ক্যাসিনো নিয়ে উক্তির পর বিতর্কে হুইপ শামসুল, দেখছেন ষড়যন্ত্র
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৬:৩১
চট্টগ্রাম ব্যুরো: জাতীয় সংসদের হুইপ হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার আট মাসের মধ্যেই নানা ধরনের বির্তকের মুখে পড়েছেন জাতীয় সংসদের হুইপ শামসুল হক চৌধুরী। চট্টগ্রামের পটিয়া থেকে নির্বাচিত তিনবারের সংসদ সদস্য এই আওয়ামী লীগ নেতা দেশে জুয়া ও ক্যাসিনো বিরোধী সাম্প্রতিক অভিযানের অংশ হিসেবে চট্টগ্রামের আবাহনী ক্লাবে চালানো অভিযানের বিরোধিতা করে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছেন। শুধু নিজের নয়, ছেলের কর্মকাণ্ডেও কিছুটা ব্রিবতকর পরিস্থিতিতে রয়েছেন তিনি।
তবে এসবের পেছনে ‘ষড়যন্ত্রকারীদের কারসাজি’ দেখছেন হুইপ শামসুল হক।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থা ও বিশ্বাস তার ওপর আছে এমনটা দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করে বলেছেন, এসব ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার দেবেন।
রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামে দেশের বিভিন্ন স্পোর্টস ক্লাবে ক্যাসিনো ও জুয়ার আসর বিরোধী অভিযানের ধারাবাহিকতায় গত ২১ সেপ্টেম্বর রাতে চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহরে ‘চট্টগ্রাম আবাহনী লিমিটেডে’ অভিযান চালায় র্যাব। ওই ক্লাবের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্বে আছেন হুইপ সামশুল হক চৌধুরী।
এই অভিযানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এর প্রতিক্রিয়ায় সামশুল হক চৌধুরী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, এতে তাদের সম্মানহানি হয়েছে।
গণমাধ্যমে এই বক্তব্য আসার পর সামাজিক মাধ্যমে তীব্র সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হুইপ শামসুল হক চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘পরিকল্পিতভাবে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। আমার অপরাধ কি, সেটাই জানি না। জ্ঞানত আমি কোনো অপরাধ করিনি।’
শামসুল হকের ওই বক্তব্যের একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যা বলেছি সরল বিশ্বাসে বলেছি, সেটা যে ভিডিও করা হচ্ছিল আমি জানতাম না।’
সারাবাংলাকে হুইপ আরও বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে পদক্ষেপ, সেটার সঙ্গে তো আমার কোনো দ্বিমত নেই। তিনি ঢাকা শহরকে যারা মাদক-জুয়া-ক্যাসিনোর শহর বানিয়ে ফেলেছে, কোটি কোটি টাকা ঘুষ-দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের ধরতে বলেছেন। কিন্তু কোথাও ক্লাবে বসে ২-৪ জন তাস খেললে, সেখানে অভিযান চালানোর কথা তো প্রধানমন্ত্রী বলেননি। উনার নির্দেশনাকে ভুলভাবে নেওয়া হয়েছে। আমি বলেছি- আবাহনীর মতো একটা ইন্টারন্যাশনাল ক্লাবে কেন অভিযান হবে? আমাদের কেন বেইজ্জত করা হবে? এসব বলে কি আমি অপরাধ করে ফেলেছি?’
তিনি বলেন, ‘আবাহনী ক্লাবে ঢুকে আমাদের একজন পিয়নকে মারধর করা হয়েছে। এটা শুনে আমি উত্তেজিত হয়ে যাই। আমি হার্টের রোগী। অটোমেটিক আমি উত্তেজিত হয়ে যাই। আমার সরল বিশ্বাসে বলা কিছু কথাকে পুঁজি করে পত্রপত্রিকাগুলো যা ইচ্ছা তা-ই লিখছে। ষড়যন্ত্রকারীরা আমার বিরুদ্ধে লেগেছেন। আমি এর বিচার আল্লাহর কাছে দেব আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেব।’
আবাহনী ক্লাবে অভিযানের আগেরদিন গত ২০ সেপ্টেম্বর সাইফুল আমিন নামে একজন পুলিশ পরিদর্শকের ছবিসম্বলিত আইডি (সাইফ আমিন) থেকে দেওয়া একটি পোস্ট ফেসবুকে ভাইরাল হয়। সেখানে অভিযোগ করা হয়, আবাহনী ক্লাবের জুয়ার আসর থেকে গত পাঁচ বছরে হুইপ আয় করেছেন ১৮০ কোটি টাকা। আবাহনী ক্লাবে অভিযানের পর ভাইরাল হওয়া এই পোস্ট নিয়ে ফেসবুকে তুমুল সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হতে থাকেন হুইপ, যা এখনো অব্যাহত আছে।
ওই পোস্টের জেরে আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়নের (এপিবিএন) ওই পরিদর্শককে ইতোমধ্যে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া হুইপ শামসুল হক চৌধুরী বাদি হয়ে সাইফুলের বিরুদ্ধে ঢাকায় সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা দায়ের করেছেন। তবে ওই পুলিশ পরিদর্শক আদৌ নিজে ফেসবুকে পোস্টটি দিয়েছেন কি না অথবা সামগ্রিক পরিস্থিতিতে তার কোনো বক্তব্য এখনও গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হুইপ শামসুল হক চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘একজন ফেসবুকে কি লিখেছে, সেটার সত্যমিথ্যা যাচাই না করে সবাই আমার বিরুদ্ধে লেগেছে। ১৮০ কোটি টাকা ইনকাম করতে হলে প্রতিদিন ৫ লাখ টাকা করে ইনকাম করতে হবে। এত টাকা কিভাবে লেনদেন হল, কোন ব্যাংকের মাধ্যমে, প্রতিদিন কি এই টাকা নগদ লেনদেন হয়েছে কি না, কেউ এটা ভেবে দেখছেন না। এসব কথা কি বিশ্বাসযোগ্য ? যাক, আমি আইনের মাধ্যমে বিচার চেয়েছি। আশা করি বিচার পাব।’
পুলিশ পরিদর্শক সাইফুল আমিনের ফেসবুক পোস্টের রেশ না কাটতেই চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ক্রীড়া সম্পাদক ও চট্টগ্রাম আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব দিদারুল আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, হুইপের ছেলে নাজমুল করিম চৌধুরী শারুন টেলিফোনে তাকে ‘চড় মেরে দাঁত ফেলে দেওয়ার’ হুমকি দিয়েছেন। এ সংক্রান্ত মোবাইলে কথোপকথনের অডিও রেকর্ড প্রকাশ হলে আরেকদফা তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সম্প্রতি দিদারুল আলম আবার তাকে নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হুইপের বক্তব্যের বিরুদ্ধে আইনি নোটিশও পাঠিয়েছেন।
দিদারুল আলম জানান, তিনি আবাহনী ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব। ২০০৭ সালে তাকে মহাসচিব থেকে সরিয়ে ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়। প্রিমিয়ার ব্যাংকের জিইসি মোড় শাখায় এই কমিটির একটি যৌথ হিসাব খোলা হয়। আবাহনী ক্লাবের মহাসচিব শামসুল হক চৌধুরী, ম্যানেজার সাইফুদ্দিন এবং দিদারুল আলমের যৌথ স্বাক্ষরে এই যৌথ হিসাব পরিচালনার কথা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে তাকে না জানিয়ে টাকা লেনদেন করায় সম্প্রতি তিনি ওই হিসাব বন্ধের আবেদন করেন। ফলে ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করা হয়। এ বিষয়ে কথা বলতে গত ১৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটে দিদারুল আলম হুইপপুত্র শারুনকে ফোন করলে দুর্ব্যবহারের শিকার হন।
