৭ মে ১৯৬৮ সাল, যাত্রা শুরু হয়েছিল রাজধানীর অন্যতম ঐতিহ্যবাহী তিতুমীর কলেজের। আজ ৫৮ বছরের পা দিলো ঐতিহ্যবাহী কলেজটি। ইতিহাস বলছে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে জিন্নাহ কলেজ ও পরবর্তী ১৯৭১ সালে স্বাধীন দেশে তিতুমীর নামকরন করা হয়।
এতো বছরের পদচারনায় প্রতিষ্ঠানটি গৌরবময় ঐতিহ্যের সাথে শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ দিয়ে এসেছে। বর্তমানে কলেজটিতে প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর পদচারণা রয়েছে। রয়েছে ২২টি বিভাগ, শিক্ষার্থীদের জন্য প্রশাসনিক ভবন, একাডেমিক ভবন, লাইব্রেরি, একটি মিলনায়তন, মসজিদ, মন্দির, ছাত্র সংসদ কক্ষ, নিজেস্ব জিমনেসিয়াম, মেয়েদের কমনরুম, শিশু দিবা যত্ন কেন্দ্র, ৫টি আবাসিক হল ও শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য ৯টি বাস। রয়েছে শিক্ষার্থীদের আত্ম-উন্নয়নের জন্য ১৮ টি সহশিক্ষামূলক সংগঠন।
আজ ৫৮ বছরের পদার্পণে এসে কতটুকু পূরণ করতে পেরেছে শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষা? প্রতিষ্ঠানের অর্জন, সমস্যা, সমাধান ও গনঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ফ্যাসিবাদের পতনের পর কলেজের পরিবর্তন ও প্রত্যাশা নিয়ে মতামত ব্যক্ত করেছেন কলেজের শিক্ষার্থীরা।
জবাবদিহিমূলক প্রশাসন ও টেকসই উন্নয়ন রপরেখা করতে হবে
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী তানভীর রহমান বলেন, তিতুমীর কলেজ একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৫৮ বছরে পা দিয়েছে—যা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। দীর্ঘ এই পথচলায় কলেজটি জ্ঞানচর্চা, ছাত্ররাজনীতি, সংস্কৃতি ও মানবিক মূল্যবোধ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন থেকে অধিভুক্ত সাত কলেজ পর্যন্ত এই কলেজ বারবার প্রমাণ করেছে এর সম্ভাবনা কতটা বিস্তৃত।
নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নে—ফ্যাসিবাদের পতনের পর আমরা চাই তিতুমীর কলেজ হোক মুক্তচিন্তা, গণতন্ত্র ও মানবিকতার ঘাঁটি। এখানে থাকবে না কোনো দমন-পীড়ন, থাকবে স্বাধীন মতপ্রকাশের পরিবেশ, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন ও টেকসই উন্নয়নের রূপরেখা।
রাজনীতির অতি প্রভাবমুক্ত শিক্ষার পরিবেশ
রসায়ন বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী শাহিদা আক্তার জানায়, প্রতিষ্ঠার ৫৮ বছরে কলেজের রয়েছে অনেক অর্জন। ফ্যাসিবাদের পতনের পর আমরা পেয়েছি পরিবর্তনের এক বাংলাদেশ। কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ও অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।কলেজের কাঠামোগত ও শিক্ষার মান উন্নয়ন চলছে। কিন্তু বিগত সময় দেখা যাচ্ছে ফ্যাসিস্টের সময়ের যেই রাজনৈতিক দাঙ্গা, রাজনৈতিক অতি বিচরন তা আবারো শুরু হচ্ছে। কলেজে প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক দলের শোডাউন সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বিব্রতকর অবস্থা। নতুন বাংলাদেশে আমার কলেজ নিয়ে প্রত্যাশা একটাই রাজনীতির অতি প্রভাবমুক্ত একটি শিক্ষার পরিবেশ।
থাকবে না সিস্টেমে বেড়াজাল, থাকবে না দাসত্বের শৃঙ্খল
বাংলা বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নওশাদ মাহমুদ বলেন, তিতুমীর কলেজ তার ৫৮ বছরের পথচলায় একটি জনসাধারণের আস্থাভাজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, যেখানে শিক্ষক নিয়োগ হবে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়, ল্যাব ও প্রযুক্তি ব্যবস্থার উন্নয়ন হবে দ্রুতগতিতে এবং প্রশাসন হবে জবাবদিহিমূলক। একটি সহনশীল ও উদার শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে মত প্রকাশ করতে পারবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কাঠামোর