ফরিদপুর: র্যাবের এএসপি পলাশ সাহার নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন। তার আগে একটি সুইসাইড নোটও লিখে গেছেন তিনি। সেই নোট দেখার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেটিজেনরা তার স্ত্রী সুস্মিতাকে দায়ী করে একতরফাভাবে দিয়েছেন একের পর এক স্ট্যাটাস। কিন্তু ফরিদপুরে পলাশের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে জানা গেল ভিন্ন কথা।
পলাশের স্ত্রী সুস্মিতাকে হেয়প্রতিপন্ন করে দেওয়া নেটিজনদের স্ট্যাটাসের কোনো মিলই খুঁজে পাওয়া গেল না। বরং, পলাশের শ্বশুরবাড়ির লোকজন ও তাদের পাড়া প্রতিবেশীদের দাবি, যৌতুকের জন্য পুত্রবধূ সুস্মিতাকে প্রতিনিয়ত নিপীড়ন করতেন পলাশের মা আরতি সাহা। যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করে সুস্মিতাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চান তিনি।
ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামট পুরাতন বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন চৌধুরী পাড়ার ৬২ বছরের বয়সী বাসিন্দা ভরত সাহা। তার মেয়ে সুস্মিতা সাহা। দু’বছর আগে ২০ বছর বয়সী সুস্মিতার বিয়ে হয় পলাশ সাহার সঙ্গে। শনিবার (১০ মে) সকালে চৌধুরীপাড়া সুস্মিতার বাবার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কাঁদতে কাঁদতে বেহুস হওয়ার মতো দশা ভরত সাহার। র্যাবে কর্মরত এএসপি মেয়ে জামাই আত্মহত্যার পর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ছে তার। এই ঘটনায় মেয়ের নামে শ্বশুর বাড়ির লোকদের অপবাদ আরও যন্ত্রণা বাড়িয়ে তুলেছে তাদের।
ভরত সাহা বলেন, ‘পলাশের মা আরতি সাহা খুবই ভয়ংকর মহিলা। আমাদের কাছে টাকা পায়নি, তাই সারাদিন অত্যাচার করতো মেয়েটাকে। ঠিকমতো খেতেও দিত না। আমার তো টাকা-পয়সা নেই, এটাই আমার দোষ। আমার কোনো কর্ম নেই, নিজের ওষুধ কেনার টাকাও নেই, মেয়েকে কোত্থেকে দেবো! ওই মহিলা চেয়েছিল ছেলেকে বিয়ে দিয়ে কোটি কোটি টাকা আনবে। সেটা না পেরে সারাদিন যন্ত্রণা দিত সুস্মিতাকে। আর নিজের স্ত্রীর অপমান সইতে না পেরে জামাই নিজেকেই শেষ করে দিল।’
সুস্মিতার চাচাতো ভাই পার্থ সাহা বলেন, ‘১৮ বছর হওয়ার আগেই আমার বোনকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় পলাশ। ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার পর ওর আগ্রহ দেখে আমরা বোনকে তার সঙ্গে বিয়ে দিই। কিন্তু বিয়ের পর কোনোদিন ওদের বাড়ি আমরা যেতে পারিনি। সবসময় শুনতাম বোনটাকে ওরা যৌতুকের জন্য অত্যাচার করে। কিন্তু পলাশের কথা সবসময় শুনেছি ভালো। সে আমার বোনকে অনেক ভালোবাসতো।’
প্রতিবেশী চান্দু সরকার সুস্মিতাদের পরিবার সম্পর্কে বলেন, ‘এই এলাকার সবাই জানে ভরতের পরিবারটি খুব নিরীহ। সুস্মিতার ছোট ভাই সৌরভ সাহা খুলনার কুয়েট ইউনিভার্সিটিতে লাস্ট সেমিস্টারে পড়াশোনা করছে। ওর বাবার টাকা নেই। তবুও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করছে। কিন্তু শাশুড়ির লোভের কাছে আমাদের মেয়েটা জামাই হারাল।’
সুস্মিতার খালাতো ননদ দীপা সরকারের সঙ্গে এই ঘটনার তিন দিন আগেই কথা হয় দু’জনের। দীপা সাহা বলেন, ‘তিন দিন আগে মোবাইল ফোনে কথা হয়; সুস্মিতা বলেছিল, ডাল রান্না খুব ভালো হওয়ায় তার প্রশংসা করেছিল পলাশ। সঙ্গে সঙ্গে খাবার টেবিলেই তার শাশুড়ি আরতি সাহা ডালের বাটি ছুড়ে ফেলে দেয়। সেদিন রাতেই সুইসাইড অ্যাটেম্প নেয় সুস্মিতা।’
সুস্মিতার মামাতো ভাই তুষার সাহা পলাশের মায়ের বিষয়ে বলতে গিয়ে জানান, ‘সুস্মিতাকে এই পরিবারে বিয়ে দিতে রাজি ছিল না। কিন্তু পলাশের আগ্রহের কারণে তারা রাজি হন। সুস্মিতার শাশুড়ি এমন মানুষ যে, ছেলেকে কখনই হাত ছাড়া করতে চাইতেন না। বিয়ের হানিমুনেও তাদের সাথে সাথে গেছে। সুস্মিতাকে কারো সাথে কথা বলতে ও মিশতে দিতো না। বউ হাসলেও মায়ের সমস্যা। অনেক ঘটনা আছে যা বলে বোঝানো যাবে না। কিন্তু দুঃখজনক! মিডিয়ার একপক্ষ বক্তব্যে আসল ঘটনা কেউ জানতে পারছে না!’
এদিকে পলাশের মা আরতি সাহার বক্তব্য, ‘গত ৬ মে পলাশের সঙ্গে সাথে আমি কথা বলি। বৌ সুস্মতিা আড়ালে দাঁড়ায় শোনে। তার পর পলাশকে ফোনে মেসেজ দেয়। মায়ের সঙ্গে কী কথা হয়ছে জানতে চায়। পলাশ এ কথা বলতে না চাইলে বৌ ক্ষিপ্ত হয়ে বাড়ি থেকে চলে যেতে চায়। বৌয়রে অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আমার ছেলে প্রাণ হারিয়েছে।’ সুস্মিতার ওপর শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
শাশুড়ির এমন অসত্য বক্তব্য ও বদনামের কথায় সুস্মিতার পরিবারের যন্ত্রণা ও কষ্ট আরও বেড়ে গেছে বলে অভিযোগ তার স্বজনদের।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাট এলাকায় র্যাব কার্যালয়ে সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার পলাশ সাহা ‘আত্মহত্যা’ করেন। বুধবার (৭ মে) সকাল সাড়ে ১০টায় র্যাব-৭ এর নগরের বহদ্দারহাট ক্যাম্পে নিজ অফিস কক্ষে তার গুলিবিদ্ধ মরদেহ পাওয়া যায়।
জানা গেছে, পলাশ সাহা গোপালগঞ্জ জেলার বাসিন্দা। পারিবারিক কলহের জেরে তিনি আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন বলে ধারণা পুলিশের। তার হাতে লেখা সুইসাইড নোটে লেখা আছে, ‘আমার মৃত্যুর জন্য মা এবং বউ কেউ দায়ী না। আমিই দায়ী। কাউকে ভালো রাখতে পারলাম না। বউ যেন সব স্বর্ণ নিয়ে যায় এবং ভালো থাকে। মায়ের দায়িত্ব দুই ভাইয়ের ওপর। তারা যেন মাকে ভালো রাখে। স্বর্ণ বাদে যা আছে তা মায়ের জন্য। দিদি যেন কো-অর্ডিনেট করে।’