Tuesday 06 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

৫ মে ২০১৩
শাপলা চত্বরে হেফাজতের মহাসমাবেশে জামায়াত যেভাবে ছিল

মেহেদী হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৬ মে ২০২৫ ০৮:২৩

২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশ। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: ২০১৩ সালের ৫ মে, গভীর রাত। ঢাকার শাপলা চত্বরের মঞ্চে আগুনঝরা বক্তব্য দিচ্ছেন হেফাজতে ইসলামের নেতারা। কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে লাখো নেতাকর্মীর জমায়েত। চারপাশ ঘিরে আছে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি সদস্যরা। অবস্থানকারীদের বারবার সরে যাওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে হ্যান্ডমাইকে। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। চারপাশে ভুতুড়ে অন্ধকার। সেদিন দিবাগত রাতে ভীতিকর সেই শাপলা চত্বরে কী ঘটেছিল তা নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।

বিজ্ঞাপন

নারী নীতির বিরোধিতাসহ ইসলাম নিয়ে কটুক্তির অভিযোগে কয়েকজন ব্লগারকে ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে সেদিন রাজধানীর শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়েছিল হেফাজতে ইসলাম। তখন হেফাজতের অবস্থানকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনেও শুরু হয় নানামুখী তৎপরতা। এখন প্রশ্ন উঠছে, সেদিন হেফাজতের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামের মাঠে থাকার প্রসঙ্গ নিয়ে।

৫ মে ফজরের নামাজের পর পরই রাজধানী ঢাকার প্রবেশমুখগুলো দখলে নেওয়ার চেষ্টা করে হেফাজতে ইসলাম। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে লোকসমাগম ও উত্তেজনা। পরিস্থিতি অনুকূলের বাইরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখে নড়েচড়ে বসে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা শাপলা চত্বরের দিকে এগোতে থাকলে মোড়ে মোড়ে বাধা দেয় আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী ও পুলিশ। বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষে পল্টন ও শাপলা চত্বরের আশপাশ এলাকা রূপ নেয় রণক্ষেত্রে। কিন্তু তারপরও পিছু না হঠে শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে গেঁড়ে বসে হেফাজতে ইসলাম। তখন আওয়ামী লগের পক্ষ থেকে অভিযোগ ওঠে, হেফাজতের ব্যানারে মাঠে নেমেছে জামায়াত-শিবির।

আসলেই কি ৫ মে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতে কোনো ভূমিকা রেখেছিল জামায়াতে ইসলাম? সারাবাংলার অনুসন্ধানে এবং জামায়াত-শিবিরের মাঠ পর্যায়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১০ সালে যাত্রা শুরু হওয়া হেফাজতে ইসলাম ২০১৩-তে নিজস্ব শক্তিতে এরকম একটা বড় কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, সেটি মানতে নারাজ অনেকেই। আর সেটিরই আভাস বুঝতে পেরেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। কারণ, হেফাজতের প্রোগ্রামকে পেছন থেকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করে জামায়াতের নেতাকর্মীরা।

বিজ্ঞাপন

পরোক্ষভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হেফাজতের পক্ষে তৎপরতা চালাতে থাকে জামায়াত-শিবিরের লোকজন। তারা সরাসরি মাঠে থেকেও পানি ও খাবার দিয়ে হেফাজতের কর্মী-সমর্থকদের সহায়তা করেন। এছাড়া, জামায়াত-শিবিরের মাঠ পর্যায়ের লোকজনের উপস্থিতি ছিল হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষের সময়। কারণ, হেফাজতের মাদরাসা ছাত্রদের সে সময়ে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সঙ্গে টিকে থাকার সক্ষমতা কম ছিল। কিন্তু সন্ধ্যা নামার পর পরই শাপলা চত্বর ও পল্টনসহ আশপাশের এলাকা থেকে চলে যেতে থাকে জামায়াত-শিবিরের মাঠ পর্যায়ের লোকজন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতে অন্যান্য দলের মতো নৈতিক সমর্থন দিয়েছিল জামায়াত। আমরা প্রত্যক্ষভাবে তাদের সঙ্গে মাঠে ছিলাম না। কারণ, সেটি আমাদের কোনো কর্মসূচি ছিল না।’