ছেলের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে হুইপ শামসুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার ছেলে সহজ-সরল। সে প্রথমে ভদ্রভাবে কথা বলেছিল। কিন্তু দিদারুল আলম আমাকে উদ্দেশ্য করে রাস্তায় ধরে লোকজন পেটাবে, রাস্তায় প্যান্ট খুলে নেবে- এই ধরনের কথা বলার পর আমার ছেলে উত্তেজিত হয়ে যায়। দিদারুল আলমের সঙ্গে আমার ৩০ বছরের বিরোধ। সুযোগ পেয়ে সেও আমার পেছনে লেগেছে। সব আমার কপালের দোষ। কথা বলার সময় দিদারুল আলম যে রেকর্ড করে রাখবে, এটা তো আমার ছেলে জানত না। আমার বিরুদ্ধে বলা কথাগুলো এডিট করে শুধু আমার ছেলে যেগুলো বলেছে, সেগুলো দিদারুল আলম সাংবাদিকদের দিয়েছে।’
এরপর বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক নাজমুল করিম চৌধুরী শারুন ফেসবুকে নিজের আইডিতে দেওয়া পোস্টে লিখেন, ‘আমার বাবার দীর্ঘদিনের হিংসুটে শত্রু দিদারুল আলম সাহেব এবং আমার কথোপকথনের একটি এডিটেড অডিও ফেসবুক ও বিভিন্ন মিডিয়ায় তিনি অপপ্রচার করাচ্ছেন। গত সপ্তাহে তিনি আমাকে হঠাৎ ফোন করেন এবং আমি ভদ্র ও ভালভাবেই কথা বলছিলাম। কিন্তু হঠাৎ তিনি আমার পিতা ও আমার পরিবার নিয়ে নোংরা কথা বলেন যার প্রেক্ষিতে আমি রাগান্বিত মন্তব্য করি। তিনি তার উস্কানিমুলক অশ্লীল কথাগুলো কেটে ফেলে দিয়ে বিভিন্ন অংশ জোড়া লাগিয়ে শুধুমাত্র আমার রাগান্বিত বক্তব্যগুলি প্রচার করে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। নোংরা মনমানসিকতার লোকেরাই পরিকল্পনা করে ফোন দিয়ে রেকর্ড করে এডিট করে অপপ্রচার করেন। যাই হোক অতীতেও তিনি সফল হননি, এবারও হবেন না। রাজনৈতিক হিংসুক এসব লোকদের আল্লাহ হেদায়েত দান করুন।’
পোস্টের সঙ্গে আপলোড করা ভিডিওবার্তায় শারুন তার বক্তব্যে কেউ মনে দুঃখ পেলে ক্ষমাও চেয়েছেন।
হুইপের বিরুদ্ধে প্রায় সপ্তাহজুড়ে চলা বিতর্ক-সমালোচনার আগুনে ঘি ঢেলেছেন চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনও। হুইপের বক্তব্যের পরদিন মেয়র তার নাম উল্লেখ না করে ‘জুয়ার অভিযান বিরোধী’ বক্তব্যের সমালোচনা করেন। এরপর নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মেয়র নাছির যৌথ বিবৃতিও দিয়েছেন। এ অবস্থায় হুইপ শামসুলের সঙ্গে মেয়র নাছিরের বিরোধও আলোচনায় এসেছে।
হুইপের দাবি, কয়েকদিন পর আবাহনীর উদ্যোগে চট্টগ্রামে শেখ কামাল কাপ ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু হবে। এই কমিটিতে আগে চেয়ারম্যান ছিলেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। এবার তাকে ভাইস চেয়ারম্যান করে চেয়ারম্যান করা হয়েছে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালকে। কমিটির চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ায় মেয়র তার বিরুদ্ধে লেগেছেন বলে দাবি হুইপের।
এ বিষয়ে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের বক্তব্য জানতে পারেনি সারাবাংলা।
যুবদল-জাতীয় পার্টি ঘুরে আওয়ামী লীগে আসা শামসুল হক চৌধুরী ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান। দীর্ঘসময় ধরে হাতছাড়া হয়ে থাকা পটিয়া আসনটি আওয়ামী লীগ পুনরুদ্ধার করে শামসুল হকের মাধ্যমে। এরপর আরও দু’দফা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে এবার প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় হুইপের দায়িত্বও পেয়েছেন।
সারাবাংলা/আরডি/এমএম
আবাহনী ক্লাব ক্যাসিনো চট্টগ্রাম মেয়র নাছির সমালোচনা হুইপ শামসুল হক চৌধুরী