সিনিয়র রিপোর্টার
হাতিয়া দ্বীপ থেকে: সাগর পাড়ি দিয়ে দ্বীপের ভূখণ্ডে পা রাখতে বেগ পেতে হলো। এখানে ভাঙ্গনের থাবার বিস্তৃতি বাড়ছে। হয় কাদা মাড়িয়ে, নয়তো আর দুই ট্রলারে ট্রানজিট হয়ে তীরে উঠতে হবে। এই ভাঙ্গন ঘিরে দুঃখগাঁথার মাঝেই হাতিয়াবাসীর সামনে এসেছে ভোট।
সরকার আসে সরকার যায়। ভাঙ্গন ঠেকানোর উপায় বের হয় না। জলদস্যুরা লুট করে। ডাকাত এসে গুলি করে সর্বস্ব লুটে নেয়। ঘর বাড়ি ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটতে হয় বহু মানুষকে। ফলে এখানে ভোট কিছুটা নিরুত্তাপ।
নোয়াখালী থেকে সাগর পথে স্পিডবোটে ৩০ মিনিট। সি-ট্রাকে দেড়ঘন্টা। ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চে ১৪ ঘন্টা আর চট্টগ্রাম সদরঘাট থেকে জাহাজে ৭ ঘন্টার পথ। যার পুরোটাই সাগর। যেসব পারি দিয়েই এখানে ভোট দেখতে আসা।
২২ ডিসেম্বর সন্ধ্যারাতে ‘এমভি মতিন’ নলছিড়া ঘাটের যেখানে নোঙ্গর ফেললো তার আরও দূরে তীর। এই তীর তখনও কেবল ভাঙছে। এমভি মতিনের এক যাত্রী জানালেন, এই কিছুদিন আগেও তীর থেকে আফিয়া বাজার যেতে আধঘন্টা লেগে যেতো এখন সরাসরি আফিয়া বাজারেই ঘাট। সাগরের ঢেউ সরাসরি বাজার ঘাটে ধাক্কা মেরে চলেছে অবিরত।
এখানে এখনো বিদ্যুতের আলো পৌঁছায়নি। গ্রামের পর গ্রাম এখনও অন্ধকারেই রাত্রি কাটায়। মূল সড়ক ছাড়া বাকি রাস্তাঘাটের উন্নয়ন চোখে পড়েনি।
এসব সামনে নিয়েই হাতিয়াবাসী ভোটের মওসুমে। এখানে আওয়ামী লীগের আয়েশা ফেরদৌস আর বিএনপি’র প্রার্থী সাবেক এমপি ফজলুল আজিম প্রার্থী হয়েছেন। দু’জনের বাড়ি উছখালীতে। মাত্র মিনিট পাঁচেক হাঁটা দূরত্ব এ বাড়ি থেকে ও-বাড়ির।
হাঁটা পথে প্রথমেই পড়ে বিএনপি প্রার্থীর বাড়ি। দেখা গেলো ধানের শীষের স্লোগান দিতে দিতে হাজার খানেক মানুষের একটি মিছিল বাড়িরি ভিতর ঢুকছে। গ্রামবাসী জানালেন, প্রচারণা শুরুর পর এক সপ্তাহ কেটে গেলেও এটাই নাকি দলের প্রথম মিছিল। তবে প্রার্থী নিজে ছিলেন না সে মিছিলে। মিছিল বাড়ির ভেতরে ঢুকলে প্রার্থী দ্বিতীয় তলার বারান্দা থেকে কেবল হাত নাড়লেন। মলিন চোখে নেতাকর্মীর দিকে তাকাচ্ছিলেন। কিন্তু নিচে নামছিলেন না। নিচে তার ছেলে ফারহান আজিম মাত্র এক মিনিটের বক্তব্য দিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন।
এরপর পাঁচ মিনিট হেঁটে গেলে অপর প্রার্থী মোহাম্মদ আলীর বাড়ি। তিনি সাবেক এমপি। বর্তমানে তার স্ত্রী এমপি। এবারেও তিনি আওয়ামী লীগের প্রাথী। এই প্রতিবেদক যখন পৌঁছালেন তখন তিনি বাড়িতে ছিলেন না। জানা গেলো জাহাজচরে জনসভা ছিলো। সেখান থেকে ফিরছেন।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আয়েশা ফেরদৌসের দেখা মিললো। বললেন, বড় একটা জনসভা করে ফিরলাম।
কথপোকথনে এলো বিএনপি প্রার্থীর প্রসঙ্গ। তিনি কেন ঘর থেকে বের হচ্ছেন না সে ঘটনা তার কাছে রহস্যজনক মনে হচ্ছে বলে জানালেন।
আয়শা ফেরদৌস জানালেন, তিনি নিজে পুলিশকে বলে দিয়েছেন যাতে বিরোধী প্রার্থী বের হলে যাতে নিরাপত্তা দেওয়া হয়। তারপরও বিএনপির প্রাথী বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না।
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে এমপি ফজলুল আজিমের ছেলেকে ফোন করলে তিনি বলেন, ‘প্রচারণার শুরুর পর থেকে আমরা বাধার মুখে। অস্ত্রের মুখে পড়েছি। ১০ টি গাড়ি ভেঙ্গে দিয়েছে বর্তমান এমপির লোকজন। আহত হয়েছে ৩০ জন।
পাল্টা প্রশ্ন করে এমপি পুত্র বলেন, কোন অবস্থায় বের হবো? এসব ঘটনায় উল্টো থানায় আমাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
এই ঘটনার বৃন্তান্ত জানতে থানায় যেতে হলো। থানাও মিনিট দশেক দূরত্বে। ওসি কামরুজ্জামান শিকদারের মতে, প্রথমে বিএনপি প্রার্থীর উস্কানিমূলক বক্তব্যের জেরে আওয়ামী লীগ প্রাথীর সমর্থকদের মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়া হয়। এরপর সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় দু’জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।
এছাড়া নির্বাচনী পরিবেশ শান্ত এমনটা দাবি করে ওসি কামরুজ্জামান বলেন, বিএনপি এমপি কেন ঘর থেকে বের হচ্ছেন না এর কারণ আমিও জানি না।
চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে নলছিড়া ঘাটে এসে নেমেছেন হোসেন আহমদ। চট্টগ্রামে পড়ালেখা করেন তিনি। এবার প্রথম ভোট দিতে আগেভাগেই জন্মস্থান হাতিয়ায় এলেন।
তার ভাষায়, এখনও দ্বীপে সন্ত্রাসের ভয়। রাত হলে ডাকাত। জলে দসু্যর আতঙ্ক। এসবের ভয় তাড়া করে দ্বীপবাসীর দিনযাপন। আরও খবর পেয়েছেন গেল সপ্তাহে আগুন দিয়ে দ্বীপের কয়েকটি ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
দ্বীপের মূল সড়ক ধরে এগিয়ে গিয়ে ভোটের খবর জানতে চাই কিছু সাধারণ মানুষের কাছেও। জবাবের আগেই পাল্টা প্রশ্ন তাদের, ভোটকেন্দ্রে তারা যেতে পারবে কি না?
তবে এ প্রশ্ন যারা করছেন তাদের বড় একটি অংশ ধানের শীষের সমর্থক। এখানে দলীয় ক্যাডার বাহিনীর সশস্র ভয় তাদের মনে। যারা নৌকার সমর্থক, তাদের কোনও ভয়ডর নেই। তারা ভোটউৎসবেই মেতে উঠতে চান।
অস্ত্রের মহড়ার বিষয়ে কথা হয় থানার ওসির সাথেও। তিনি বলেন, অস্ত্রের মহড়ার সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ নেই। কেউ ঢালাওভাবে বললে হবে না।
একজন বিএনপি নেতা ডেকে নিয়ে কতটি পরিবার সন্ত্রাসের শিকার হয়ে বাড়ি ফেলে তার দলীয এমপি প্রার্থীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন তার একটি খতিয়ান তুলে ধরলেন। জানালেন, ওখানেই তাদের জন্য রান্নাবান্না হয়। খাওয়া দাওয়া করেন ওখানেই।
আওয়ামী লীগের প্রাথী আয়েশা ফেরদৌস এ নিয়ে সারাবাংলাকে বলেন, সন্ত্রাসের সাম্প্রতিক কোন ঘটনা নেই। অতীতে যেগুলো হয়েছে তাতে বিএনপির কারও কিছু হয়নি।
তিনি জানান, আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ হয়ে মারা গেছে বেশ কয়েকজন।
এরমধ্যে গেল দুই বছরে তিনটি হত্যাকাণ্ডের তথ্য জানা গেল থানা থেকে। যাদের সবাই আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থক।
আয়েশা বলেন, তবে নির্বাচন সামনে রেখে বিভক্ত আওয়ামী লীগ এখন ঐক্যবদ্ধ। এজন্য বিজয়ের সম্ভাবনা বেশি দেখছেন তিনি। আশা করছেন সুষ্ঠূ ভোটেই তার জয় হবে।
আবার নির্বাচিত হলে হাতিয়ার এই দ্বীপবাসীকে আর অন্ধকারে থাকতে হবে না, এমনই নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি তার। আয়শা বলেন, ভোটে জিতলে অল্প কিছুদিনে মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ পাবে এই দ্বীপাঞ্চল।
ওদিকে বিএনপি প্রার্থী ফজলুল আজিমের আহবান, তিনি চান সন্ত্রাস, ডাকাত জলদসুমুক্ত হাতিয়া। এছাড়া দ্বীপের তীরে তিনি এর আগে এমপি থাকাকালে যে ব্লক বসানো শুরু হয়েছিলো তা সম্পন্ন করা হবে। পুরো দ্বীপ ব্লক বাঁধ দিয়ে ঘিরে দেবেন এমনটাই প্রতিশ্রুতি তার।
সারাবাংলা/এমএম