হেফাজত ইসলামের তৎকালীন ঢাকা মহানগর কমিটির প্রচার সম্পাদক মুফতি ফখরুল ইসলাম আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছিলেন যে, ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশের অর্থ যোগান দিয়েছিল জামায়াত। আর এই দলটির নেতাকর্মীরা সরাসরি কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিল বলে জানান তিনি। এমনকি সে সময় হেফজত নেতা জুনায়েদ বাবুনগরীকে বিএনপি-জামায়াত ঘেঁষা হিসেবেও মনে করা হতো।

সেদিন কি মাঠ পর্যায়ে জামায়াতের নেতাকর্মীরা অংশ নিয়েছিলেন? জানতে চাইলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল এবং সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার সারাবাংলাকে বলেন, ‘হেফাজতের কর্মসূচিতে মুসলমান হিসেবে আমাদের নৈতিক সমর্থন ছিল। তাই আমাদের লোকজন সেদিন সরাসরি অংশ নিয়েছিল। শুধু আমাদের দলই নয়, সেদিন সব দলই হেফাজতের কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিল। আমাদের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব হয়েছিল হেফাজতে ইসলামকে মুসলমান হিসেবে ততটুকুই সাহায্য করার চেষ্টা করেছি।’

যা ঘটেছিল ৫ মে

দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকে হেফাজতের কর্মী-সমর্থক, মাদরাসার শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয় রাজধানীর শাপলা চত্বরে। এক পর্যায়ে তাদের সরিয়ে দিতে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের সামনে, পল্টন, ফকিরাপুল ও রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেয় পুলিশ। সেইসঙ্গে আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারী ক্যাডাররাও হেফাজতের নেতকর্মীদের ওপর হামলা চালায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এক পর্যায়ে ওই এলাকায় রণক্ষেত্রে রূপ নেয়। আর এই ঘটনাগুলো টেলিভিশনগুলো লাইভ প্রচার করতে থাকে। কিন্তু আওয়ামী সরকারের নিষেধাজ্ঞায় সন্ধ্যার পর থেকে একে একে সব টেলিভিশন লাইভ প্রচার বন্ধ করে দিতে থাকে। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়া শাপলা চত্বর সহ আশপাশের পুরো এলাকায়। বেসরকারি টেলিভিশন দিগন্ত তাদের লাইভ চালিয়ে যাওয়ায় রাতেই সিলগালা করে দেওয়া হয় টেলিভিশনটি। এরপর সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়। অন্ধকার করে রাখা শাপলা চত্বরে কী হতে যাচ্ছে?

গভীর রাতে অভিযান চালাতে ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নিতে থাকে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির কয়েক হাজার সদস্য। রাত ৩টার দিকে তারা বৃষ্টির মতো গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে থাকে। ভীতিকর এই পরিবেশে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় হেফাজতের মাইকের আওয়াজ। কিন্তু বিরতিহীনভাবে গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগোতে থাকে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির সদস্যরা। ১০ মিনিট পর তারা মঞ্চের পাশে গিয়ে দেখতে পান, চারটি মরদেহ পরে আছে। হেফাজতের হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক আশ্রয় নেয় আশেপাশের ভবনে। তাদের চোখ মুখে যেন অজানা আতঙ্ক। পরে তাদের কমলাপুরের রেলস্টেশনের দিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তবে ভোররাতেও চলতে থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলির শব্দ।

শাপলা চত্বরে হামলায় মৃতের সংখ্যা নিয়ে ধোঁয়াশা

শাপলা চত্বরে রাতের অভিযানে নিহতের সংখ্যা নিয়ে শুরু হয় ব্যাপক বিতর্ক। আড়াই হাজারের মতো নিহত হওয়ার অভিযোগ তুলেছিল বিভিন্ন রাজনৈতক দল। তবে পুলিশ বলেছিল, অভিযানের সময় আহত একজন হাসপাতালে মারা যান এবং দিনের সহিংসতায় চারজনের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল মঞ্চের কাছে একটি ভ্যানে। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, শাপলা চত্বরে হেফাজতের কর্মসূচিকে ঘিরে সারা দেশে সহিংসতায় ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে দুই দিনে ২৮ জন নিহত হন।

এদিকে, শনিবার (৩ মে) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, ‘রাজধানীর মতিঝিলে শাপলা চত্বরে টানা দুই দিনের সেই সহিংসতায় অন্তত ৫৮ জন প্রাণ হারান, যার মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যও ছিলেন সাতজন।

সারাবাংলা/এমএইচ/পিটিএম

৫ মে ২০১৩ জামায়াত ইসলামী শাপলা চত্বর হেফাজতে ইসলাম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর