অস্বস্তি-সিদ্ধান্তহীনতায় আ. লীগের শরিকরা
১৭ জানুয়ারি ২০১৯ ২১:১৯
।। হাসান আজাদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ের পর এবার একলা চলো নীতিতে চলছে আওয়ামী লীগ। দলটির নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের ভেতর থেকে মন্ত্রিসভায় এখন পর্যন্ত কোনো দল থেকে কাউকে নেওয়া হয়নি। বরং জোটের শরিক দলগুলোকে বিরোধী দলে বসার আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে অস্বস্তিতে পড়েছে শরিক দলগুলো। ভুগছে সিদ্ধান্তহীনতায়ও। জোটগতভাবে ও একই প্রতীকে নির্বাচন করার পরও তাদের বিরোধী দলে পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন শরিক দলগুলোর নেতারা। তারা মনে করছেন, এমন সিদ্ধান্তের ফলে নিজেদের ঐক্য নষ্ট হবে। তবে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে জোটের বৈঠক পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন তারা। এজন্য শিগগিরই জোটের বৈঠকে বসার কথা বলছেন নেতারা। পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতির সিদ্ধান্তও জানতে চান তারা। জোটের একাধিক শরিক দলের নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার (১৭ জানুয়ারি) রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনের আওয়ামী লীগের বিজয় সমাবেশের প্রস্তুতি পরিদর্শনে এসে দলটির সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘১৪ দলের শরিকরা বিরোধী দলের আসনে বসলে সরকার ও শরিক উভয়ের জন্য ভালো। শরিকরা বিরোধী দলে থাকলে তাদের সমালোচনা থেকে সরকার শুদ্ধ হতে পারবে। ’
আরও পড়ুন: ১৪ দলের শরিকরা বিরোধী দলে থাকলেই ভাল: কাদের
ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, ‘১৪ দল আদর্শিক ও নির্বাচনি জোট আর মহাজোট হলো কৌশলগত জোট। মহাজোট বা ১৪ দলে কোনো টানাপড়েন নেই। ভাঙনের সুর নেই, বিভেদ নেই। ’ তবে, কোনো ভুল বোঝাবুঝি হলে আলোচনা করে তা নিরসন করা হবে বলেও তিনি জানান।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী ৩০ জানুয়ারি সংসদ অধিবেশন শুরুর আগেই জোটের শরিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন তারা। ওই বৈঠকে শরিক দলগুলোকেও সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালন করতে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেওয়া হবে। তারা বলেন, উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলগুলো গঠনমূলক সমালোচনা করে সংসদে যে ভূমিকা পালন করে, তেমনি আমরাও চাই, শরিকরা বিরোধী দল হোক।
এর আগে একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর গত ৩ জানুয়ারি ১৪ দলের বৈঠক হলে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
প্রসঙ্গত, এর আগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে প্রথম সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এই সরকারে জাতীয় পার্টি থেকে আনোয়ার হোসেন ও জাতীয় সমাজতান্ত্রি দল (জেএসডি) থেকে আ স ম আবদুর রবকে মন্ত্রিসভার সদস্য করা হয়। এরপর ২০০৮ সাল থেকে গত তিনটি নির্বাচনেই জোটবদ্ধভাবে অংশ নিয়ে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও গত দুই সরকারের মন্ত্রিসভায় শরিকদের রেখেছিল দলটি। তবে এবার সে ধারাবাহিকতায় ব্যত্যয় ঘটান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
আরও পড়ুন: নির্বাচনের সাফল্যে ১৯ জানুয়ারি বিজয় সমাবেশ করবে আ. লীগ
শরিক দলের নেতারা বলছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর জোট নিয়ে আওয়ামী লীগের আর কোনও আগ্রহ নেই। তারা বলেন, ১৪ দল একটি আদর্শিক জোট। ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এই জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে একযুগের বেশি সময় ধরে কাজ করছে এই জোট। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর শরিক দলগুলোকে সংসদের ভেতরে-বাইরে বিরোধী দলের ভূমিকায় দেখতে চাইছে আওয়ামী লীগ। এ কারণে ভবিষ্যৎ করণীয নিয়ে নিজ নিজ দলের ভেতরে আলোচনা চলছে। এমনকি জোট শরিকরা বিরোধী দলের গেলে ঐক্য থাকবে না বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন নেতারা। তবে সবশেষে বিরোধী দলে বসা নিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনায় বসতে চান বলে শরিক দলের একাধিক নেতা জানান।
জানতে চাইলে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দল ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সারাবাংলা’কে বলেন, ‘সরকারের থাকব, না বিরোধী দলে যাব, এ বিষয়ে এখনো সমাধানে আসতে পারিনি। তবে, আমরা যেহেতু ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে আছি, সেহেতু ১৪ দলেই থাকব। গণতন্ত্র রক্ষায় আমাদের ভূমিকা থাকবে। ’
মেনন আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে আমরা অতীতে জোটগতভাবে আন্দোলন, নির্বাচন ও পরে সরকার গঠন করেছি। এবারও একসঙ্গে নির্বাচন করেছি। নির্বাচনের পর সরকারে জোটের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা শরিকদের তার মন্ত্রিসভায় রাখবেন কি না—এর পুরো এখতিয়ার তার। এ নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) চাইলে আমরা বিরোধী দলেই থাকব, সংসদে কার্যকর ভূমিকা পালন করব। এবার যেহেতু সরকারে নেই। সংসদে ও সংসদের বাইরে সরকারের ভুল ত্রুটিগুলো আরও জোরালোভাবে তুলে ধরব।’
আরও পড়ুন: দল-সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সবাইকে কাজ করার আহ্বান শেখ হাসিনার
বিষয়টি নিয়ে এখনই মন্তব্য করতে রাজি নন জাসদের একাংশের সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। তিনি বলেন, ‘আমরা ১৪ দলীয় জোটে আছি, জোটের সঙ্গে থাকব। তবে বিরোধী দলের থাকার বিষয়টি জোটের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিতে চাই। তাই এ বিষয়ে এখনো মন্তব্য করতে চাই না। ’
আওয়ামী লীগের এমন পরিকল্পনার ব্যাপারে সুস্পষ্ট করে কোনো মন্তব্য করেননি বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া। তিনি বলেন, ‘জোট নিয়ে এখন আওয়ামী লীগের আগ্রহটা কম। আমরা আমাদের রাজনীতি, আন্দোলন, সংগ্রাম করবো। আমাদের মত জানাব, সেটা সংসদে হোক আর সংসদের বাইরেই হোক।’
জানতে চাইলে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ‘শরিকদের বিরোধী দলে যাওয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতির একটি সূদুরপ্রসারী চিন্তা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে একটা নতুন দিকদর্শন দিয়েছে। আমাদের যে লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায়, বিরোধী দলও ক্ষমতায়। তবে এ বিষয়ে জোটের বৈঠকে নেওয়া হবে। ’
আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা নিয়ে নাখোশ নন তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী। তিনি বলেন, ‘সরকারে সঙ্গে আমরা কাজ করছি, করে যাব। প্রধানমন্ত্রী আমাদের কাজ করে যেতে বলেছেন। তিনি ইচ্ছা করলে আমরা বিরোধী দলে যেতে পারি।’
আরও পড়ুন: সংসদে ‘সাদাকে সাদা, কালোকে কালো’ বলবে জাপা
বিরোধী দলে যাওয়ার পক্ষে নন আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর দল জাতীয় পার্টির (জেপি) মহাসচিব শেখ শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা বিরোধী দলে যাব না। অন্য শরিকদেরও বিরোধী দলে যাওয়ার সুযোগ নেই। মহাজোট থেকে যারা নৌকা মার্কায় নির্বাচন করেছে, তাদের বিরোধী দলে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’ আর্টিকেল ৭০ অনুযায়ী বিরোধী দলে গেলে তাদের সংসদ সদস্য পদ বাতিল হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
উল্লেখ্য, গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২৮৮ আসনে জয়ী হয়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ২৫৭টি আসন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ওয়ার্কার্স পার্টি ৩টি, জাসদ ২টি, বাংলাদেশ জাসদ ১টি, তরিকত ফেডারেশন ১টি, জাতীয় পার্টি-জেপি ১টি আসনে জয়ী হয়।
সারাবাংলা/এইচএ/এমএনএইচ