Monday 05 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আজহারের মুক্তিতে বিলম্ব: আইনি জটিলতা নাকি দলের উদাসীনতা!

রাশেদ মামুন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৫ মে ২০২৫ ২৩:৩৩

জামায়াত নেতা এটিএম আহজারুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: সময়ের পালাবদলে রাজনীতির মাঠে সরব জামায়াতে ইসলামী। সাংগঠনিক শক্তি দেখাতে নানামুখী কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত দলটি। পাল্লা দিয়ে নির্বাচনি দৌড়েও এগোচ্ছেন শীর্ষ নেতারা। কিন্তু এখনো একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ড নিয়ে জেলে বন্দি এটিএম আহজারুল ইসলাম। তবে তার মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানির অপেক্ষায় সর্বোচ্চ আদালতে। শেখ হাসিনার পতনের ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও আজহারের মুক্তি না মেলায় হতাশা দেখা দিয়েছে মাঠপর্যায়ে নেতাকর্মীদের মাঝে। কিন্তু এখানে আইনি জটিলতা নাকি দলের উদাসীনতা রয়েছে- এমন প্রশ্ন জেগেছে অনেকের মনে।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতের এই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের ফাঁসি কার্যকরের আগেই গদি ছেড়ে পালান শেখ হাসিনা। গেল ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে তার পতনের পরই উচ্চ আদালতে এটিএম আজহারের সুবিচার পাওয়ার সুযোগ মেলে জামায়াতের। তার মুক্তিতে ফেব্রুয়ারিতে বিভিন্ন আলটিমেটামও দেয় দলটি। এমনকি স্বেচ্ছায় গ্রেফতারও হতে চেয়েছেন জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান। তবে মাঝপথে সরিয়ে নেওয়া হয় সেই কর্মসূচি।

বিজ্ঞাপন

এর মধ্যেই ২০ ফেব্রুয়ারি আজহারের ফাঁসির সাজার রায় পুনর্বিবেচনা বা রিভিউ আবেদনটি আপিল বিভাগের শুনানির কার্যতালিকায় আসে। ৯ নম্বরে থাকায় শুনানি না হওয়ায় ২৭ ফেব্রুয়ারি দিন ঠিক করেন আদালত। তবে এর আগের দিন তথা ২৬ ফেব্রুয়ারি আজহারের ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি দেন আপিল বিভাগ। মানবতাবিরোধী অপরাধের এটিই প্রথম কোনো মামলা, যেখানে রিভিউ থেকে মূল আপিল শুনানির অনুমতি দেওয়া হয়।

আদালত সূত্র জানায়, এটিএম আজহারুল ইসলামের আপিল শুনানি আগামী ৬ মে দিন ধার্য করেন আপিল বিভাগ। ২২ এপ্রিল প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দেন। একইসঙ্গে সাত বিচারপতির বেঞ্চে এ বিষয়ে শুনানি হওয়ার কথা জানানো হয়। এদিন আদালতে আসামিপক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিক। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।

এদিকে, শুরু থেকেই এটিএম আজহারের মুক্তি নিয়ে আদালতের ন্যায়বিচারের প্রতীক্ষায় রয়েছে জামায়াত। তবে হাইকমান্ডের আন্তরিকতার অভাব বা উদাসীনতার কারণেই এই শীর্ষ নেতার মুক্তিকে বিলম্ব হিসেবে দেখছেন দলটির মাঠপর্যায়ের অনেক নেতাকর্মী। তিনি মুক্ত হলে জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ পদের দাবিদার রাখবেন বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের উপজেলা পর্যায়ের একাধিক নেতাকর্মী জানান, জামায়াতের রাজনীতি করার কারণেই শেখ হাসিনার প্রহসনের মামলার শিকার হয়েছেন এটিএম আজহারসহ অন্যান্য নেতারা। দলে তাদের অবদান সবচেয়ে বেশি ছিল। ২০১২ সালে গ্রেফতার হওয়ার আগে জামায়াতের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন এই আজহার। অথচ স্বৈরশাসকের পতনের পর বিভিন্ন মামলায় খালাস পেয়ে বিএনপি নেতা লুৎফুজ্জামান বাবরসহ অনেকে মুক্ত আকাশে ঘুরে বেড়ালেও অন্ধকার কারাগারে দিন গুনছেন এই জামায়াত নেতা।

জামায়ােতর নেতাকর্মীরা জানান, আজহারের মুক্তির দাবিতে স্বেচ্ছায় গ্রেফতার হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন জামায়াত আমির। একইসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সাম‌নে গণঅবস্থা‌নের কর্মসূ‌চি দেওয়া হয়েছিল। এমন ঘোষণায় বেশিরভাগ নেতাকর্মীই কারাগারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। এতে অনেকের মনেই সন্দেহ জাগতে শুরু করে।