নিচে এই ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানটি বারবার অবহেলিত ও নিষ্পেষিত হয়েছে। প্রশাসনিক জটিলতা, একাডেমিক দীর্ঘসূত্রিতা আর সিদ্ধান্তহীনতায় শিক্ষা ও শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এই অব্যবস্থার বিরুদ্ধে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা বহুবার সোচ্চার হয়েছে। তারা তিতুমীরের নাম ধারণ করে একটি স্বতন্ত্র “তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়” দেখতে চায়, যেখানে থাকবে না সিস্টেমে বেড়াজালে বদ্ধ হওয়া কোন প্রশাসন, থাকবে না দাসত্বের শৃঙ্খল।
শিক্ষাঙ্গন হবে শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চার স্থান
ইংরেজি বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নাজিবা জানায়, আমার অন্যতম ভালোলাগার জায়গা আমার তিতুমীর কলেজ যা আজ ৫৭ বছর থেকে৫৮ বছরে পদার্পণ করলো। কিন্তু অনেক জায়গায় এখনো রয়ে গেছে অব্যবস্থা। কলেজের লাইব্রেরি তে নেই পর্যাপ্ত বই,রয়েছে শিক্ষক সংকট, শিক্ষার ক্ষেত্রে নেই নতুনত্ব। এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে।
অভ্যুথান পরবর্তী ২.০ এর বাংলাদেশে আমার কলেজ নিয়ে আমার প্রথম প্রত্যাশা থাকবে কলেজ হবে শুধুমাএ শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চার স্থান। রাজনৈতিক দল গুলোর দাসত্ব নয়। চাই সুন্দর শিক্ষামূলক পরিবেশ। যেখানে থাকবে না কোন রাজনৈতিক শাসন শিক্ষার্থীরা সর্বত্র শিক্ষামূলক কাজে ব্যস্ত থাকবে ক্যম্পাসে।
আবাসন সমস্যা ও গবেষণামূলক কার্যক্রমে অনুদানের ঘাটতি পূরণ করতে হবে
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী হাসান আলী বলেন, সরকারি তিতুমীর কলেজের ৫৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, আমাদের প্রতিষ্ঠান সাংস্কৃতিক চর্চায় এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।
তবে শিক্ষার্থীর সংখ্যার দিক থেকে বৃহত্তম আমাদের এই প্রতিষ্ঠানটিতে এখনও শিক্ষার্থীদের আবাসন সমস্যা রয়েছে। প্রয়োজন প্রযুক্তিগত উন্নয়নের। সেই সাথে শিক্ষার্থীদের গবেষণামূলক কাজে উৎসাহ ও অনুদান এর ঘাটতি রয়েছে।
কলেজ কতৃপক্ষের সুষ্ঠু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এসকল সমস্যা সমাধান সম্ভব বলে বিশ্বাস করি। এছাড়াও আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন অনুষদে বিশেষায়িত কিছু বিষয় যুক্ত করার মাধ্যমে শিক্ষার মানকে আরও সমৃদ্ধ করা যাবে বলে মনে করি।
থাকতে হবে পর্যাপ্ত শ্রেনীকক্ষ, ল্যাব ও শিক্ষক স্বচ্ছতা
গনিত বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সাদিয়া জানায়, তিতুমীর কলেজের ৫৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এমন এক সময়ে উদযাপিত হচ্ছে, যখন বাংলাদেশ একটি নতুন পথের দিকে এগোচ্ছে—ফ্যাসিবাদের পতনের পর গণতন্ত্র, ন্যায় ও মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটছে। এই পরিবর্তনের প্রভাব কলেজ ক্যাম্পাসেও পড়েছে। এখন শিক্ষার্থীরা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারছে, শিক্ষাঙ্গনে ফিরে এসেছে একাডেমিক পরিবেশ ও অংশগ্রহণমূলক সংস্কৃতি। রাজনৈতিক প্রভাব থেকে অনেকটা মুক্ত হয়ে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা, গবেষণা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশ নিচ্ছে।
তিতুমীর কলেজ তার দীর্ঘ পথচলায় অনেক অর্জন করেছে—দেশের উচ্চশিক্ষায় একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে এবং হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে আলোকিত করেছে। আগামীতেও এই প্রতিষ্ঠানটি যেন জ্ঞান, নৈতিকতা ও মুক্তচিন্তার আলোয় একটি প্রগতিশীল জাতি গঠনে ভূমিকা রাখে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা ।