জনপ্রিয় করেছে, আবার সংকটেও ফেলেছে।

রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর প্রতি আবেগ

২০০৩ সালের বেনিন বিমান দুর্ঘটনা কিংবা ২০০৯ সালের বিডিআর হত্যাকাণ্ড-এই ঘটনাগুলোতে তার প্রকাশ্য কান্না রাজনীতির বাইরের এক খালেদা জিয়াকে দেখিয়েছে। তিনি রাষ্ট্রকে কেবল রাজনৈতিক কাঠামো হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন মানুষের জীবন হিসেবে। তার সেই উক্তি-‘বাংলাদেশ আমার ঠিকানা,’ কেবল স্লোগান নয়, তার রাজনৈতিক দর্শনের সারসংক্ষেপ।

নীরবতা, বার্তা ও প্রস্থান

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর তিনি আবার কথা বলেন। লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি দেওয়া বক্তব্য ছিল জাতির উদ্দেশে তার শেষ ভাষণ। অসুস্থ শরীর, কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠ, গণতান্ত্রিক অর্জন রক্ষার আহ্বান। এরপর আসে নীরবতা, চিকিৎসা। পাশে পায় পরিবার। দীর্ঘ আট বছর পর ঈদ-ছেলের পাশে, নাতনিদের ঘিরে। ২০২৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর সকালে সেই জীবন থেমে গেল।

বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন একদিকে কঠোর, আবার ছিলেন নমনীয়। তিনি ছিলেন ভয় না পাওয়া এক রাজনৈতিক নেত্রী- যিনি কারাবাস, অপমান, নিঃসঙ্গতা পেরিয়েও মাথা নত করেননি। বাংলাদেশ আজীবন স্মরণ করবে আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে।

সারাবাংলা/এফএন/এএ
বিজ্ঞাপন

আরো

ফারহানা নীলা - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর