বিএনপিতে এক ব্যক্তির কর্তৃত্ব, চাপা ক্ষোভ শীর্ষ পর্যায়ে
২৪ মে ২০১৯ ১৮:৩৩
ঢাকা: বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিতে এক ব্যক্তির কর্তৃত্ব কায়েম হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে দলটির শীর্ষ পর্যায়ে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, খালেদা জিয়ার অবর্তমানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিকে অন্ধকারে রেখে সব ধরনের সিদ্ধান্ত তিনি একাই নিচ্ছেন। শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা, পরামর্শ ও তাদের মতামত ছাড়াই লন্ডনে বসে একাই দল চালাচ্ছেন।
জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপির চার প্রার্থীর শপথ গ্রহণ, নাগরিক ঐক্য’র আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে বিএনপিতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব, সংরক্ষিত নারী আসনে রুমিন ফারাহানাকে মনোনয়ন, বগুড়া-৬ উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ ও খালেদা জিয়ার জন্য মনোনয়ন সংগ্রহের নির্দেশ— সম্প্রতি নেওয়া এই সিদ্ধান্তগুলোর কোনোটির ব্যাপারেই দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা কিছুই জানতেন না।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপির ছয় সংসদ সদস্যের শপথ গ্রহণের জন্য নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে গত ২৯ এপ্রিল শপথ নেন চার জন। শপথ গ্রহণের পর এই চার জনের পক্ষ থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ সাংবাদিকদের জানান, তারেক রহমানের নির্দেশেই তারা শপথ নিয়েছেন। শপথ গ্রহণের আধা ঘণ্টা আগে স্কাইপের মাধ্যমে তারেক রহমান তাদের শপথ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন।
সংসদে শপথগ্রহণ চলাকালে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সে সময় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেছিলেন, ‘শপথ গ্রহণের ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। আমার শরীরটা ভালো না। বাসা থেকে বের হইনি। বাসাতেই আছি।’
শুধু মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নয়, চার সংসদ সদস্যের শপথ গ্রহণের ২০ ঘণ্টা আগে গত ২৮ এপ্রিল রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও নজরুল ইসলাম খান সারাবাংলাকে বলেছিলেন, শপথ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল আছে বিএনপি। নতুন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। শপথ গ্রহণের পর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তারা দুইজনই সারাবাংলাকে বলেছিলেন, ‘এ ব্যাপারে আমরা কিছু জানি না।’
সম্প্রতি নাগরিক ঐক্য’র আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে বিএনপিতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেন তারেক রহমান। চিকিৎসার জন্য ব্যাংকক যাওয়ার আগে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই প্রস্তাব মান্নার কাছে পৌঁছে দেন।
গত ১৯ মে নয়াপল্টন কার্যালয়ে সারাবাংলার সঙ্গে কথা হয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. মঈন খানের সঙ্গে। মাহমুদুর রহমান মান্নাকে বিএনপিতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব সম্পর্কে জানতে চাইলে এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘দলীয় ফোরামের এ বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তাছাড়া মান্না সাহেব তো একটি দলের প্রধান। তিনি বিএনপিতে আসবেন কেন? আর তাকে আমরা আনতে চাইবই বা কেন?’
গত ২০ মে সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য রুমিন ফারাহানাকে মনোনয়ন দেয় বিএনপি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের স্বাক্ষর করা মনোনয়নপত্র রুমিন সংগ্রহ করেন খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এ বি এম সাত্তারের হাত থেকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, রুমিন ফারহানার জন্য প্রস্তুত করা ওই মনোনয়নপত্রে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষর করেন গত ৮ মে। অর্থাৎ চিকিৎসার জন্য ব্যাংকক যাওয়ার সাত দিন আগেই মনোনয়নপত্রে স্বাক্ষর করেন মির্জা ফখরুল।
কিন্তু গত ১৯ মে রাতে সংরক্ষিত নারী আসনের মনোনয়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই। কারণ, বিষয়টি নিয়ে দলীয় ফোরামে কোনো আলোচনা হয়নি।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি নেওয়া প্রতিটি সিদ্ধান্ত তারেক রহমানের একার। লন্ডনে বসে তিনি সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকায় সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলগীর। কখনো কখনো খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এ বি এম সাত্তার। বিষয়টি নিয়ে মির্জা ফখরুল কিছুটা বিব্রত হলেও দল ও জিয়া পরিবারের প্রতি সর্বোচ্চ আনুগত্যের কারণে তিনি সব কিছু মেনে নেন।
তারেক রহমানের একক কর্তৃত্ব নিয়ে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ে চাপা ক্ষোভ থাকলেও দলের অখণ্ডতা রক্ষা এবং তারেক রহমানের রোষানলে পড়ার ভয়ে কেউ মুখ খোলেন না। তবে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় স্থায়ী কমিটির বেশিরভাগ সদস্য তারেক রহমানের একক কর্তৃত্বের কড়া সমালোচনা করেন।
অবশ্য বিএনপির রাজনীতির থিংক ট্যাংক হিসেবে পরিচিতি সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা তারেকের এই একচ্ছত্র কর্তৃত্বের ঘোরবিরোধী। তারা মাঝে মধ্যেই তারেক রহমানের সমালোচনা করেন। অতীতে অনেকবার তাদের এই সমালোচনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন খালেদা জিয়াও।
বিএনপিতে তারেক রহমানের একক কর্তৃত্ব সম্পর্কে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘সম্প্রতি তারেক রহমানের নেওয়া তিনটি সিদ্ধান্তের মধ্যে দুইটি সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সঠিক। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াটা ভুল। ওখানে (লন্ডন) বসে একা সিদ্ধান্ত দেওয়া গণতান্ত্রিক নয়। ওনার (তারেক রহমান) উচিত ছিল স্থায়ী কমিটির সঙ্গে আলাপ করা।’
‘স্থায়ী কমিটিরও একটা দায়িত্ব আছে। তাদের উচিত ছিল পদত্যাগ করা। তাদের সঙ্গে এই ধরনের গৃহপালিত বেড়ালের মতো ব্যবহার গণতন্ত্রের জন্য শুভকর নয়, মঙ্গলকর নয়,’— বলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
সারাবাংলা/এজেড/টিআর