মূলত আজহার ইস্যুতে জামায়াতের কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলদের কোনো অজানা শক্তি ভুলিয়ে রেখেছে বলে ধারণা তাদের। আর এ কারণেই তার মুক্তি মিলছে না। এভাবে চললে কোনোদিন বের হতে পারবেন বলেও সম্ভাবনা দেখছেন না এসব নেতাকর্মী।

এ প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ না হওয়ার কারণে এটিএম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে শুনানি বারবার পিছিয়েছে। তবে আগামী ৬ মে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে এ শুনানি হবে। ওই দিন ইতিবাচক রায় পাব বলেও আমরা আশাবাদী।’

আজহারের মুক্তির ব্যাপারে দলের উদাসীনতা আছে কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা বরাবরের মতোই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এ কারণে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে তার ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় রয়েছি। এছাড়া স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ট্রাইব্যুনালে দেওয়া রায়ে দলের একজন শীর্ষ নেতার মুক্তি না মিললে নেতাকর্মীদের মাঝে হতাশা দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। তবে তার মুক্তি নিয়ে জামায়াতের ভেতরে কোন্দল কখনোই ছিল না, এখনো নেই। কেননা আমরা একটি আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করি।’

আইনজীবী আব্দুল মান্নান সারাবাংলাকে বলেন, ‘জামায়াত নেতা আজহারের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে করতে হবে। এজন্য কিছুটা দেরি হচ্ছে। তবে জামায়াত নেতাদের রায় অনেকটা ফরমায়েশি ছিল। কেননা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এক জায়গা থেকেই সব রায় লিখে দেওয়া হতো; যার প্রমাণ সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকসহ প্রভাবশালী কয়েকজনের কর্মকাণ্ডে মিলেছে।’

অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির সারাবাংলাকে বলেন, ‘মামলাটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন আপিল বিভাগ। আইনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের বিবেচনায় পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। কেননা আগে এ মামলার রায় দিয়েছেন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ। ভবিষ্যতে যেন মামলার নিষ্পত্তি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা না হয়; সেজন্যই শুনানির নতুন দিন ঠিক করেন আদালত।

ওই দিনের পর এ মামলা নতুন করে শুনানির আর কিছু থাকবে না বলেও আশাব্যক্ত করেন এই আইনজীবী। তিনি বলেন, ‘৬ মে সাত বিচারপতির বেঞ্চে আমরাও শুনানি শেষ করব। আদালতও উপযুক্ত সিদ্ধান্ত দেবে বলে আশাবাদী। কেননা জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বা সংবেদনশীল মামলা হিসেবে শুনানির জন্যই ওই দিন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ বসবেন। আর এ শুনানিই হবে এ মামলার প্রতি ন্যায়বিচার।’

উল্লেখ্য, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রমের যাত্রা শুরু হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর অঞ্চলে গণহত্যা-হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, আটক, নির্যাতন ও গুরুতর জখম এবং বাড়িঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো নয় ধরনের ছয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিল এটিএম আজহারের বিরুদ্ধে।

২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর এটিএম আজহারকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে যায় দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর বিরুদ্ধে আপিলে শুনানির পর ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় ঘোষণা করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ে আনীত অভিযোগ ২ নম্বর, ৩ নম্বর এবং ৪ নম্বর অভিযোগে ফাঁসির দণ্ডাদেশ পেয়েছেন আজহার।

এছাড়া ৫ নম্বর অভিযোগে অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অমানবিক অপরাধের দায়ে ২৫ বছর ও ৬ নম্বর অভিযোগে নির্যাতনের দায়ে ৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়। আপিল বিভাগের রায়ে ২, ৩, ৪ (সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে) ও ৬ নম্বর অভিযোগের দণ্ড বহাল রাখা হয়। আর ৫ নম্বর অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়। ২০২০ সালের ১৫ মার্চ আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। এরপর রিভিউ করেন এটিএম আজহার।

২০২০ সালের ১৯ জুলাই আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিভিউ আবেদন করেছিলেন এটিএম আজহারুল ইসলাম। ২৩ পৃষ্ঠার পুনর্বিবেচনার এ আবেদনে মোট ১৪টি যুক্তি উপস্থাপন করা হয়।

সারাবাংলা/আরএম/পিটিএম

এটিএম আজহারুল ইসলাম জামায়াত নেতা বিচার মানবতাবিরোধী অপরাধ মৃত্যুদণ্ড

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর